X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইয়াসমিন থেকে রিশা হত্যাকাণ্ড: দায় কার?

রাশেদা রওনক খান
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:১৪আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৮:০৮

রাশেদা রওনকআমাদের স্বর কি নিজ থেকেই স্তিমিত? পাঠক, মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? ইয়াসমিন, তনু, মিতু, আফসানা, সাথী, রিশা- এই সব নাম কেনইবা আমি একসঙ্গে উচ্চারণ করছি?  প্রত্যেকটা নামের সঙ্গে যে ঘটনা তার ভেতরের গল্পতো প্রতিটিই ভিন্ন, তবুও কেন একই ফ্রেমে বন্দী করতে চাইছি? আসলে এই ফ্রেমের ভেতরে জায়গা হবে আরও লাখো নির্যাতিত-ধর্ষিত কিশোরী কিংবা নারীর ছবি, যাদের আর্তনাদের স্বর আমাদের কান পর্যন্ত হয়তো পৌঁছায় না, কিংবা পৌঁছালেও আমাদের দৃষ্টি সেখানে যায় না!
এই ধরনের মৃত্যুর জন্য আসলে দায়ী কে? আমরা তো দেখেও দেখি না, শুনেও শুনি না! কিন্তু যে ঘটনাগুলো অন্তত আমাদের কানে আসে, আমাদেরকে একটু হলেও ভাবিয়ে তুলে, সেগুলোর বিচারের দাবিতে কি আমরা আন্দোলন-লড়াই করতে পারি না? সব কিছু স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার এই ‘স্বাভাবিকতার দৃশ্যপট’ পাল্টে ফেলতে পারি না? ফেসবুকের পাতায় কেবল নয়, রাজপথে বেরিয়ে আসতে পারি না? দিনকে দিন আমরা কেমন যেন নুয়ে পড়ছি, লক্ষ্য করছি কি? অথচ এই আমরাই তো একদিন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইয়াসমিন হত্যার বিচার পেয়েছি! তবে এখন কেন দমে যাই, থেমে যাই?
পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে, ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিনকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ধর্ষণের পর হত্যা করে। এ ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ। কেবল দিনাজপুর নয়, সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ইয়াসমিন হত্যার ঘটনায় তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় এবং প্রায় আট বছর পর ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে দোষীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেই ধরনের প্রতিবাদ কেন এখন আর আমরা করতে পারি না? কিছু কিছু ঘটনায় হঠাৎ একটি জ্বলে ওঠে, যেটা ইয়াসমিনের বেলায় হয়েছিল, যেটা তনুর বেলায় ঘটতে গিয়েও আর ঘটেনি, দমিয়ে দেওয়া হলো আন্দোলনের কণ্ঠস্বর! 

আচ্ছা, তনুর বেলায় পারিনি কেন? তনুও তো আমাদের নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তনু হত্যার বিচারের মধ্য দিয়েই আমরা অন্যান্য হত্যার লড়াইয়ের জন্য পথ তৈরি করব, এটাই আমাদের অঙ্গীকার ছিল! কাউকে না কাউকে যেমন নতুন পথ তৈরি করতে হয়, তেমনি কেউ না কেউ অন্যায়ের, বৈষ্যমের, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম-লড়াই এর ‘প্রতীক’ হয়ে ওঠে, যেমন হয়েছে একসময় ‘ইয়াসমিন’, আজ তেমনি ‘তনু’। কিন্তু আমরা কি শেষ পর্যন্ত পারলাম কিছু করতে তনুর জন্য? সাগর-রুনির জন্য? মিতু কিংবা আফসানার জন্য? কেন পারিনি?

তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেছিলেন, ‘২৬ মার্চ এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার আনতে যাওয়ার কথা ছিল তনুর। সেজন্য তনু মাকে দর্জির দোকানে হতে জামাটি নিয়ে আসতে বলে গিয়েছিল।’ এতটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যার পদচারণা, এতটা সংগ্রামী, মেধাবী মানুষ যার বড় হওয়ার অনেক স্বপ্ন ছিল, সেই কিনা মারা গেল কিছু অমানুষের অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়নে! আমাদের সবার এই দায় নিতে হবে, কারণ আমরাই কেউ কেউ এইসব নরপশুদের বিচার হতে দেই না, আমাদের মতো রক্ত মাংসের মানুষই তদবির করে ধর্ষক-খুনিকে বাঁচিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠি। বিচার কাজ ঝুলিয়ে রাখি দর্জির দোকানে তনুর সেই নতুন জামার মতো! 

ইয়াসমিনের বয়স ছিল ১৫, রিশার বয়স ১৪! গত বুধবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে কাকরাইলের ফুটওভার ব্রিজে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া রিশাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে ওবায়দুল নামের এক দর্জি। অন্যান্য কিশোরীদের ঘটনাগুলো মফস্বলের হলেও রিশার ঘটনাটি কেবল রাজধানী নয়, রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকায় ঘটে গেছে অনেক মানুষের ভিড়ে! রিশার হত্যাকারী খালি চোখে একজন মনে হলেও আসলে দুজন: একজন হলো মূল হন্তারক ওবায়দুল, এবং অন্যজন হচ্ছে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, যিনি বাচ্চারা অনেক বলার পরেও রিশাকে স্কুলের গাড়িতে হাসপাতালে পাঠাতে সম্মত হয়নি!  শিক্ষক হিসেবে আসলেই আমার খুব লজ্জা হচ্ছে, এটা লিখতে। রিকশায় করে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়ে যায় ছোট্ট এই মায়াবী মেয়েটি! কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি, তারাও কি পরাজিত হবো? 

রিশার মতোই সাথীর বয়স ছিল ১৪ বছর!  রিশার মতো সাথী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে না মারা গেলেও মানসিক নির্যাতন তাকে একই পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। চাঁদপুরের সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নের বাগাদী গণি উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্কুলের মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফিসহ ছিল ৪০০ টাকা। কেন ৪০০ টাকা ফি, এটাও আমাদের জানা দরকার! এই ৪০০ টাকার মাঝে  ৩২০ টাকা পরিশোধ করতে পেরেছিল সাথী, বাকি ছিল  ৮০ টাকা। সেটাও হয়তো জোগাড় করে ফেলতো কষ্টে-শিষ্টে তার বাবা-মা। কিন্তু তর যেন সয়নি না মুনাফালোভী বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিনের। এই ৮০ টাকার জন্য সাথীসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে রোদের মধ্যে এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখেন।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আমাদের আশা নিশ্চয়ই আপনি নিজে বিষয়টি তদারকি করবেন। যেখানে সরকার ২০১০ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধ করতে একটি পরিপত্র জারি করে এবং ওই পরিপত্রে সুস্পষ্টভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, সেখানে কী করে কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন যে, সেই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করার মতো নিষ্ঠুর একটা সিদ্বান্তে পৌঁছে যায়?

যেসব অমানবিক অর্থলোভী শিক্ষক কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করেন, সেইসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে আমাদেরই সোচ্চার হতে হবে এবং তার সময় এখনই! আজ সাথীর আত্মহত্যার জন্য যে শিক্ষক প্ররোচিত করেছে, তার যথার্থ বিচার যদি না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এমন অনেক ঘটনা আমাদের দেখতে হতে পারে। 

তবে তনুকে যারা ধর্ষণ ও হত্যা করেছে তারা নিশ্চয়ই আর যাই হোক পুলিশের সাধারণ ওসি পদমর্যাদার কিংবা সামান্য দর্জিও নয়! তারা এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের কাছে সাধারণের কণ্ঠ দমিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যেমন আছে, তেমনি পুরো ঘটনাটিকেই গায়েব করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে! ফলে ইয়াসমিনের ঘটনার বিচার নিশ্চিত হলেও ঝুলে আছে তনুর বিচারকাজ। ইতিমধ্যেই রিশার হন্তারক দর্জি ওবায়দুল ধরা পড়ে গেছে, কারণ সামান্য দর্জির প্রতিহিংসুক মন অনেক দানবীয় হলেও শ্রেণি বিচারে এই ঘাতক নিশ্চয়ই মিতু, আফসানা কিংবা তনুর হন্তারকদের মতো এতটা শক্তিশালী নয় যে, ‘তাকে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা’! 

এই মুহূর্তে আমাদের একমাত্র চাওয়া- বাংলাদেশের সকল নারী নিরাপদে থাকুক এবং সেজন্য যেসব নারী নির্যাতিত, নিপীড়িত, ধর্ষিত এবং হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে, সেসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে সবার আগে, তা সে যে শ্রেণি-বর্ণ-গোত্র কিংবা বাহিনীরই হোক না কেন! যারা এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের সমর্থন করেন তারা আসলে ঘাতকদেরই ভিন্নরূপ কেবল। আর আমরা যারা চুপ থেকে ঘটনাগুলোর নীরব দর্শক, তারা আসলে নিজের দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে চলছি! তাই নীরবতা ভেঙে এইসব হত্যাকাণ্ডের বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের সরব হতে হবে, আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, তারুণ্যের আন্দোলন-বিপ্লব কোনও চক্রান্তের কাছে হেরে যাওয়ার জন্য নয়!

কবির ভাষায়- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। চলুন, প্রতিবাদের মিছিল গড়ে তুলি আরও একবার!

এবার আসি রাষ্ট্রের দায় প্রসঙ্গে। ওবায়দুল ধরা পড়েছে সেইজন্য রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ এবং তাকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেছেন একজন মাংস বিক্রেতা! একটা বিষয় খুব স্পষ্ট যে, এই মুহূর্তে  বাংলাদেশে কেউ এই ধরনের পৈশাচিক অপরাধ করলে কোনোভাবেই পার পাবে না। বিশেষ করে জঙ্গিদের আস্তানা যেভাবে ধীরে ধীরে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে আমাদের পুলিশবাহিনী, স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওপর আমাদের আশা-ভরসা দিন দিন বেড়েই চলছে এবং  সাধারণের সঙ্গে আস্থার জায়গা তৈরি হচ্ছে।

সরকার প্রধান হিসেবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখন বিশ্বসেরাদের তালিকার প্রথমদিকে! কিন্তু বাংলাদেশের এই তরুণ প্রজন্ম তাকে দেখতে চায় বিশ্বসেরাদের শীর্ষে!  তাই যে মানুষটি হাজারো কিশোরীকে প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখাচ্ছেন একজন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার, একজন স্পিকার হওয়ার, সংসদ উপনেতা হওয়ার, সবচেয়ে ক্ষমতাধর মন্ত্রণালয়গুলোর মন্ত্রী হওয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, সচিব, বিচারপতি হওয়ার, বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক হওয়ার, সেনা-বিমান-নৌ-পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদে আসীন হওয়ার, সেই মানুষটি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না, তা আমরা বিশ্বাস করি না! নারীর ক্ষমতায়ন যে দেশে এভাবে দুর্বার গতিতে হচ্ছে, সেখানে সাগর-রুনি, তনু, আফসানা, মিতু, রিশার হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শ্লথ গতিতে চলবে, তা হতে পারে না। তাছাড়া ইয়াসমিন হত্যার বিচার চেয়ে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সেসময় আমাদের উত্তাল আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, আজও তিনি ঠিক একইভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন, এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।

পরিবারের ‘আমি ও আমরা’, সমাজের ‘আপনি ও আপনারা’, এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যখন একযোগে কাজ করবে, তখন আর একটি কিশোরীও অনিরাপদ থাকবে না।  

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও খবর: পরিচয় এখন ‘রিশাদের বাড়ি’

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষ জানালেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষ জানালেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি আবোল-তাবোল বলছে: হাছান মাহমুদ
ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি আবোল-তাবোল বলছে: হাছান মাহমুদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ