X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

গার্মেন্টসের বাইরে অন্য খাতের শ্রমিকদের কী হবে?

গোলাম মওলা
২৭ মার্চ ২০২০, ১৭:০০আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২০, ১৮:৩৭

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির মানুষ। ইতোমধ্যে পর্যটন, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ অর্ধশতাধিক খাত অচল হয়ে পড়ায় এসব খাত-সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের আয় বন্ধ হওয়ার পথে। রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতও বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী দেড়-দুই মাসের মধ্যে অর্থনীতির চাকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতে পারে। তখন কৃষি শ্রমিক ছাড়া বাকি সব খাতের শ্রমিকদের জীবনমান বদলে যাবে। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শ্রমিকের হাতে কোনও কাজ থাকবে না। ফলে তখন দেশে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তবে তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী খাতের শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা এসব খাত-সংশ্লিষ্ট ৪৫ লাখ শ্রমিকের হতাশা কিছুটা হলেও দূর করবে। অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের জন্যও অনুরূপ একটি তহবিল গঠন করার জরুরি বলে মত দিচ্ছেন তারা।

বুধবার (২৫ মার্চ) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে করোনার আঘাত মোকাবিলায় দেশের রফতানিমুখী খাতের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, রফতানিমুখী খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম তৈরি পোশাক খাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, স্পেশালাইজড টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য, ওষুধ, চা, শাকসবজি, হ্যান্ডিক্র্যাফট ও তামাক। পণ্য হিসেবে রফতানি হয় আসবাবপত্র, বাইসাইকেল, জাহাজ, আলু, হস্তশিল্প, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া, পরচুলা, গরুর নাড়িভুঁড়ি, চারকোল, টুপি, মাছ ধরার বড়শি, মশারি, শুকনা খাবার, পাঁপড়, হাঁসের পালকের তৈরি পণ্য, লুঙ্গি, কাজুবাদাম, চশমার ফ্রেম, কৃত্রিম ফুল, গলফ শাফট, খেলনা, আগর, ছাতার লাঠি, শাকসবজির বীজ, নারিকেলের ছোবড়া ও খোল দিয়ে তৈরি পণ্য, ব্লেড ইত্যাদি। এ ধরনের শতাধিক পণ্য রফতানি হয়। এরমধ্যে বেশকিছু পণ্য রফতানির বিপরীতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিয়ে থাকে সরকার। রফতানির তালিকায় আরও আছে শরীর থেকে রক্ত নেওয়ার পাইপ (ব্লাড টিউবিং সেট), অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই), সিআর কয়েল, তামার তার, কাজুবাদাম, রেশম, রাবার, ফেলে দেওয়া কাপড় থেকে তৈরি পণ্য, ভবন নির্মাণসামগ্রী, সিরামিক পণ্য, গ্লাস, তোয়ালে, মসলা, প্রসাধনপণ্য।

গার্মেন্টসের বাইরে অন্য খাতের শ্রমিকদের কী হবে? ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, রফতানি আয়ে পোশাকের অবদান ৮৩ শতাংশের বেশি। তবে হোমটেক্স, টেরিটাওয়েলসহ এ খাতের অন্যান্য রফতানির উপখাত হিসাব করলে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ৮৫ শতাংশ। আর গার্মেন্টস মালিকরা বলছেন, পুরো রফতানি খাতের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য প্রণোদনার ঘোষণা নিঃসন্দেহে ভালো সংবাদ। তবে অন্য শ্রমিকরাও এ ধরনের প্রণোদনা পাওয়ার দাবি রাখে।’

তিনি বলেন, যারা পর্যটন খাতে, হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতে কাজ করে তারা এখন বেকার হয়ে পড়েছে। বাস শ্রমিকরাও বেকার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া যারা রাস্তার ধারে দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারাও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেন। চা বিক্রেতা, রিকশাচালক তারাও অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।

গার্মেন্টসের বাইরে অন্য খাতের শ্রমিকদের কী হবে? পিআরআই নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘হ্যাঁ, হয়তো গার্মেন্টস শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ। তাই তারা পেয়েছেন। অন্যরা সংঘবদ্ধ নয়, তাই পায়নি। কিন্তু রাষ্ট্রের উচিত সবাইকে দেখা।’

তিনি বলেন, ‘গার্মেন্ট শ্রমিকদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শ্রমিক রয়েছেন অন্য খাতে। এ কারণে অন্যদের ভুলে গেলে চলবে না। যারা গ্রামে থাকেন, ভিজিএফ কার্ডধারী, তারাও সুবিধা পাবেন, ১০ টাকা কেজি চাল পাবেন, রিলিফ পাবেন। কিন্তু যারা শহরে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক ছিলেন তারা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বেন।’

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘গার্মেন্ট খাতের ৪৫ লাখ শ্রমিকের জন্য যদি ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল হতে পারে, তাহলে গার্মেন্ট খাতের বাইরে তার চেয়ে বড় আকারের আরেকটি প্রণোদনা তহবিল গঠন করতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে হলেও ফান্ড করা উচিত।’

তিনি উল্লেখ করেন, গার্মেন্ট খাতের ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতে তথা শুধু হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতেই ২০ থেকে ২৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। তারা এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। এই শ্রমিকদের তথ্য সরকার ইচ্ছা করলেই সংগ্রহ করতে পারে। বিমান-পর্যটন, পরিবহনসহ শতাধিক খাতে অন্তত সাড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি শ্রমিক কাজ করছেন। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত বলে জানান তিনি।

গার্মেন্টসের বাইরে অন্য খাতের শ্রমিকদের কী হবে? পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক বলেন, করোনাভাইরাসে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই এখন বিপর্যস্ত, যার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। তার মতে, আগামী দেড় থেকে দুই মাস পরই সেটা টের পাওয়া যাবে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট ৬ কোটি ৭০ হাজার মানুষ শ্রমবাজারে নিয়োজিত। তারা ১০০-এর বেশি খাত-উপখাতে নিয়োজিত রয়েছেন। এদের মধ্যে গার্মেন্টস খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ৪৫ লাখের কাছাকাছি। তবে রফতানিকারকরা বলছেন, রফতানি খাতে প্রায় ২ কোটি শ্রমিক কাজ করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০২টি প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতের মধ্যে অন্তত ৬২টিতে ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি নেই। যেসব শিল্পে ঘোষিত মজুরি আছে, সেখানেও মজুরি কাঠামো পরিপূর্ণভাবে মানা হয় না। ফলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে মজুরি ও শ্রমিক অধিকারের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত।

জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তহবিল যত বড় হবে, ততই ভালো। তবে আমাদের সক্ষমতার বিষয়টিও দেখতে হবে।’

তিনি উল্লেখ করেন, গার্মেন্ট শ্রমিকরা তো পাবেনই, অন্যরাও পাবেন। তবে গার্মেন্ট শ্রমিক অরগানাইজড (সংঘবদ্ধ), এছাড়া তারা তালিকাভুক্ত, তাদের সঙ্গে কাজ করা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়। তবে অন্য শ্রমিকরাও যাতে বঞ্চিত না হন, বা বিপদে না পড়েন, সরকার সে ব্যাপারে দেখবে।

গার্মেন্টসের বাইরে অন্য খাতের শ্রমিকদের কী হবে?

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘যারা সংঘবদ্ধ নন তারা শহর ছেড়ে যখন গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবেন, তখন উপজেলা চেয়ারম্যানের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করা হবে। সব খাতের সব শ্রমিকের ব্যাপারে আমরা দেখবো।’ একজন শ্রমিককেও না খেয়ে থাকতে হবে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আগামী ১০-১২ দিনের মধ্যে আরও পরিষ্কার হওয়া যাবে।’

তৈরি পোশাক শ্রমিকদের পাশাপাশি অন্য খাতের শ্রমিকরাও প্রণোদনা পাওয়ার দাবি রাখে বলে মন্তব্য করেন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘রফতানিমুখী খাতের মধ্যে ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত। এই খাতে রয়েছে ৫০ লাখের কাছাকাছি শ্রমিক। কাজেই ৫ হাজার কোটি টাকার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের জন্য ব্যয় হবে। তবে অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের জন্য আরেকটা বড় তহবিল হওয়া উচিত।’

তিনি বলেন, ‘কোনও শ্রমিকই ফেলনা নয়। সামনের দিনগুলোতে সবাই যাতে ভালোভাবে চলতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী কোরবানি ঈদ বা জুলাই পর্যন্ত সব খাতের শ্রমিকরা যাতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, সেই ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।’ এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ফান্ড থেকে ঋণ নিয়ে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল দিয়ে শুরু করেছে। এটাকে সাধুবাদ জানানো উচিত। এখন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ নিতে পারলে এই তহবিল আরও বড় হতে পারে।’

গার্মেন্টসের বাইরে অন্য খাতের শ্রমিকদের কী হবে? তিনি বলেন, ‘তবে রফতানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি যদি অন্যান্য খাতের তথা অভ্যন্তরীণ বাজারের শ্রমিকদের জন্য প্রণোদনা থাকতো, তাহলে ভালো হতো।’

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি তহবিল থাকা জরুরি। বিশেষ করে এসএমই খাতের শ্রমিকদের বেতনের বিষয়টি ভাবা জরুরি। এছাড়া আর্থিক সহায়তা দরকার হবে শহরে ও গ্রামের দেশীয় শিল্প ও সেবা খাতে; প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে।’ 

সিপিডি’র এই গবেষক জানান, দেশে বর্তমানে ৬ কোটি ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করেন। এরমধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখ কাজ করেন কৃষি খাতে। কৃষি খাতের শ্রমিকদের কোনও সমস্যা হবে না। বাকি প্রায় ৪ কোটি শ্রমিক কাজ করছেন শিল্প ও সেবা খাতে। এই ৪ কোটি শ্রমিকের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

/এইচআই/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক