X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আরোপিত মাতৃত্ব নারীর মহিমা নাকি দায়?

সাদিয়া নাসরিন
১৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:১৬আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:১৯

সাদিয়া নাসরিন কাঙালিচরণের বউ যশোদা পেশায় জননী। পঙ্গু স্বামীর সংসারে অর্থ উপার্জনের জন্য মাতৃত্বকে পেশা হিসেবে নিয়ে যশোদা বেছে নিয়েছিল হালদারবাড়ির নাতীদের দুধ খাওয়ানোর কাজ। কিন্তু পেটে সন্তান ধারণ করলেই তবে বুকে দুধ আসবে। তাই নিরন্তর মাতৃত্বই ছিল তার বাঁচার উপায়। তাই যশোদা সন্তান জন্ম দিয়ে যায়। হাতে গুনে জীবিত-মৃত বিশটা ছেলেমেয়ের মা। আবার বাবু বাড়ির বাঁধা দুধ-মা সে! তাই সবাই ‘মা যশোদা’ বলে ডাকে। মহিমার চাপে যশোদা কোনোদিন খতিয়ে দেখার সময় পায়নি মাতৃত্ব সে সইতে পারে কী পারে না! কিন্তু সব কিছুর শেষ আছে। যশোদার কোলের সন্তানের বয়স বাড়ে। বুকের দুধ ও একসময় শেষ হয়, শেষ হয় মাতৃত্বের। কর্তা বাড়ির ছেলেরা বড় হয়ে গেছে, তাই কাজও গেছে। তবু দুটো ভাতের জন্য পড়ে থাকে কর্তা বড়ির চাতালে। পঙ্গু কার্তিক অন্য বুকে ওম খুঁজে নিয়েছে আরও আগেই। নিজের ছেলেরা ও মা’র কাছে আসে না। নিজের বিশ আর কর্তা বাড়ির ত্রিশ, মোট পঞ্চাশজনকে স্তন পান করানো মহান মায়ের স্তন দুটোতে ক্যান্সারের পঁচন ধরে। মাতৃত্বের মহিমার ভারে নিস্তেজ হতে হতে যশোদা আপন মনে বলে, ‘দুধ দিলে মা হয়, স-ব মিছে কথা!’ যাদের পেটে ধরে দুধ দিয়েছে, ভাতের জন্য দুধ দিয়েছে কেউ কী আপন হয়েছে? মাতৃত্বের মহিমায় দেবী হয়ে উঠা যশোদা মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে জেনে গেল, ‘বিশ্বসংসারকে দুধে পাললে যশোদা হতে হয়। এ সংসারে মানুষ ঈশ্বর সেজে বসলে তাকে সকলে ত্যাগ করে এবং তাকে একলা নির্বান্ধবে মরতে হয়’। ( স্তন্যদায়ীনিঃ মহাশ্বেতা দেবী)
বিশ্বের সব নারীই মহাশ্বেতা দেবীর যশোদা-মা হয়ে ওঠে মাতৃত্বের মহিমা নিয়ে একলা নির্বান্ধব লড়াই করে। মাতৃত্বের গৌরবে নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে ভাবতে নারী আমরণ নির্বাসনের জীবন কাটিয়ে দেয় অন্তঃপুরে। কিন্তু সত্য বড়ো নির্মম হয়ে সামনে আসে স্বার্থে টান পড়লে। সেদিন সে দিব্যচোখে দেখতে পায় এই গৌরব আর মহান মাতৃত্ব পুরুষতন্ত্রের মধুর প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। আসল রাজনীতিটা হলো, নারীর স্বাভাবিক ও জৈবিক মাতৃত্বের ক্ষমতাকে প্রাতিষ্ঠানিক করার মাধ্যমে নারীর শরীর ও মাতৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করা। ‘নারীরা মায়ের জাত’ ‘মাতৃত্বেই নারীর স্বার্থকতা’ এই মিথগুলো মূলত সেই  রাজনীতির একটা অংশ মাত্র।

আসল রাজনীতিটা হলো, গর্ভধারণ ও স্তন্যদানের সঙ্গে সন্তান পালনের একচ্ছত্র দায় নারীর কাঁধে তুলে দিয়ে স্বাধীন উৎপাদনশীলতা থেকে পিছিয়ে নারীকে অন্তঃপুর নামক প্রাইভেট ডোমেইনে বন্দী করা, যার চালক পুরুষ। এই অনন্য রাজনীতির ঢিল দিয়ে এক সঙ্গে তিনটি পাখি মারা হয়। প্রথমত, মাতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক গঠন বা রজঃ এর জন্য অপবিত্র, অচ্ছুৎ ইত্যাদি বলে নারীকে পুরুষের অযোগ্য করে রাখা; দ্বিতীয়ত, মাতৃত্বের এই ক্ষমতার মধ্যেই নারীকে আটকে রেখে উৎপাদনশীলতা থেকে দূরে রাখা যাতে এতেই সে জীবনকে স্বার্থক মনে করে; তৃতীয়ত, এই ক্ষমতা যেন নারীকে কর্তৃত্ব দিতে না পারে সে জন্য সন্তান এবং সন্তান ধারণের গর্ভ দুটোই নিয়ন্ত্রণে রাখা। এই তিনটি ধাপ নিশ্চিত করেই কেবল ‘মা’ নাম দিয়ে নারীকে মহিমান্বিত করেছে পুরুষতন্ত্র।

নাড়ির টান বলে যে মিথ আছে তারও কোনও জৈবিক ভিত্তি নেই। যা আছে তার পুরোটাই হলো সন্তানের সঙ্গে মায়ের নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ আর মনোযোগে গড়ে তোলা সম্পর্ক। এখানে সন্তান জন্মদানের জৈবিক ক্ষমতার সঙ্গে সামাজিক ভাবে নির্মিত মাতৃত্বের ভূমিকাকে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। সন্তান ধারণ ও জন্মদানের জন্য নারীর জরায়ু আছে, যা পুরুষের নেই। কেবল এটুকুই ‘মা’ হওয়ার জন্য নারীর জৈবিক যোগ্যতা বা বাধ্যতা। এর বাইরে আর যে সব দায়িত্ব পালনের জন্য মাতৃত্বকে মহান করা হয়েছে তার সবটুকুই পুরুষ করতে পারে। কারণ সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য বা বাচ্চা পালন করার জন্য তো আর জরায়ুর প্রয়োজন নেই।

মাতৃত্বের কোনও জেন্ডার নেই কিন্তু। মাতৃত্ব মানে সন্তানকে স্নেহ দিয়ে, যত্ন দিয়ে শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে বিকাশপ্রাপ্ত হতে সাহায্য করা। তাই পুরুষরা ও মাতৃত্ব অর্জন করতে পারেন এবং সন্তানের সঙ্গে বাবার ও নাড়ির টান গড়ে উঠতে পারে। পৃথিবীতে প্রচুর একা বাবা আছেন যারা পূর্ণ মাতৃত্ব দিয়েই সন্তান বড় করছেন। আবার অনেক নারী আছেন যারা সন্তান গর্ভে না ধরে ও চমৎকার ‘মা’ হয়েছেন। পুতুল পালতে দিয়ে মেয়েকে যেভাবে মাতৃত্ব শেখানো হয়, সেভাবে কিন্তু একটি ছেলেকে ও মাতৃত্বের গুণাবলি শেখানো যায়। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, তিনি নিজেকে একজন ভালো মানবসন্তান হিসেবে তখনই মনে করবেন যখন তিনি মাতৃসুলভ গুণাবলি অর্জন করতে পারবেন।

পুরুষতন্ত্র নারীকে সেই মেয়েবেলা থেকে শিখিয়েছে সন্তান ছাড়া তার আর কিছু নেই, মহান মাতৃত্বেই নারীর স্বার্থকতা! যে ‘মা’ এতো মহান, সে মা তার নয় মাস গর্ভে ধারণ করা সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকারটুকুও পায়না কেন? মাতৃত্বেই যদি নারী স্বার্থক হয়, পূর্ণতা পায়, মহিমান্বিত হয়, তবে মায়ের একার পরিচয়ে কেন সন্তানের পরিচয় তৈরি হয় না? ঔরসদাতার পরিচয় না মিললেই কেন সেই মাতৃত্বের মহত্ব ঘৃণ্যতায় পর্যবসিত হয়? মানুষ ‘মা’ র ওপর হাজারো নির্যাতন, তাকে সন্তান ও সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার সব সব রকমের সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইনগত ব্যবস্থা পাকা করে সেই ‘মা’ কে দেবী বলে মহিমান্বিত করা প্রতারণা নয়? এই পৃথিবীর যা কিছু মহান, গর্বের, বীরত্বের, শৌর্যের তার সব কিছুই পুরুষ নিজের কব্জায় নিয়েছে। কিন্তু মাতৃত্বের মতো এতো সুবাসিত, মহিমান্বিত, বিষয় একা নারীর হাতে দিয়ে দিলো?  এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেলেই আপনি মাতৃত্বের মহিমার রাজনীতিটা বুঝতে পারবেন।

আসলে সম্মান আর মহত্বের পুঁজি খাটিয়ে যুগ যুগ ধরে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে পুরুষতন্ত্র। যে মাতৃত্ব ছিল নারীর নিজস্ব সম্পদ, তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তাতে সম্মান আর মহিমা লাগিয়ে নারীকে প্রসব ও সন্তান পালনে ব্যস্ত রেখে সে সুযোগে উৎপাদন ও অর্থনীতির চাবি করায়ত্ত করে নিয়েছে পুরুষ। মা’কে বলেছে সর্বংসহা। মা’কে বলেছে ধরিত্রী। যে মাটিকে মানুষ পায়ে পিষে, খুবলে তোলে, কোদাল চালায় সেই মাটির নামে নারীর নাম দিয়েছে ‘মা’। মায়ের জন্য যে সম্মান তা নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার গুণের জন্য। যেহেতু সে ধারণ করে, সে নিষ্পেষিত হয়, সে আঘাতে আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে দ্বিধা করে না, তাই মায়ের এতো মহিমা। এর জন্য নারীকে প্রস্তত করেছে শিশুকাল থেকেই পুতুলের সংসার দিয়ে। মেয়েশিশু পুতুলের মা হতে হতেই মাতৃত্বের বোধে অভ্যস্ত হয় এবং তার মনোজগতে একজন ‘মা’ তৈরি হয়।

নারীবাদী কবি ‘অ্যাড্রিয়েন রিচ’ এর কলমে ওঠে এই রাজনীতি এভাবেই ওঠে আসে, ‘আবহমান পিতৃতন্ত্র তার স্তুতি, স্বপ্নে, ধর্মতত্ত্বে এবং ভাষায় দু’মুখো। একদিকে নারীর শরীর অশুচি, বীর্যত্যাগ ও রক্তশ্রাব অপবিত্র, নৈতিক ও শারীরিক পতনের উৎস, নরকের দরজা। অন্যদিকে মা হিসেবে নারী মহান, পবিত্র, কামগন্ধহীন, মমতাময়ী; মাতৃত্বের সেই শারীরিক উৎস-রহস্য ও রক্তস্রাবে ভরা সেই একই নারী শরীর-নারীর একমাত্র নিয়তি, একমাত্র সার্থকতা’।

রাসসুন্দরী দেবী তাঁর আত্মকথায় (আমার জীবন) যে বেদনার বর্ণনা দিয়েছেন তা তুলে এনেছে প্রতিটি মা হওয়া মেয়ের জীবনের মর্মান্তিক সত্যকে, ‘... ১৮ বছর বয়সে আমার প্রথম সন্তান হয় এবং ৪১ বছর বয়সে ১২তম সন্তান। মাঝখানের ২৩টি বছর যে আমার কী অবস্থায় গত হইয়াছে তা কেবল পরমেশ্বর জানিতেন... কাজের গতিকে কোন দিবস একবেলা আহার ও ঘটিত না’।

একটু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। জীবনের যে পর্বের কথা রাসসুন্দরী দেবী বলেছিলেন আমি এখন ঠিক সেই পর্বে। তাই আমি ভীষণ রকম একাত্ম হতে পারছি তার সেই অনুভূতির সাথে। ২৪ বছর বয়সে আমি প্রথম মা হই। আমার শরীর ধারণ করছে আমারই অংশ...নিঃসন্দেহে এ এক অপার্থীব, অতুলনীয় অভিজ্ঞতা। কিন্তু এর পর থাকে বাধ্যতামূলক সন্তান পালন, সংসার সামলানো আর পেশা গড়ার একার দায়। যা কখনও কখনও মর্মান্তিকও হয়ে উঠেছে। যদিও আমার সঙ্গী বাচ্চাদের সামাজিক মা হয়ে উঠতে পেরেছে, গৃহস্থলী কাজের ভাগ নিয়েছে। কিন্তু সেটা তার জন্য বাধ্যতামূলক করেনি সমাজ, বরং এটা তার মেজাজ মর্জির ওপর নির্ভর করে। তাই আমরা এ ধরনের সহযোগী পুরুষদের কাছে বারবার কৃতজ্ঞ থাকি। এই সুবিধাটুকুও না পাওয়ার কারণে আমার সমবয়সী বা পূর্বনারীদের অনেকেই আমার চাইতে বেশি যোগ্যতা নিয়ে ও মাতৃত্বের কারণে বিপন্ন হয়েছে, হচ্ছে। যখন নারী রোজগার করতে চায়, আঁকতে চায়, লিখতে চায়, গাইতে চায়, নাটক করতে চায়... মাতৃত্বের জন্য তাকে কেবল ছাড়তে হয়, পুরুষকে ছাড়তে হয় না কিছুই পিতৃত্বের জন্য।  

একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। আমি কিন্তু মাতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলছি না বরং নারীর ওপর আরোপিত মাতৃত্বের মিথকে ভাঙতে চাইছি। আমি মাতৃত্বের অনুকূল একটি সুবিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থার কথা বলছি, যেখানে যত্ন নেওয়া হবে মায়ের এবং তাকে সাহয্য করা হবে, যেন নারীর জন্য মাতৃত্ব ও জীবিকা পরস্পর কঠিন হয়ে দাঁড়াবে না। দ্য বেভোয়ারের মতোই আমি এমন একটা সমাজের সমাজের স্বপ্ন দেখছি যেখানে, ‘শিশুদের ভার প্রধানত নেবে পুরো সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা; যে নারী নিজে সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত জীবনযাপন করতে পারে, সে-ই তার সন্তানদের দিতে পারে সবচেয়ে বেশি এবং তাদের কাছে দাবি করে সবচেয়ে কম; উদ্যোগ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে অর্জন করে সত্যিকার মানবিক মূল্যবোধ, সে-ই সন্তানদের সবচেয়ে ভালোভাবে লালন-পালন করতে সক্ষম।(সিমোন দ্য বেভোয়ার, দ্বিতীয় লিঙ্গ, আজ নারীর জীবন, মা-২৮৪)।  

সুতরাং মাতৃত্বের বোধ হোক নারীর জন্য আত্মসমৃদ্ধির, বিপন্নতার নয়। সর্বংসহা হওয়াতে যদি এতো মহিমা থাকে, যদি নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াতে এতো গৌরব থাকে তবে আমরা নারীরা নিঃস্বার্থভাবে পুরুষকে এই মহিমা আর গৌরবের ভাগ দিতে চাই। পুরুষ ও নারীর সাথে সাথে মাতৃত্বেই সার্থক হোক, পুরুষ ও মহিমান্বিত হোক।  

লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ; কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ