X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাইব্রিড ডেমোক্রেসি

শুভ কিবরিয়া
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:০৪আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:০৮

শুভ কিবরিয়া বহু বছর ধরে রাজনীতি নিয়ে লিখছি। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করছি। সব সময়ে যে বিশ্লেষণ ঠিক হয় তা না। বিশ্লেষণের যে আধার বা নিয়ামক, যেমন তথ্য, তত্ত্ব বা দূরদৃষ্টি- তার মানের ওপর নির্ভর করে সেই বিশ্লেষণ কতটা সঠিক হবে অথবা কতটা ভুল হবে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের মতো দেশে আমরা পশ্চিমের চিন্তাধারা থেকে পাওয়া তথ্যের ওপরই নির্ভর করি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সাম্প্রতিক ঘটনার ওপর চোখ রাখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার বোঝা যাবে।
নিদেনপক্ষে আমার নিজের বিবেচনা ছিল এবারের মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী বিজয়ী হয়ে আসবেন। আমার এই বিশ্লেষণের সপক্ষে ছিল যেসব তথ্য তার সবটাই আমরা পেয়েছি পশ্চিমা জগতের প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যমসহ এ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। পরে দেখা গেল, মার্কিন মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার নিজের বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ ভুল। ফলে আমাদের পক্ষে মার্কিন নির্বাচনে কে বিজয়ী হচ্ছেন সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা সঠিকভাবে সম্ভব হয় নাই। হয়তো পশ্চিমা মিডিয়া মার্কিন জনগণের একটা বড় অংশের মনের ভেতরের ভাবনা বুঝতে পারে নাই, বা বোঝার চেষ্টা করে নাই। কিংবা পৃথিবীব্যাপী মানুষের মনোজগতে সাম্প্রতিক বা চিরায়ত ভাবনার বিষয়ে যে মনোভঙ্গি বদলাচ্ছে তা ঠিক ঠাওর করতে পারে নাই পশ্চিমা দুনিয়ার বড় বড় বিশ্লেষকরাও। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প যে সাম্প্রতিক মানুষ হিসেবে চিরায়ত মূল্যবোধকে পরাভূত করে ‘সাম্প্রতিক’-এর জয়কে এতো উঁচুতে তুলে ধরবেন সে বিষয়ে কোনও পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয় নাই। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পর্কে পূর্বাভাস না দিতে পারলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে কি পূর্বাভাস দেওয়া যাবে না সঠিকভাবে? বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, পরিবেশ, উন্নয়ন সুবিধাবাদের যে পথে হাঁটছে তার পরিণতি কী হবে সেটা কি অনুমান করা একেবারেই অসম্ভব?
দুই.
এসব ভাবনা মাথায় এলো সাম্প্রতিক সময়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করে সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে হরতাল পালনকারী নিরীহ মানুষের ওপর পুলিশের সাঁড়াশি আক্রমণের সচিত্র ঘটনাপ্রবাহ দেখে। ফেসবুকে, সামাজিক মাধ্যমে একটা বড় আহাজারি চলছে পুলিশের এইসব অগণতান্ত্রিক, পেশাবহির্ভূত নিপীড়নমূলক আচরণ নিয়ে। পুলিশ কেন দুজন সাংবাদিককে নির্মমভাবে পেটালো? কেন পুলিশ মিজানুর রহমান নামের পরোপকারী, দেশপ্রেমিক, বয়স্ক নাগরিককে এভাবে টেনে-হিঁচড়ে এভাবে অপদস্ত করলো? পুলিশ কেন প্রতিবাদকারীকে রুখতে টিয়ারশেল রাবার বুলেটের এত ফুলঝুরি ছোটাল? জনগণের পয়সায় কেনা বুলেট, টিয়ার কেন নিরস্ত্র জনগণের ওপর এমন নির্বিচারে ছুড়লো পুলিশ?

এসব কেন’র দুরকম উত্তর আছে। এক. তারা এভাবেই অভ্যস্ত। গত অর্ধদশক ধরে তারা এই সংস্কৃতিতেই তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। দুই. তারা অতি-তৎপরতা দেখিয়ে সরকারের আপনজন হিসাবে নিজেদের পরিচয় সমুজ্জ্বল রাখতে চায়।

যেসব পুলিশ অফিসার এই নিপীড়নের পরামর্শক, পরিকল্পক তারা সরকারকেই হয়তো খুশি করতে চেয়েছেন। তারা যে প্রজাতন্ত্রের কর্মী একথা তারা ভুলেছেন, তারা সরকারি দলের ক্যাডার ভাবতেই আনন্দিত, উল্লসিত এবং হয়তো গর্বিতও হয়েছেন। কিন্তু তারা দুটো জিনিস সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন-

প্রথমত, এই নিপীড়নের ফটোগ্রাফ, ভিডিও দেশে বিদেশে ভাইরাল হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সুন্দরবন বিনাশী রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারীদের জন্য তা শাপেবর হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এ চিত্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে গোটা পৃথিবীতে একটা নতুন বার্তা দিয়েছে। ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকার ক্রমশ যে অসহিষ্ণু এবং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাতেই আস্থাশীল হচ্ছে সেই চেহারাটা নতুন করে আবার পৃথিবীর সামনে হাজির হয়েছে।
শুধু তাই নয় এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বয়ান দিয়েছেন তাও নতুন ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, পুলিশ সাংবাদিকদের নির্যাতন করে না। সাংবাদিকদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে পুলিশের ধাক্কাধাক্কি হয়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি ২০১৭) ঢাকায় পুলিশ ও সাংবাদিকদের মধ্যে সংঘটিত ঘটনাটি ছিল এরকম একটি ঘটনা।

তিন.
যেদিন রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল চেয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি হামলার ছবি মিডিয়ায় বেশ সাড়ম্বরে প্রকাশিত হয়েছে, সেদিনই সাংবাদমাধ্যমে বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচক-২০১৬ প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটেনের ইকোনমিস্ট গ্রুপের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদন নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্তি, নাগরিক স্বাধীনতা, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি- এসব মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর ১৬৫টি সার্বভৌম দেশ ও দুটি অঞ্চলকে নিয়ে একটি স্কোরের মাধ্যমে দেশগুলোর গণতান্ত্রিক অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। এসব দেশগুলোর গণতন্ত্রকে তারা চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে- ১. পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক দেশ (full democracy) ২. ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ (flawed democracy), ৩. হাইব্রিড গণতান্ত্রিক বা সংকর ধারার গণতান্ত্রিক দেশ (hybrid democracy), ৪, স্বৈরতান্ত্রিক ধারার গণতান্ত্রিক দেশ (authoritarian democracy)। মোট ১০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ৫.৭৩ নম্বর পেয়ে ১৬৭ দেশের মধ্যে ৮৪তম স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে। ১০ নম্বরের মধ্যে ৪ থেকে ৫.৯ নম্বর যারা পেয়েছে তারা হাইব্রিড ডেমোক্রেসির দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশও সেই হাইব্রিড গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম। বাংলাদেশের কাতারে আছে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, তুরস্ক মরক্কোর মতো বেশ কিছু দেশ। ২০১৪ সালের একতরফা ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যে ক্রমশ বিপন্ন করে তুলছে তার সর্বশেষ প্রমাণ হলো ইকোনমিস্ট ইন্টালিজেন্স ইউনিটের এই বৈশ্বিক গণতন্ত্রের সূচক-২০১৬ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান।

চার.

দলে হাইব্রিডরা ঢুকে গেছে বলে এক সময় হৈচৈ করতেন সরকারি দলের নেতা ওবায়দুল কাদের। এখন তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলের এই ভার পাওয়ার পর অবশ্য দলের হাইব্রিডিকরণ ঠেকানোর কোনও উদ্যোগ তিনি নেননি। দলকে হাইব্রিড নেতা মুক্ত করার কোনও ইচ্ছা তার আছে বলে মনেও হয় নাই। বরং গোটা দেশের গণতন্ত্রই হাইব্রিড তকমা পেয়ে গেলো।

বাংলাদেশের এই অবস্থান থেকে মুক্ত হয়ে সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশের অবয়ব পেতে গেলে আমাদের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা থেকে বেরুতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন যেমন অপরিহার্য ঠিক তেমনি আমাদের ‘দলান্ধ’ আমলাতান্ত্রিক কালচারেরও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমরা যদি দেশকে জনগণের রাষ্ট্র করে তুলতে চাই তবে এই হাইব্রিড চর্চা থেকে আমাদের বেরুনোর পথ খুঁজে বের করতেই হবে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ