X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘ডুব’, ডুব দেয়নি

শুভ কিবরিয়া
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:১০আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:২০

শুভ কিবরিয়া সব সময় যে কাজটা দেখিয়েই বাহবা পেতে হবে তা আর বর্তমান কালের রেওয়াজ নয়। এখন আধুনিকতার যুগ। প্রচারণার যুগ। প্রচারণার জন্য আওয়াজ তোলা দরকার। আওয়াজটা আপনি কিভাবে তুলছেন, সেটাই আসল বিষয়। আওয়াজটা ঠিকমতো তুলতে পারলেই হলো, লুফে নেবে মিডিয়া। মিডিয়ারও নিজস্ব তরিকা আছে। সেও ঢোলে এমনি এমনি বাড়ি দেবে না। অনেক ভালো কাজ নিয়ে মিডিয়ার দ্বারে দ্বারে ঘুরেও আপনি কোনও ফল পাবেন না। প্রচারণার ন্যূনতম সুযোগ দেবে না মিডিয়া। কিন্তু একটা বিতর্ক তুলুন, দেখবেন লুফে নিয়েছে মিডিয়া। তখন আর আপনার ঢোল আপনাকে বাজাতে হচ্ছে না। মিডিয়াই ঢোল বাজিয়ে আপনার কানে তালা লাগিয়ে দেবে।
মনে আছে, অভিনেতা অনন্ত জলিল একবার একটা নাটক করেছিলেন নিজেদের নিয়ে। তার স্ত্রী বর্ষা থানায় হাজির হয়ে অভিযোগ তুললেন, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতনের। তা নিয়ে হৈচৈ পড়ল। পরে জানা গেল এটা ছিল অনন্ত-বর্ষা জুটির প্রচারণার কৌশল। তাদের অভিনীত ছবি মুক্তির আগে নিজেদের ‘ঢোল পেটানো’ এই ভিন্ন কৌশল তারা নেন।
বলা যাবে না, ‘ডুব’ সিনেমা নিয়ে এ রকম কাণ্ডটিই যে ঘটছে। তবে কিছু সন্দেহ যে জাগে তা উপেক্ষা করা কঠিন। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন, ‘কোনও সংবাদ দিলে দেশের মিডিয়া খুবই হেলাফেলা করে ছাপে। মাত্র দু’লাইনেই নিউজ করে অনেকে, আমি যেখানে প্রায়োরিটি পাব সেখানেই তো নিউজ দেব, নাকি?’
০২.
‘ডুব’ ছবির পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। এটা তার নির্মিত নতুন ছবি। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় ছবিটি নির্মিত হয়েছে। ছবিটির নায়ক ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা ইরফান খান। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ চিত্রনাট্য অনুমোদিত হয়। ছবিটি নির্মাণ শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ বাংলাদেশের পক্ষে যৌথ প্রযোজনার প্রিভিউ কমিটি ছবিটি দেখে অনাপত্তিপত্র দেয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, একদিন পরেই সেই অনাপত্তিপত্র স্থগিত করে চিঠি দেয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন। কী কারণে অনাপত্তিপত্র স্থগিত তা চিঠিতে উল্লেখ নেই। কতদিন এই স্থগিতাদেশ থাকবে তারও উল্লেখ নেই। এই অনাপত্তিপত্র না পাওয়ায় ছবিটি সেন্সর বোর্ডে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। জানা গেছে, প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নেয়। বিবিসি রেডিওতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মেহের আফরোজ শাওন জানান, এই ছবির অভিনেতা, অভিনেত্রীদের বরাতে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে তিনি জেনেছেন, এই ছবিতে হুমায়ূন আহমদের জীবনের অনেক স্পর্শকাতর বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সেটিই তার আপত্তির কারণ। অন্যদিকে ছবির পরিচালকের বক্তব্য, এটি কোনও জীবনীভিত্তিক ছবি নয়। হুমায়ূন আহমদের কোনও কাহিনী অবলম্বনে এটি নির্মিত নয়। চরিত্র কাল্পনিক। সে ঘোষণা ছবিতেই আছে। ছবি জনসম্মুখে প্রকাশের আগে এ অভিযোগ শিল্পীদের স্বাধীনতা খর্বের শামিল।

০৩.

‘ডুব’ ছবির নাম হলেও বাংলাদেশে রিলিজের আগেই ছবিটি আর ডুব দিয়ে থাকেনি। প্রচারণার পাদ প্রদীপের আলোয় চলে এসেছে। মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা পাচ্ছেন ছবির পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী এবং অভিযোগকারী হুমায়ূন আহমদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এ নিয়ে চলছে ব্যাপক বিতর্ক ।

এই বিতর্ক কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে।

এক. ছবিটি রিলিজের আগে এমনকি সেন্সর বোর্ডে উপস্থাপনের আগেই এই মহাবিতর্ক কি ইচ্ছে করেই তৈরি করা হলো। সরকারি কর্তৃপক্ষ, মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী, মেহের আফরোজ শাওন- এই ত্রয়ী কি সংঘবদ্ধভাবেই এই বিতর্ক তৈরি করে ছবিটিকে নিয়ে আলোচনার তৈরি করলেন?

দুই. মেহের আফরোজ শাওন এই বিতর্ক তুলে কি মিডিয়ায় আবার আলোচিত হতে চান? নইলে হুমায়ূন আহমেদের জীবনকে খণ্ডিত করা হবে, তার স্পর্শকাতর জায়গাগুলোকে এই ছবি জনসম্মুখে এনে হুমায়ূন আহমদকে হেয় করবে, এই অভিযোগ কতটা বাস্তবসম্মত? মেহের আফরোজ শাওনের এই অভিযোগের ফলেই দর্শকরা তো এই বিষয়টি মাথায় নিয়েই ছবিটি দেখার চেষ্টা করবেন। হুমায়ূন আহমদের জীবনের স্পর্শকাতর অংশ তো এই প্রচারণার ফলে আরও বেশি উন্মোচিত , আকর্ষিত হবে। আরও বেশি মনোযোগ কাড়বে!

তিন. মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী মেধাবী পরিচালক। কিছুটা স্বাধীনচেতাও তিনি। বাংলাদেশে যারা সিনেমাকে তাদের ক্ষমতাবলয়ে আবদ্ধ রাখতে চান, যারা ফারুকীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সেই প্রভাবশালী মহল কি ফারুকীকে জব্দ করতে মেহের আফরোজ শাওনকে সামনে আনছেন? নইলে মেহের আফরোজ শাওন এত প্রক্রিয়াগতভাবে, ‘ডুব’ ছবির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধচারণ করছেন কিভাবে? মেহের আফরোজ শাওনের চিঠিই নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনাই বা করছেন কেন? তাহলে সেই প্রভাবশালী মহলই কি ফারুকীকে জব্দ করতে ভেতরে ভেতরে কলকাঠি নাড়ছেন?

চার. আজকের দুনিয়ায় স্বাধীন চিন্তাকে ‘নিষিদ্ধ’ করার ভাবনাচিন্তা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। এখন আর কোনও কিছুকেই নিষিদ্ধ করে মানুষের নাগাল থেকে নিষিদ্ধ রাখা যায় না। ‘ডুব’ও মানুষের নাগাল থেকে দূরে রাখা যাবে না। ছবিটি কলকাতায় প্রদর্শিত হবে। দেশের বাইরে প্রদর্শিত হবে। ইউটিউবে প্রকাশিত হবে। মানুষ বিপুলতর আগ্রহ নিয়েই ছবিটি দেখবে। এমনকি বাংলাদেশ সরকারও চাইলেও ভারতীয় প্রভাব, দেশের আদালতের প্রভাব, সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘ডুব’কে নিষিদ্ধ রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। তাহলে কেন এই নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ খেলা? ভারত- বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ছবি বলেই কি এই আচরণ হচ্ছে ছবিটির ক্ষেত্রে?

০৪.

এখন ‘ডুব’ নিয়ে কী হবে? দুই পক্ষে চাপান উতোর চলবে। মিডিয়া দুই পক্ষের গরম গরম খবর ছাপবে। দুই পক্ষের শক্তিমান অংশ সরকারের উচ্চ সীমানার স্নেহ দৃষ্টি চাইবে। সেখান থেকে একটা মীমাংসা আসলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নইলে এই ঘটনা আদালতের বারান্দায় যাবে। সেটা ‘ডুব’-কে আরও বড় প্রচারণার আলোয় নিয়ে আসবে। এখন পর্যন্ত তথ্য যা জানা যাচ্ছে তাতে সুস্থির আইনি লড়াই হলে ছবি মুক্তির পক্ষেই রায় আসার কথা।

অন্যপক্ষে হুমায়ুন আহমদের জীবনের কথিত স্পর্শকাতর অংশ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। মেহের আফরোজ শাওনের তাতে কী লাভ হবে তা জানি না তবে মানুষ হুমায়ূন আহমদের বই পড়ার বদলে এইসব গসিপ জানতে অধিকতর আগ্রহী হয়ে পড়তে পারে।

ভয়ের দিকটা অন্যত্র। বহুমত প্রকাশ নিষিদ্ধের যে উজান ঢেউ পৃথিবীব্যাপী চলছে তাতে এই ঘটনা আরও রঙ লাগাবে। এখন যে কেউ তার অপছন্দের সাহিত্য, শিল্পকলা, সিনেমা, নাটক, গানকে এইরকম অভিযোগ এনে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। উদার জমিন তৈরির বদলে তা আমাদের বিকাশকে আরও রুদ্ধ করে দেবে।
তবে শেষ বিচারে ‘ডুব’ যে আর ডুবন্ত থাকছে না এইটা নিশ্চিত।পয়সা বিনিয়োগ ছাড়াই , ছবি প্রকাশের আগেই যে প্রচারণা পেয়ে গেলো ‘ডুব’ তার অর্থমূল্যও কিন্তু কম নয়। এরপর নানারকম দেশি-বিদেশি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা তো থাকছেই!

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ