X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মনু মালকার বিয়েতে শাহরুখ মালাইকা!

শেগুফতা শারমিন
৩০ মার্চ ২০১৭, ১৩:৩৫আপডেট : ৩০ মার্চ ২০১৭, ১৩:৩৭

শেগুফতা শারমিন চলছে চৈত্রমাস। আবহমান কালের বাংলা রীতি অনুযায়ী চৈত্রমাসে বিবাহ নাস্তি। মানে এ সময় বিয়ের আয়োজন মানা। কিন্তু কিসের কী? যত মাথা তত মতের দেশে এখন কোনটা রীতি, কোনটা সংস্কৃতি, বোঝা দায়। যার যেমন ইচ্ছা চলছে। পোষাক-আষাক, খাদ্যাভ্যাস, জীবন-যাপন কোথাও কোনও লালিত সংস্কৃতির ছায়া নেই। যেমন নেই উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রেও। শ্রাবণের ইলিশ দিয়ে বৈশাখে পান্তা, বিশেষ বিশেষ দিনের জন্য হুলস্থুল শপিং, তুলকালাম ভ্যালেন্টাইন’স ডে, দোলের দিনের রংবাজি, একদিকে ওয়েস্টার্ন আউটফিট আরেকদিকে হিজাব সবকিছু মিলেমিশে একটা জগাখিঁচুড়ি সময় আমরা পার করছি। যেখানে কোনটা আসল, কোনটা আরোপিত খুঁজে পাওয়া যায় না। সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় বাজারের হাতে।
কোনটা উৎসব, কোনটা উৎসব নয়। উৎসব মানে কোন রঙ, কী পোষাক, ঠিক করে দেয় বাজার। হাজার বছরের ঐতিহ্য শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয় বিপণনের মোক্ষম ট্যাগলাইন হিসেবে। জাতি হিসেবে তুমুল হুজুগে এই বাঙালি হুমড়ি খেয়ে পড়ি নতুন আমদানিকৃত ব্যান্ড নিউ সংস্কৃতিকে নিজের বলে, বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্ঠির ব্যবহৃত বলে চালিয়ে দিতে। তো সেই আমাদের মনে যে থাকবে না, চৈত্র মাসে বিবাহ নাস্তি। এতো খুব স্বাভাবিক। তাই এই মাসেও বিয়ে হয়, ধুম ধাড়াক্কা তালে। বাড়ির পাশে কমিউনিটি সেন্টার, তাই টের পাই আর অক্ষরে অক্ষরে মিলাই যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপরশীর ঘুম নাই।
আক্ষরিক অর্থেই ঘুম ছুটে যায়, এলাকাবাসির। যিনি বা যাহারা বিয়ে করছেন, তিনি বা তাহারা শুধু নিজেদের শোনার জন্যই গানবাজনা বাজান না। সমস্ত এলাকাবাসীকে শোনানোর দায়িত্ব নেন। যিনি বিয়ে করছেন, তার তো হয়তো জীবনে একটাই বিয়ে, তার শখ জাগতেই পারে এই একটা দিন, মানুষকে একটু গান শোনানোর। কিন্তু তিনি কি ভেবে দেখেন, তার মতোই সবাই আল্লাহর ৩০ দিন যখন এই শখ পূরণ করতে ওঠে পড়ে লাগেন, তখন এলাকাবাসীর কী অবস্থা হয়? ঘুম তাদের কোথায় পালায়? তাছাড়া যিনি বিয়ে করছেন, খুব ভালো ব্যাপার, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, আত্মীয় বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে ডেকে আনা হয়, আনন্দ ফুর্তি করতে। ঠিক আছে। কিন্তু সেই একইদিনে, হয়তো কারো বাড়িতে কেউ অসুস্থ, কারও পরীক্ষা, কারও কোন বিপদ, কোন বাড়িতে মৃত্যুশোক। সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়, বিয়ে ওয়ালাদের গানের আওয়াজে। এই যে শোরগোল এইযে উচ্চশব্দে মাইক, প্রমাণ করে ক্রমেই আমরা অন্যের  প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি। অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার ধারাটাই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি হিসেবে।

এতো গেলো, বিয়ে বাড়ির বাইরের খবর। এবার একটু ভিতরের আলাপে আসি। একেকটা বিয়ে যেন এখন আর বিয়ে নয়, টাকা ওড়ানোর উছিলা। হিন্দি ছবির সেট আর বিয়ে বাড়ির অন্দরমহলের মধ্যে তফাৎ নেই কোনও। এক একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে, সব আমদানিকৃত আচার আচরণ। মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না, কোনটা আমাদের নিজস্ব। হিন্দি সিনেমা হিট করার জন্য গান লাগে। বিভিন্ন দৃশ্যের সঙ্গে গান। এরমধ্যে বিয়ের পর্বে সবার অংশগ্রহণে একটা ধুমধাড়াক্কা মার্কা গানের চিত্রায়ন, ছবি হিট করার অনেক পুরনো ফর্মুলা। সেই ফর্মুলা এখন ব্যবহার হয় আমাদের দেশের রিয়েল বিয়ের চিত্রে। ছোট বড় নির্বিশেষে আত্মীয় পরিজনরা নাচতে নামেন। জীবনে কোনদিন হয়তো হাত আর পা একসাথে নাড়ান নাই, তারাও  সেই আসরে নৃত্যশিল্পী। কিছু হোক বা না হোক, আনাড়িপনার চূড়ান্ত দেখিয়ে সবাই হাত পা ছোড়াছুড়ি করেন। নাচ যে একটা দারুণ রুচিসম্মত শিল্প, তার দফারফা হয়ে যায়, বিয়ে নামক অনুষ্ঠানের মঞ্চে। একসময় বিয়ের গীত বলে কিছু বিশেষ গান ছিল। আর ছিল সেইসব গীত গাওয়ার বিশেষ কিছু মানুষ। আধুনিকতার পরিক্রমায় তারা হারিয়ে গেছে, এসেছে ডিজে গ্রুপ। লীলাবালির মতো বিয়ের গীতের জায়গায় স্থান পেয়েছে বেবিডল।

একেতো বাঙালি মুসলমানের বিয়েতে আচার অনুষ্ঠান কম। তারপরও দীর্ঘদিন যাবৎ গায়ে হলুদের রেওয়াজ চলে আসছিল। গায়ে হলুদ মানে বিয়ের একদিন বা দুদিন আগে কনে এবং বরের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের পাল্টাপাল্টি যাওয়া আসা। মাছ আর অন্যান্য তত্ত্ব বিনিময়। সেই সঙ্গে গায়ে হলুদ দেওয়া, মিষ্টি মুখ করা এবং মেহেদি লাগানো। সেই গায়ে হলুদের নিতান্ত পারিবারিক অনুষ্ঠানটি এখন পুরাই করপোরেট ইভেন্ট। ভেন্যু সাজানো থেকে ফটোগ্রাফি, খাবার থেকে পান সুপারি সব কিছুই বাজারের সাথে সম্পর্কিত, সংস্কৃতির সঙ্গে নয়। হিন্দি গান হবে, কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং নাচ হবে, স্টেজের পর্দার আড়ালে নির্ভেজাল বিশুদ্ধ পানির বোতলে বিদেশি তরল থাকবে। যারা দাওয়াতে আসবে তাদের খুব মজা না, ‘অন্নেক মাস্তি’ হবে। এখানে আয়োজনটাই মূখ্য। চেষ্টা চলে একজনের আয়োজনে আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। নিজস্ব সংস্কৃতির ব্যবহার থাকে না, নিদেনপক্ষে মেহমানদারীর যে আন্তরিকতা, সেটাও অনুপস্থিত দৃষ্টিকটুভাবে। বছর কয়েক আগে পরিচিত একজনের গায়ে হলুদের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান দেরি করে শুরু করার রেওয়াজ চলছে, জানা ছিল। তাই সন্ধ্যা দাওয়াতপত্রে সাড়ে সাতটা লেখা থাকলেও রাত প্রায় ৯টায় গিয়ে পৌঁছি অনুষ্ঠানস্থলে। গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ, কেউ তখনও আসেনি। কনে আর কনের মা বাবা ছাড়া কাউকেই সেভাবে চেনা নাই। একে একে লোকজন আসা শুরু হলো।

যথারীতি কাওকেই চিনিনা। রাত পৌঁনে এগারোটায় আসলেন কনে। এরপর শুরু হলো ছবি তোলার পালা। যত মানুষ উপস্থিত ছিল, সবাই তখন ফটোগ্রাফার এবং স্টেজের সামনে। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে এগারোটা। অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হয়নি, তখনও। খাওয়া-দাওয়া হবে, তারও পর। এরপর আর থাকা সম্ভব না, সুতরাং পৌঁনে বারোটা বাজতে বাড়ির পথ ধরলাম, না খেয়েই। সেদিন আমার শিক্ষা হলো যে, বিয়ে নিতান্তই একটা ব্যক্তিগত বিষয়। এবং এ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানটাও হওয়া উচিৎ নিতান্তই পারিবারিক। এই উপলব্ধির পর থেকে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলি।

এতক্ষণ বলছিলাম, আধুনিককালের বিয়ের অনুষ্ঠান মানে অন্য সংস্কৃতির আমদানি। নিজস্বতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার লক্ষণ। এবার আরেকটা সমস্যার কথা বলি। বিয়ে মানে এখন মাত্রাহীন খরচ, বেহিসেবি টাকার ব্যবহার। ঢাকা শহরের নিতান্ত মধ্যবিত্ত সাধারণ মানের একটা বিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনে খরচ হয় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। সামর্থ্যবানদের কোটি ছাড়িয়ে যায় হরহামেশা। ইতোমধ্যেই বাজার অর্থনীতি বিয়ে অনুষ্ঠানের একটা ট্রেন্ড সেট করে ফেলেছে যেই ট্রেন্ড সমাজে বৈষম্য তৈরি করছে।

পেছন ফিরে যতদূর দেখা যায়, দেখি কন্যা দায় এ সমাজের এক বড় যন্ত্রণা। দিন যখন এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ যখন আধুনিক হচ্ছে, তখন এ যন্ত্রণা কমে আসার কথা। অথচ নতুন ধারার বিবাহ উৎসব এ যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে। সামর্থ্য নাই, কিন্ত শখ হচ্ছে। আশেপাশে সবার যেভাবে হলো, সেভাবে না হলে যেন মান সন্মান থাকছে না। দেনা বাড়ছে। দেনা করে লোক দেখানোর প্রতিযোগীতার আয়োজন হচ্ছে। এটাও যারা পারছে না, পিছিয়ে পড়ছে। এতদিন শ্বশুরবাড়িতে বধু নির্যাতনের একটি কারণ ছিল যৌতুক। এখন তার সাথে যোগ হচ্ছে বিয়ে আয়োজনের ঘাটতির খোঁটা।

দিন এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা শিক্ষিত হয়েছি, সচেতন হয়েছি। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে শিখছি। অন্যায্যতা দেখলে কথা বলতে বলছি। সেই আমরাই সামর্থ্য আছে বলেই হিন্দি সিনেমার অনুকরণে বিয়ের আয়োজন করছি। বাহবা পাচ্ছি। আর এতে খুব নীরবে আর দশজন মানুষের মনোকষ্টের কারণ হয়ে যাচ্ছি। সমাজে বৈষম্য উস্কে দিচ্ছি। কিছু মেয়ের, কিছু পরিবারের অসহায়ত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছি, পুরোপুরি অজ্ঞতায়।

একটু শিক্ষা, একটু বেশি সামর্থ্য, প্রজন্মের ব্যবধানে শ্রেণি পরিবর্তন কোনটাই আমাদের দায়িত্বশীল করে তুলতে পারেনি। না দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি, না সমাজের সাধারণ মানুষের প্রতি। তার অনেকগুলো লক্ষণের একটি হলো বর্তমানের ‘বিবাহ সংস্কৃতি’। আফসোস।     

লেখক: উন্নয়নকর্মী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ