X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংকিং ২০১৫: ঋণ খেলাপে ন্যুব্জ অনেকে

গোলাম মওলা
৩১ ডিসেম্বর ২০১৫, ১১:২০আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫, ১১:২৫

ফিরে দেখা ২০১৫ ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেও ভাল গেল না ২০১৫। বিনিয়োগ পরিবেশ ভাল না থাকায় উদ্যোক্তারা ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়েন। বছরজুড়ে অলস টাকার মধুর যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে এই খাতকে। ফলে ব্যাংকগুলোকে একদিকে আমানতে সুদ গুনতে হয়েছে, অন্যদিকে নতুন কোনও প্রকল্পে ঋণও দিতে পারেনি।
ঋণের বিপরীতে কাঙ্ক্ষিত সুদ থেকে আয় করতে পারেনি ব্যাংক। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনর্গঠন বা মেয়াদ বাড়াতেহয়েছে। আবার বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণও । এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাংকগুলোকে। আর খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে নিট আয়ে বড় প্রভাব পড়ছে।
একই সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যের শ্লথগতিতে সুদবহির্ভূত আয়ও কমে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে বেড়েই চলেছে ব্যয়। এ কারণেই বেশিরভাগ ব্যাংক ব্যয় সাশ্রয়ের নীতি অবলম্বনের চেষ্টা করছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর পাশাপাশি লোকবলও কমিয়ে দিয়েছে অনেকে। কিছু কিছু ব্যাংকে ছাঁটাইয়ের ঘটনাও ঘটছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, নানা সতর্কতামূলক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও ২০১৪ সালে দেশের ব্যাংকিং খাত ঋণ-চাহিদার ধীর প্রবৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, একাধিক ব্যাংকের কয়েকটি বড় গ্রুপে বিনিয়োগ, একই খাতে অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ, ঋণগ্রহীতাদের রেটিং নেওয়ার ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখানো এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলগুলোর ব্যবহার না হওয়ার মতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে ব্যাংকিং খাতকে। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা কম থাকায় সরকারি ব্যাংকে অনিয়ম হয়েছে। এর বাইরে ২০১৫ সালে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে কমে গেছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যাংকিং খাতে সম্পদের বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন অ্যাসেট) ও শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানার বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন ইকুইটি) দুটোই নিম্নমুখী। বিপরীতে বেড়েছে মূলধনের অনুপাতে খেলাপি ঋণ। এ তিনটি সূচকের নিম্নমুখি প্রবণতা ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা কমার ইঙ্গিত দেয়।

বিনিয়োগের মন্দায় ব্যাংক যে সুদে আমানত নিয়েছে, তার চেয়ে কম সুদে ঋণ দিতে পারছে না। নামমাত্র আয় করার জন্য ওইসব আমানতের অর্থ এখন সরকারি বিল বন্ডে বিনিয়োগ করে রাখছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু আমানতকারীদের দিতে হচ্ছে চুক্তি অনুযায়ী মুনাফা। ফলে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহ ও সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ থেকে নিট মুনাফার পরিবর্তে লোকসান হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের ভাষায় অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংকগুলোর জন্য ‘মধুর সংকট’। বর্তমানে এই খাতে অলস অর্থ রয়েছে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার মতো।

২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস কেটেছে হরতাল-অবরোধে। এ সময় বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সম্মেলন যথাসময়ে করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। একপর্যায়ে দৈনিক লেনদেন নেমে আসে প্রায় ৩০ শতাংশের নিচে। এরপর লেনদেনে কিছুটা গতি এলেও বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটেনি। কিছু ব্যাংক টিকে থাকার লড়াইয়ে আগ্রাসী ব্যাংকিং শুরু করে। অনেকে জড়িয়ে পড়েছে নানা আর্থিক কেলেঙ্কারিতেও। অনিয়ম করে ঋণ দিতে গিয়ে বেড়ে গেছে খেলাপির পরিমাণ। আর এই খেলাপি কমাতে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। যা এ খাতের মোট ঋণের ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। জুন শেষে এ খাতে খেলাপি ছিল ৫২ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। এই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে ২ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৯ মাসের ব্যবধানে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকের মোট ঋণের ২৪ দশমিক ৬৪ শতাংশই এখন খেলাপি। এর পরে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৮৪ শতাংশই খেলাপি ঋণ। বিদেশী ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ রয়েছে মোট ঋণের ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপিদের বিশেষ ছাড় দিয়ে আরেকটি অন্যয়কে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালকে ব্যাংকিং খাতের জন্য হতাশার বছর উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বছর ব্যাংকিং খাতে মুনাফা কম হয়েছে। ব্যাংকের কর প্রদানের পরিমাণ কমেছে। করপোরেট গভর্নেন্সের উন্নতি হয়নি।

এদিকে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে ‘ব্যাংক মেলা’র আয়োজন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনিয়ম কমাতে ১১টি ব্যাংকে পর্যবেক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নভেম্বর মাসে সরকারি ৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসানো হয়। এর আগে সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক বসানো হয়। এ ছাড়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে পরিবর্তিত আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে বসানো হয়েছে পর্যবেক্ষক। সব মিলিয়ে ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি ব্যাংকেই পর্যবেক্ষক রয়েছে। এ ছাড়া প্রক্রিয়ায় রয়েছে নতুন ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে ব্যাংকের আয় কমে গেছে। কারণ ব্যাংকের আয়ের বড় অংশই আসে ঋণ বিতরণ থেকে। এ ছাড়া আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে ধীরগতির কারণেও কমেছে সুদবহির্ভুত আয়। তবে এসব কিছুর মূলেই রয়েছে ব্যবসায় বাণিজ্যে স্থবিরতা।

তবে বাংলাদেশ বলছে, ব্যাংকিং খাত এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও রেসিলিয়েন্ট বা ঝুঁকিবহনে সক্ষম। ব্যাংকিং খাতের সূচকগুলো দিন দিনই শক্তিশালী হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী কিনা তার অন্যতম পরিমাপক হচ্ছে মূলধন পর্যাপ্ততা। ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা সংক্রান্ত ব্যাসেল-২ নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পর এ বছর (২০১৫) থেকেই ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করার পথ-নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় জুন ২০১৫ শেষে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ছিল ১০.২৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে এ হার দাঁড়িয়েছে ১০.৫৩ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক মানদ- ৮ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণের হার এক অংকের নিচে রাখা সম্ভব হয়েছে। ডিসেম্বর ২০১৪ ও মার্চ ২০১৫ শেষে শ্রেণিকৃত ঋণের হার ছিল যথাক্রমে ৯.৬৯ ও ১০.৪৭ শতাংশ। জুন ২০১৫ শেষে শ্রেণিকৃত ঋণের হার কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৬৭ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন কভারেজ ৯৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একইভাবে আন্তঃব্যাংক কলমানি রেট দীর্ঘদিন ধরে ৫ শতাংশের নিচে/কাছাকাছি অবস্থান করছে। ২০ ডিসেম্বর কলমানি সুদের গড় হার ছিল ৪.০৭ শতাংশ যা ব্যাংকিং খাতে পর্যাপ্ত তারল্য, স্থিতিশীল মুদ্রাবাজার ও সুশাসন উন্নয়নের পরিচায়ক।

আমানত ও ঋণের সুদহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় নজরদারী এবং ব্যাংকগুলোর ওপর নৈতিক চাপ অব্যাহত রাখায় আমানত ও ঋণের গড় সুদহার কমে অক্টোবর ২০১৫ শেষে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৬.৫৮ ও ১১.৩৫ শতাংশ। আমানত ও ঋণের সুদহারের স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪.৭৭ শতাংশ। এই স্প্রেড মূল্যস্ফীতি নিম্নগামী হওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ও ক্রমান্বয়ে কমছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৭.৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে (২০ ডিসেম্বর ২০১৫) তা সাড়ে তিনগুণের বেশি বেড়ে ২৭.৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা দিয়ে দেশের আট মাসের মতো আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখছে। বৈদেশিক অর্থনৈতিক খাতের এই শক্তির জোরেই বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে।

/এফএ/আপ-এফএস/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়