X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

সহিংসতা মানে আধুনিকতা নয়

শেগুফতা শারমিন
২০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৩০আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:৩৫

শেগুফতা শারমিন খিলগাঁও তালতলা নামের জায়গাটা এখন জমজমাট। রাস্তার দুপাশ দিয়ে শত শত খাবারের দোকান। সেই সব দোকান, ফুটপাতে, রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। সন্ধ্যার পর থেকে একেবারে একটা মেলার মতো পরিবেশ। অনেকের কাছে গল্প শুনি বদলে যাওয়া জায়গাটার। সেদিন হঠাৎ একটা কাজে যাওয়া। সত্যিই চমকে যাওয়ার মতো পরিবর্তন। দাঁড়িয়ে ছিলাম, রাস্তার পাশে, কয়েকজনের অপেক্ষায়। ঘড়িতে প্রায় আটটা। হঠাৎ দেখি  চৌদ্দ পনেরো বছরের এক মেয়ে সুন্দর একটা সাইকেল নিয়ে এসে থামলো আমার সামনে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর জনা বিশেক একই বয়সের ছেলে এসে যোগ দিল। ওদের নড়াচড়া, অঙ্গভঙ্গী, হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, ফ্লাশ মব টাইপ কিছু নাকি! সবগুলো ছেলে মিলে চলন্ত রিকশাগুলোকে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে একটা বৃত্ত করে দাঁড়ালো। তারপর দেখি একটা ছেলে নিজের কান ধরে ওঠবস করছে আর সেই মেয়েটা, সাইকেল চালিয়ে আসা স্মার্ট মেয়েটা সাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখে ছেলেটাকে সমানে লাত্থি আর চড় থাপ্পর দিতে থাকলো। সঙ্গে আরো দুয়েকটা ছেলেকে। পুরো ঘটনাটা তাকিয়ে দেখে আমার মধ্যবয়সী মধ্যবিত্ত চোখ অবাক ছাড়া আর কিছু হতে পারলো না। মনে মনে যে মেয়েটাকে প্রথমে বাহবা দিচ্ছিলাম, সেই মেয়েটাই আমাকে অবাক করে দিল। প্রশ্ন জাগিয়ে দিল, এগিয়ে যাওয়া মানে আসলে কতটা এগোনো। ঠিক কোথায় থামতে হবে, আমরা কি তা জানি?
বেশ কয়েক মাস আগে দেখি ফেসবুক সয়লাব হয়ে আছে, জুনায়েদ জুনায়েদ বলে। যুগের হাওয়া কী বলছে, বোঝার জন্য সেই ক্লিপটা দেখলাম। এক কিশোর আরেক কিশোরকে তুমুল মারছে। সেই নিয়ে জাতি উত্তেজিত, দ্বিখণ্ডিত। যেই জুনায়েদ মারে, যেই ছেলেটা মার খায়, যে সাইকেল চালানো মেয়েটা মারে, যে ছেলেটা মার খায় আর আমরা যারা দেখি, উচ্চবাচ্য করি, আমরা কেও জানি না কোথায় থামতে হবে। আমরা কোথায় চলেছি। আমরা সঠিক সময়ে থামতে জানি না বলে আমরা কথায় কথায় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাই।
মাত্রা বলে একটা শব্দ আছে, আমরা ভুলে গেছি। আমাদের মাত্রা হারিয়ে গেছে। আমরা সবাই ভুলে বসে আছি সহিংসতা মানে আধুনিকতা নয়। সহিংস হওয়া অপরাধ। জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে আমরা প্রজন্মকে দিয়ে চলছি সহিংস হওয়ার সহজপাঠ। শুধু সহিংস নয়, জীবনকে জটিল করার পাঠ নিচ্ছে আমাদের কাছ থেকেই। নানা কিছুর হাতছানি, সহজলভ্যতায় অল্প বয়সে জীবন জটিল হয়ে যাচ্ছে। যেখান থেকে সে আর সহজে বের হতে পারছে না। তখন আশ্রয় খোঁজে নেশায়, আশ্রয় খোঁজে হত্যায় নিজেকে অথবা বন্ধুকে অথবা আপনজন, এমনকি মা-বাবাকেও। আদনান নামের কিশোর খুন হয়, ঐশীর মা বাবা খুন হয়।

খিলগাঁর মেয়েটা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় উত্তরবঙ্গে। এদেশের তুলনামূলক দরিদ্র অংশ উত্তরবঙ্গ। সবচেয়ে অবহেলিতও বলতে গেলে। অথচ রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারির যেকোনও গ্রামের সকাল আর বিকালগুলো অন্যরকম। দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা স্কুলে যায় বা স্কুল থেকে ফেরে। সাইকেল চেপে। নিজে চালিয়ে, কখনও পেছনে আরেকজনকে নিয়ে তথাকথিত পিছিয়ে পড়া উত্তর জনপদের মেয়েরা প্রজাপতির মতো সাইকেল চালিয়ে বেড়ায়। এত এত সীমাবদ্ধতায় ভরা এই দেশে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কয়টা হতে পারে? সাইকেল চালানো একেকটা প্রজাপতি মেয়ে তাই আমার কাছে স্বাধীনতার এক একটা নতুন সংজ্ঞা। সেই একই বয়সের একটা মেয়েকে যখন দেখি, সাইকেল থেকে নেমে সহিংস হতে, অস্থির লাগে। হয়তো এটাই কারও কারও কাছে এগিয়ে যাওয়ার, আধুনিকতার প্রতীক। কেউ বলবে, এতদিন ছেলেদের হাতে মার খেয়েছে মেয়েরা। এখন মেয়েরা মারছে, ভালোই তো।

ছেলে বা  মেয়ে এখানে একক কোনও বিষয় না। বিষয়টা সামগ্রিকতার। একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে মারুক সেটা যেমন কাম্য না। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে মারুক সেটাও কাম্য না। সেখানে ছেলে  মেয়েকে, মেয়ে ছেলেকে মারবে এটাও আশাতীত। এরকম একটা মার, দুইটা মার, তিনটা মার কিন্তু গণহারে মারের সংস্কৃতির চর্চা শুরু করবে। কেউ তখন মার খাওয়া থেকে বাদ যাবে না।

মাঝে মাঝে হতাশ লাগে, কোনটাকে আমরা এগিয়ে যাওয়া বলবো, কোনটাকে বলবো আধুনিকতা, আমরা কি তা জানি? আমরা এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছি। সমাজের প্রথা ভেঙে বেড়িয়ে আসার কথা বলছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি একা একা সামাজিক প্রথার বাইরে হেঁটে যাওয়া বিপ্লব নয়। বরং একটা প্রথার সঙ্গে সম্পর্কিত সম্পূর্ণ সিস্টেমকে পরিবর্তন করতে একসাথে এগিয়ে যাওয়াই বিপ্লব। পরিবার থেকে বন্ধুদের থেকে আমরা ছেলে মেয়ের সব রকম সম্পর্ককে মেনে  নেওয়ার উৎসাহ দিচ্ছি। আবার ভুলে যাচ্ছি, বেইলি রোডের সেই গৃহকর্মী মেয়েটার ঘটনা। যে কিনা সদ্য প্রসূত সন্তানটাকে ফেলে দিয়েছিল বাথরুমের জানালা দিয়ে। কারণ সমাজের ভয়। কিন্তু সমাজ তখনই চোখ রাঙায়, যখন রাষ্ট্র দায় নেয় না। আমাদের দেশ এখনও একটা শিশুকে একজন মাকে পরিপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেনি। একটা শিশুর এখনও বেড়ে উঠতে হয় পরিবারের ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে। এই রকম বাস্তবতায় একজন অবিবাহিত কিশোরী মায়ের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয় একটা শিশুর দায় বহন। সে সুযোগে সমাজ তার দাঁত নখ নিয়ে বের হয়ে আসে। 

যেদিন এদেশের প্রতিটি শিশুর দায়িত্ব নিতে পারবে রাষ্ট্র সেদিন জন্ম যে ঘরেই হোক, কোনও শিশুকে আর ডাস্টবিনে যেতে হবে না, লিখে দিলাম। যতই বলি, মেয়েদের ঘর থেকে বের হতে হবে, একা একা চলতে শিখতে হবে। শুধু মুখে বললেই হবে না। রাষ্ট্রীয় গণ পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি হতে হবে। এমন উন্নতি, যেখানে মাঝ রাতেও কোনও মানুষের ঘরে ফিরতে বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়। হ্যাঁ বলেছি কোন মানুষের। কারণ সব মানুষের জন্য যখন আধুনিক গণ পরিবহণ ব্যবস্থা হবে, নারী পুরুষ সবাই সমানভাবেই তা ব্যবহার করবে।

সুতরাং যতই উৎসাহ দেই পশ্চিমাদের মতো আচরণে আধুনিক হওয়ার, প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার। লাভ নেই। থামতে হবেই, যতদিন পর্যন্ত না রাষ্ট্রটা সত্যিকারের পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মতো সম্পদে, নীতিতে উন্নত না হয়।  মনে রাখতে হবে, একা একজন হুট করে আধুনিক হয়ে যেতে পারে না, রাষ্ট্র তাকে পরিপূর্ণ সমর্থন না দিলে।

লেখক: উন্নয়নকর্মী।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ