X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

'টার্গেট কিলিং'

ড. শাখাওয়াৎ নয়ন
২৬ জুন ২০১৬, ১২:২৭আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০১৬, ২২:১০

শাখাওয়াৎ নয়ন বাংলাদেশে এখন নিরাপদে আছে কে? হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীদের কথা না নয় বাদই দিলাম। কবি, লেখক, ব্লগার, পুরোহিত, যাজক, সংস্কৃতিমনা সেতার বাজানো সাহিত্যের শিক্ষক, অংকের মাস্টার- তাদেরকেও বাদ দিলাম। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীও তো খুন হচ্ছেন, সামরিক কর্মকর্তার মাও খুন হচ্ছেন। তাহলে নিরাপদে আছে কে? কেউ নিরাপদে নেই। কারণ যে কেউ যে কোনওদিন ‘টার্গেটেড কিলিং’-এর শিকার হয়ে যেতে পারেন। কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছে, কেউ জঙ্গিদের কাছে অসহায়।          
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নাগরিক জীবনে এতখানি অনিরাপত্তাবোধ আর কখনও সৃষ্টি হয়নি। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা রাতের অন্ধকারে সহায়-সম্বল ফেলে শুধু প্রাণটা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবীরা ভিনদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করছেন। কিংবা সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। যারা প্রবাসে আছেন, তারা দেশে যেতে ভয় পান- অনেকে গোপনে দেশে যাচ্ছেন, কাউকে জানাচ্ছেন না; নিজ দেশে মানুষ এভাবে যায়? আমরা কি কোনও করোদ রাষ্ট্রের নাগরিক? আমাদের করোদ করলো কে বা কারা? কেন করলো? আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে, স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে দিচ্ছে কারা? এমনটা হচ্ছে কেন? 
আমি বলছি না যারা দেশ চালাচ্ছেন, তারা এই সমস্যা সমাধানের কোনও চেষ্টা করছেন না। তারা চেষ্টা করছেন কিন্তু তাদের সেই চেষ্টায় ত্রুটি আছে; তাদের পরিকল্পনায় দুর্বলতা এবং তা বাস্তবায়নে অসামর্থ্যতা আছে। যদি তা না থাকতো, তাহলে এই সমস্যা সমাধানে এত দিনে কিছু না কিছু সফলতা আমরা দেখতে পেতাম। দেশের মানুষ অসম্ভব রকমের ভীতির মধ্যে আছে; হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ দরকার। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের নাগরিক জীবনে প্রধান সমস্যা ‘টার্গেটেড কিলিং’। প্রশাসন ঠেকাতে পারছে না; সত্যিকার অর্থে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠেকানো খুব কঠিন। আমাদের নীতি-নির্ধারকদেরকে জঙ্গি সমস্যা এবং ‘টার্গেটেড কিলিং’ সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে।         
যদিও ‘টার্গেটেড কিলিং’ বলতে অধিকাংশ মানুষ শুধু নানা রকম জঙ্গিগোষ্ঠীদের দ্বারা সংগঠিত হত্যাকাণ্ডকেই বুঝে থাকেন। ব্যাপারটি কিন্তু আসলে তা নয়। খুব সংক্ষেপেও যদি বলি- তাহলে বলা যায় ‘টার্গেটেড কিলিং’ প্রধানত দুই রকম- (১) সরকারি সংস্থাকর্তৃক পরিকল্পিতভাবে হত্যা (২) বেসরকারি সংঘ/দল/সংগঠন কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে হত্যা। বাংলাদেশে সরকারি সংস্থা বলতে পুলিশ, র‍্যাব কিংবা অন্যান্য এলিট ফোর্স কতৃক হত্যাকাণ্ড; ইসরায়েলের মোসাদ, যুক্তরাষ্ট্রের এফবিএই, সিএইএ কিংবা তাদের বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক হত্যাকাণ্ড। ইদানীংকালের ড্রোন হামলাও ‘টার্গেটেড কিলিং’ এর অন্তর্ভুক্ত।   
আমরা যদি এই ‘টার্গেটেড কিলিং’ সম্পর্কে একটু অতীতের দিকে নজর দেই তাহলে দেখবো-- দক্ষিণ আমেরিকায় ‘ডেথ স্কোয়াড ইন এলসালভাদর’, নিকারাগুয়া, কলোম্বিয়া, এবং হাইতিতে ১৯৮০-৯০ এর দশকে ‘সিভিল আনরেস্ট’ এর নামে প্রচুর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আফ্রিকার সোমালিয়া, বুরুন্ডি এবং রুয়ান্ডাতে, ইউরোপের বলকান অঞ্চলে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল আর্মি এবং দ্বিতীয় ইন্তেফাদা আন্দোলনে, বৈরুতে হিজবুল্লাহ গেরিলারা, নিকট অতীতের আল-কায়দা, এখনকার আইএস, টুইন টাওয়ার ধ্বংস কিংবা লাদেন হত্যাকাণ্ড সবই ‘টার্গেটেড কিলিং’। শুধুমাত্র দেশ-কাল-পাত্র ভিন্ন।
এই ধরনের ‘টার্গেটেড কিলিং’ এর জন্য অনেকে শুধুমাত্র ধর্মকেই দায়ী করে থাকেন। কিংবা ধর্মীয় জঙ্গিদেরকে দায়ী করেন- আসলেই কি তা ঠিক? না, ঠিক না।  যে কোনও আদর্শবাদই এই ধরনের ‘টার্গেটেড কিলিং’ এর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। আমরা দেখেছি- ইরানে, ইরাকে, আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে কিংবা সিরিয়ায় ধর্মীয় আদর্শবাদের কারণে রক্তপাত। আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশে এক সময় শ্রেণিশত্রু খতম করার নামে প্রচুর ‘টার্গেটেড কিলিং’ হয়েছে। বর্তমানের হত্যাকাণ্ডসমূহ সেসব হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা না হলেও রক্তপাতের ধারাবাহিকতায় আজও বাংলাদেশে রক্ত ঝরছে।

বাংলাদেশের মানুষ ‘শ্রেণিশত্রু’ খতম করতে দেখেছে, রক্ষীবাহিনীর কর্মকাণ্ড, জিয়াউর রহমানের পাইকারি হারে কোর্ট মার্শাল, এরশাদ আমলের হত্যাকাণ্ড, খালেদা জিয়ার ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ এবং বাংলাভাইয়ের জেএমবি, শেখ হাসিনার ‘ক্রসফায়ার-বন্দুক যুদ্ধ’ এবং জঙ্গিদের চাপাতি হত্যাকাণ্ড দেখেছে। সব কিছু ছাপিয়ে এখন জঙ্গি সমস্যা প্রধান ইস্যু হয়ে গেছে। সংবাদে প্রকাশ, জঙ্গি সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে- জঙ্গি আসলে কে? জঙ্গিরা কার পেটে জন্মায়? কেন জন্মায়? জঙ্গিরা কোথায় থাকে? সে কি কেবলই বন্দুকের নলের সামনে দৌড়ায়? নাকি অশরীরী ভুতের মতো পেছনেও থাকে? নাকি কতিপয় মিডিয়ায় ‘দুর্বৃত্ত’ নামে ইনভার্টেড কমা’র মধ্যে ঝুলে থাকে?  

রাজনীতি বন্ধুর মধ্যে শত্রু খুঁজে বের করে, শত্রু না থাকলে উৎপাদন করে; কারণ একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তার খুব প্রয়োজন; উমবারতো একো’র একটা বই আছে ‘ইনভেন্টিং দ্যা এনিমি’। বইটির পাঞ্চলাইন হলো- ‘অ্যাভরি কান্ট্রি নিডস এন এনিমি অ্যান্ড ইফ ইট ডাজন্ট হ্যাভ ওয়ান, মাস্ট ইনভেন্ট ইট’।  বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে ভয়ংকরভাবে এই কাজটি করা হয়েছে; শত্রু উৎপাদন কিংবা খুঁজে বের করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। উক্ত কারণে বাংলাদেশ এখন ‘দোজখপুর নিয়ামত’ এ পরিণত হয়েছে। পুরো জাতি ভয়ংকর বিপদে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র মাথাপিছু আয় নির্ভর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ফ্লাইওভার কিংবা সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করেই কিন্তু স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা যাবে না। মুহূর্তেই সব কিছু বালির বাঁধের মতো ভেঙ্গে পড়বে। কারণ আজকের বাংলাদেশ আস্ত একটা সাম্প্রদায়িক বোমার ওপর বসে আছে। এখন যা কিছু রক্তপাত হচ্ছে, তা আসলে কিছুই না। এই বিরাট বোমাটি বিস্ফোরণের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। একদিকে কবি-লেখক-ব্লগার-যাজক-পুরোহিত-শিক্ষক-বাউলদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। অন্যদিকে জঙ্গিরা কথিত বন্দুকযুদ্ধের ক্রসফায়ারে জীবন দিচ্ছে। আসলে তো সবই রক্তপাত, রক্তের রঙে কি কোনও পার্থক্য আছে? প্রাণের স্পন্দনে? চোখের বদলে চোখ নেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাহলেই সব ধরনের রক্তপাত বন্ধ হবে, নইলে কেউ নিরাপদে থাকতে পারবে না। সুতরাং রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে, বিলম্ব হওয়ার আগেই।   

লেখকঃ একাডেমিক, কলামিস্ট এবং কথাসাহিত্যিক

আরও পড়তে পারেন: মিতু হত্যাকাণ্ড: বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদশ্বাসরুদ্ধকর ১৬ ঘণ্টায় যা ঘটলো

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ