X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজউকের উচ্ছেদ: ত্রুটিপূর্ণ নীতি, ভুল সময়

কাজী ইনাম আহমেদ
০২ আগস্ট ২০১৬, ১৭:১১আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০১৬, ২১:৩৪

কাজী ইনাম আহমেদ সরকারের চলমান উচ্ছেদ অভিযানে বেশকিছু ত্রুটি রয়েছে। এর থেকেও ভালো বিকল্প হতে পারত।
সমগ্র বাংলাদেশ যখন ১ জুলাইয়ের গুলশান হামলার ঘটনায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন সরকার তার জবাব দিলো এক অভূতপূর্ব শক্তিতে। নিরাপত্তাবাহিনী দেশব্যাপী তল্লাশি চালাচ্ছে, সন্দেহভাজনদের আটক করছে, জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালাচ্ছে। সরকার এবং নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশ পুরো সমাজকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর করার চেষ্টা করছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ১ আগস্ট সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন করেছে। এসবই এক অভূতপূর্ব নিদর্শন বহন করে।
রাজউক সন্ত্রাসী হামলাকে সামনে রেখে সর্বাত্মক উচ্ছেদ অভিযান চালাতে এই সময়টিকেই বেছে নিল। বিশ্বব্যাপী আমরা বিভিন্ন সরকারকে আক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও সেক্টরের পাশে দাঁড়াতে দেখতে পাই। তবে রাজউকের এই অভিযান এর ঠিক বিপরীত। তারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্র: ছোট দোকান ও রেস্তোঁরা, যারা উচ্ছেদ না হয়েই টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছিল, তাদের ওপরই আঘাত হানল।
আমরা সকলেই অনুভব করি, আবাসিক এলাকায় লাগামহীন বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। তবে তাদের সামগ্রিকভাবে উচ্ছেদ করে অথৈ সাগরে ফেলে দেওয়াটা সমর্থনযোগ্য নয়, যা সরকারি সংস্থাগুলো বছরের পর বছর করে থাকে। সেই সঙ্গে নগরে পর্যাপ্ত বাণিজ্যিক স্থান নির্দিষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে রাজউক। রাজউক এখন তার ব্যর্থ পরিকল্পনার জন্য উদ্যোক্তাদের শাস্তি দিচ্ছে।

এই প্রক্রিয়ায়, রাজউক ছোট খাবারের দোকান, স্যালুন, কিন্ডারগার্টেন, ছোট মুদির দোকান, এগুলো নগর জীবনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। এসব কেবল মানুষের প্রতিদিনের হাঁটাপথের দূরত্বে থাকবে এমন নয়, বরং ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার যুগে তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হলে নিজেদের মধ্যে বন্ধন গড়ে উঠবে। এক রাতে তাদের উচ্ছেদ করা হলে, কমিউনিটির এইসব উপাদান আর থাকবে না।

দীর্ঘ সময় ধরে চলা ওই উচ্ছেদ নীতি নগরীকে আক্রান্ত করেছে, যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভয়াবহ কাল থেকেই পর্যায়ক্রমে চলছে। আর এর ফলে যেসব সমস্যা সামনে আসে, তা এখানে তুলে ধরা হলো –

১। ভুল সময়ে, ভুল অজুহাত: কোনও রেস্তোঁরা অনুমোদিত হোক বা না হোক, সন্ত্রাসী হামলার ক্ষেত্রে এটা কোনও কারণ নয়। সন্ত্রাসীরা হামলার জন্য নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার, মুম্বাইয়ের তাজ ও ওবেরয় হোটেল এবং সিডনির লিন্ড ক্যাফের মতো সম্ভ্রান্ত এবং প্রতীকি স্থান বেছে নেয়। ঢাকার বিদেশি এবং স্থানীয়দের মধ্যে হলি আর্টিজান বেকারির একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আর এজন্যই সন্ত্রাসীরা একে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। আর তাদের উদ্দেশ্য কাজ করছে- অনেকের বিদেশিরা চলে যাচ্ছেন, টেক্সটাইল ক্রেতারা কেবল বিদেশেই বৈঠক করছেন, আর দূতাবাস থেকে তাদের কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের চলে যেতে বলা হচ্ছে।

২। বেকারত্ব বৃদ্ধি: যখন এই ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো বন্ধ করার সময় একদিনের নোটিশও দেওয়া হলো না (রাজউকের দাবি, তারা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল), তখন বহু তরুণকে চাকরি হারাতে হলো। সরকারকে স্বীকার করতেই হবে যে, এই তরুণরা, যারা ওইসব দোকানে ওয়েটার, বাবুর্চি, নাপিত, বিক্রয় কর্মী এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করত, তারা নিজেদের জেলায় বা গ্রামে ফিরে গিয়ে এই মানের কাজ পাবেন না। তারা এখন এক ধরনের ব্যবসা করতে শিখেছে, আর বাড়িতে তাদের পরিবার তাদের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে।

৩। উদ্যোক্তা বিনিয়োগ বিপন্ন: ৭০, ৮০ এবং ৯০-এর দশকে কেউ ৩০/৪০ লাখ টাকায় একটি কারখানা, আবাসন কোম্পানি বা সরকারের সংযোগ পেতে পারতো। কিন্তু এ সময়ে ওই ছোট পুঁজি নিয়ে তরুণরা বৃহৎ সেক্টরে প্রবেশ করতে পারেন না। তাই সামনে রয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসা: ক্যাফে, বুটিক, খাবার সরবরাহ, আইটি এবং মার্কেটিং কোম্পানি, যেখানে তরুণ উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারেন। বাণিজ্যিক এলাকার ভাড়া বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আউটলেট এবং অফিসগুলো থাকে আবাসিক এলাকায়। এই উদ্যোক্তারা তাদের সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন, যা তারা এতদিনে গড়ে তুলেছেন।

৪। তরুণরা কোথায় যাবেন? ছোট ক্যাফে, যেখানে তরুণরা বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারবে – ঢাকা শহরের তরুণ প্রজন্মের জন্য এমন যাওয়ার জায়গা দরকার। অন্যান্য মেগাসিটির তুলনায় রাজধানী ঢাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক পার্ক, মাঠ বা সর্বজনীন স্থান নেই। এখন বাচ্চারা কোন নিরাপদ স্থানে যেতে পারে? বিশেষত এমন এক সময়ে যখন আমরা এ নিয়ে আলোচনা করছি, কিভাবে তরুণরা সহজেই উগ্রবাদীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

বাণিজ্যিক এলাকার কোনও মানে হয় না। বেশিরভাগ বড় নগরীতেই বিশুদ্ধ আবাসিক এলাকা বলতে কিছু থাকে না। ১৯৫০-এর দশকে ধানমণ্ডি দেখতে অনেকটা আজকের পশ্চিমা শহরতলীর মতোই ছিল। আমরা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর আবার সেই আদি বাস্তবতায় ফিরতে পারব, এমনটা মনে করাটা হাস্যকর। যদিও এমনকি যারা পরিবেশবাদের নামে অভিযান চালান, তারাও এই ধারাটিকেই সামনে তুলে ধরেন – তারা এসব আবাসিক এলাকায় অফিস ভাড়া দেওয়ার বিরুদ্ধে। 

আমরা উদ্ভট ধারণার ভিত্তিতে নীতি গ্রহণ করতে পারি না। বাস্তবে আমাদের দুটোর ‘মিশ্রিত ব্যবহার’ প্রয়োজন। কোনও গ্রাহকই গুলশান বা ধানমণ্ডি থেকে এক কাপ কফি খেতে, অথবা চুল কাটাতে, কিংবা কারও শিশুকে ডে-কেয়ারে দিতে নিশ্চয় বাড়ি থেকে আট কিলোমিটার দূরে পূর্বাচলে যাবেন না।

হলি বেকারির মালিকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবাটাও ভ্রান্তিকর। ১ জুলাইয়ের আগে তারা সঠিক থাকলেও, হামলার ফলে এখন তারা কোনও কিছুরই উপযুক্ত নন, তারা রাষ্ট্র এবং সমাজ কারও সমর্থন পাচ্ছেন না।

রাজউকের এই সময় নির্বাচনটা এর থেকে বাজে হতে পারত না। এই উচ্ছেদ এখনই বন্ধ হতে হবে, আর তা তখনই পুনরায় শুরু হতে পারে, যখন একটি আরও যৌক্তিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হবে। সন্ত্রাসী হামলার পর নগরী একটি শোকাবস্থার মধ্যে রয়েছে। নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জীবনকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই আস্থা দেওয়ার বদলে রাজউকের পরিকল্পনা কেবল অস্থিরতা এবং ভয়ই যুক্ত করছে। 

লেখক: পরিচালক, বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সুপারমার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগঅ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
চ্যাম্পিয়নস লিগঅবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ