X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিল্পী ও কলাকুশলীদের আন্দোলন এবং একটি স্বপ্ন

রবিউল করিম
১৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৩৮আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৫৩

রবিউল করিম ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন (FTPO) ‘শিল্পে বাঁচি, শিল্প বাঁচাই’ স্লোগানকে সামনে রেখে গত ৩০ নভেম্বর ৫টি ও ৪ ডিসেম্বর ৮টি দাবি জানিয়েছে। সব ক’টি দাবিই হয় টেলিভিশন কিংবা সরকারের কাছে। এই দাবিগুলো নিয়ে ৮ ডিসেম্বর বাংলা ট্রিবিউনের কলাম বিভাগে ‘শিল্পী-কলাকুশলীদের আন্দোলন ও কিছু কথা’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সে লেখায় মূলত তাদের দাবিগুলো নিয়ে বিস্তারিতভাবে আমার মতামত তুলে ধরি।
এবার দ্বিতীয় কিস্তিতে তুলে ধরতে চাই শিল্পী ও কলাকুশলীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আমার স্বপ্ন এবং একই সঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নিয়ে সরকার কী কী ব্যবস্থা নিতে পারেন। জানি না আমার সেই স্বপ্নযাত্রায় আপনারা শামিল হবেন কিনা? তবু স্বপ্ন দেখতে তো কোনও বাধা নেই, স্বপ্নের অনেক অসঙ্গতি থাকে, এটা জেনেও একটি স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি। অতীত আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, একার স্বপ্ন যখন সবার হয়ে যায়, তখন  সম্মিলিত স্বপ্ন কখনোই স্বপ্ন থাকে না, বাস্তব হয়ে যায়। যদি তাই হয়,  শিল্পী ও কলাকুশলীদের যে আন্দোলন, আমাদের টেলিভিশন শিল্পের যে পশ্চাৎপদ যাত্রা, শিল্পের জন্য হাহাকার, তা অনেকখানি লাঘব হবে বলে বিশ্বাস করি।
2011 Nielsen Media and Demographic Survey-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৪শতাংখ শহুরে ও ৪৩শতাংশ গ্রামাঞ্চলের মানুষের টেলিভিশন এবং ৮৩ শতাংশ শহুরে ও ৩৯শতাংশ গ্রামাঞ্চলের মানুষের টেলিভিশনে স্যাটেলাইট বা কেবল কানেকশন আছে। উইকিপিডিয়ায় ‘বাংলাদেশ’ নামক তথ্যভাণ্ডারের ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রধান প্রধান শহরাঞ্চলে মোট জনসংখ্যা (ঢাকা, চট্রগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, টঙ্গি, রাজশাহী, বগুড়া, বরিশাল, কুমিল্লা, রংপুর, ময়মনসিংহ) ১৩ কোটি ৫৮ লাখ ৬ হাজার ৭২ জন। অর্থাৎ ১১ কোটি ২৭ রাখ ৬ হাজার ৪৩৯ জনের স্যাটেলাইট কানেকশন আছে। মোট জনসংখ্যা তথ্যানুসারে ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭ থেকে ১৩ কোটি ৫৮ লাখ ৬ হাজার ৭২ বাদ দিলে ১৩ কোটি ৪ লাখ ৫৭ হাজার ৬২৫ জনের ৩৯ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ কোটি ৮ লাখ ৭৮ হাজার ৪৭৩ জনের কানেকশন আছে। তাহলে মোট কানেকশন আছে ৬২ কোটি ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯১২ জনের । ৫ জনের খানা হলে ১২ কোটি ৪৩ লাখ ৯ হাজার ৮২৪ জনের বাড়িতে টিভি আছে। লক্ষ করবেন, এখানে ৬৪টি জেলা শহরের অনেক নামই কিন্তু অন্তর্ভুক্ত হয়নি। মাত্র ১২টি শহরের জনসংখ্যার ভিত্তিতেই ১২ কোটি ৪৩ লাখ৯ হাজার ৮২৪ টি কানেকশন।

নিশ্চয়ই এই সংখ্যাটা ২০১৬ তে এসে অনেক বেড়েছে। উল্লিখিত তথ্যের আলোকে ধরে নিতে তো বাধা নেই যে, প্রায় ৩ কোটি টেলিভিশনে কেবল কানেকশন আছে এবং প্রতি মাসে এ বাবদ প্রতিটি কানেকশন বাবদ ১৫০-৫০০ টাকা দিতে হয়। এখন প্রস্তাবটি হচ্ছে, যদি এই ৩ কোটি গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতি মাসে কেবল অপারেটররা যে টাকা আদায় করে সেখান থেকে ১০ টাকা করে আদায় করা। কেননা, তারা তো কোনো চ্যানেলকে কোনও অর্থ  দেয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পে-চ্যানেল বলে একটা সিস্টেম চালু আছে। গ্রাহক যে যে চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করবে, তাকে সেই চ্যানেলের নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশে সেই সিস্টেম চালু নেই, আর আমাদেরও সেই মানসিকতা তৈরি হয়নি যে, কোনও অর্থের বিনিময়ে দেশি চ্যানেল দেখার, সেহেতু এটাই একমাত্র উপায় হবে যে, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মান উন্নয়নের জন্য প্রতি কানেকশন বাবদ ১০ টাকা করে আদায় করা। এটাতে তারা সহজে মেনে নেবে না সত্য কিন্তু যদি আমরা ও সরকার, তাদের বাধ্য করি, তবে নিশ্চয় তা সম্ভব হবে। এর জন্য দরকার হলে শিল্পী ও কলাকুশলী, বুদ্ধিজীবী, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষসহ সব মহলকে একজোট হয়ে আন্দোলনে যেতে হবে, সরকারের সঙ্গে বসতে হবে, তাদের বোঝাতে হবে যে, এটা করলে দশের মঙ্গল, দেশের মঙ্গল। নিশ্চয় আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন বাংলাদেশের ডাউনলিংকে বন্ধ করে দিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই একটি উদ্যোগ নেবেন। ধরে নেই, ক্যাবেল অপারেটররা রাজি হলেন টাকা দিতে, তাহলে ৩ কোটি কানেকশন থেকে মোট ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ হবে। বর্তমানে দেশে ২৭ টি টেলিভিশন চালু আছে। তখন যা করতে হবে:

১. প্রত্যেকটি চ্যানেলকে ১ কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হবে ৬ মাস। শর্ত থাকবে যে, এই টাকা দিয়ে তারা অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধি করবেন। ৬ মাস পর এটি মূল্যায়িত হবে এবং যারা প্রথম ২০ টেলিভিশনের মধ্যে থাকবে তারাই শুধু এই টাকা পরবর্তী সময়ে পাবেন। অন্যদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। (নিউজ, মিক্সড সব চ্যানেলই টাকাটা পাবেন। নিউজ চ্যানেল ভালো ডকু ফিকশন বা উন্নত কারিগরি সাহায্যের জন্য টাকাটা ব্যয় করবে)

২. ৬ মাস পর থেকে প্রথম ১০ টি টেলিভিশন ১.৫ কোটি টাকা ও পরবর্তী ১০ টি টেলিভিশন ১ কোটি টাকা প্রণোদনা পেতে থাকবে।

এর ফলে টেলিভিশন শিল্পে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হবে। প্রতিটি টেলিভিশন এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে—এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কেউ নিশ্চয় শুধু ৬ মাস ১ কোটি টাকা করে নিয়ে বসে থাকবে না। সে চাইবে প্রতি মাসেই এই ১/১.৫ কোটি টাকা পেতে। ধরে নেই, মিক্সড টেলিভিশনগুলো এই টাকা শুধু নাটকের জন্য বরাদ্দ করলো। (অনেকেই বলতে পারেন, চ্যানেলগুলোকে বিশেষায়িত করে ফেলার, মিক্সড বলে যেন কোনও শব্দ না থাকে। কিন্তু আমি বলি, একবারেই সবকিছু পরিবর্তন করতে চাইলে হিতে বিপরীত হতে পারে।) ১ কোটি টাকাকে যদি ৩০ দিনে ভাগ করা হয়, তবে প্রতিদিন ৩ লাখ টাকার বেশি হয়। প্রতিদিন ২টি নাটক নির্মাণের জন্য তারা প্রত্যেক নির্মাতাকে ১.৫ লাখ টাকা করে প্রতি পর্বের বাজেট দেয়, একবার ভাবুন তো সিরিয়ালটি যদি ১০০০ পর্বের জন্য বানানো হয়, তবে তার বাজেট কত গিয়ে দাঁড়াবে? ১৫ কোটি টাকা। তখন নাটকের সেট, প্রপস, কস্টিউম, লোকেশন, আর্টিস্ট—এসব কী হবে ভাবতে পারেন? জি বাংলা, স্টার জলসার যে জৌলুস দেখে আমাদের দর্শকরা হা-হুতাশ করে বা সুলতান সুলেমান নিয়ে যে আদিখ্যেতা, তা হারিয়ে যাবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ৯০ লাখ টাকা নাটকের জন্য বরাদ্দ রেখে বাকি ১০ লাখ টাকায় ১টি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাণ করা যেতে পারে। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তো হারিয়েই যেতে বসেছে।

এসব কর্মযজ্ঞ চালাতে গেলে, সরকারকে একটি দফতর প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সেটা তথ্য বা অন্য কোনও মন্ত্রণালয়ের অধীনেও থাকতে পারে। যেখানে উন্নত প্রযুক্তির সব যন্ত্রপাতিসহ দক্ষ একদল কর্মী থাকবেন, যারা টেলিভিশনগুলো প্রতিনিয়ত মনিটরিং করবেন। সরকারের তথ্য, সংস্কৃতি, টেলি যোগাযোগসহ টেলিভিশনকেন্দ্রিক কয়েকটি মন্ত্রণালয়সহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, শিল্পী-কলাকুশলীদের দিয়ে একটি কমিটি এই দফতর পরিচালনা করবেন। তারাই প্রতি মাসে টেলিভিশনগুলোর মান পর্যালোচনা করে ক্রম নির্ধারণ করবেন। ব্যয় নির্বাহের জন্য এই দফতরকে প্রতিমাসে ১ কোটি করে ওই ৩০ কোটি টাকা থেকেই দেওয়া হবে।

এখানে যেটি সবচেয়ে কষ্টকর তা হলো, যে ৩০ কোটি টাকা নিয়ে এই পরিকল্পনা, সেই টাকাটা নিশ্চিত করা। টাকাটা তো তুলবেন কেবল অপারেটররা। তারা তো সঠিক হিসাব দেবেন না, এটা ধরেই নেওয়া যায়। তারা তো বলেন, দেশে ১ কোটিই গ্রাহক নেই। তাহলে কী দাঁড়াবে? সে ক্ষেত্রে যা করা যেতে পারে, প্রত্যেকটি শহরাঞ্চলে নির্বাচিত জনপ্রতিধিদের অর্থাৎ ওয়ার্ড কমিশনার এবং গ্রামাঞ্চলে মেম্বারদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। তারা তাদের এলাকার মোট কতটি কেবল সংযোগ আছে, তা এই দফতরে পাঠাবেন বা নতুন কোনও সংযোগ দিতে হলে কেবল অপারেটরদের তাদের অবহিত করতে হবে। এভাবে আমরা প্রকৃত কেবল গ্রাহকের সংখ্যা ও টাকা নিশ্চিত করতে পারি। সরকারকে এ বিষয়েই একটু প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে হবে। এটি শুধু একটি খসড়া প্রস্তাব। নিশ্চয় এ নিয়ে বিশেষজ্ঞমহলে যারা আছেন, তারা আরও বিস্তারিত এবং গঠনমূলক উদ্যোগ নিতে পারবেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, সম্মিলিতভাবে আমরা যদি এটি বাস্তবায়িত করতে পারি, তবে আজ টেলিভিশন শিল্পী ও কলাকুশলীরা, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ, মিডিয়াকর্মীরা যে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তা আর ভবিষ্যতে করতে হবে না। বিদেশের টেলিভিশনগুলো দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে না থেকে সবাই আমরা আমাদেরই দেশের টেলিভিশন দেখব। এই পরনির্ভরতার গ্লানি আর কতদিন? নিশ্চয় শিল্পী-কলাকুশলীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেধা প্রয়োগ করবেন। আমরাও দৃষ্টিনন্দন, মনোমুগ্ধকর  অনুষ্ঠান দেখতে টিভি সেটগুলোর সামনে আবারও ভিড় জমাবো। এই স্বপ্ন সত্য হতে দোষ কোথায়?

লেখক: অনুষ্ঠান প্রধান, দেশ টিভি

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ