X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

কুমিল্লা সিটি নির্বাচন: শিক্ষা না সতর্কতা?

শুভ কিবরিয়া
০২ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:৫৪আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:৫৬

শুভ কিবরিয়া একটা বড় মনোযোগ পেয়েও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন(কুসিক) নির্বাচন শেষ পর্যন্ত তা টিকিয়ে রাখতে পারেনি। কেননা একই সময়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের ভয়াবহতা এবং প্রাণহানির খবর এই নির্বাচনি ফলাফলের উত্তাপকে অনেকটাই পেছনে ফেলে দেয়। ফলে সকল উপাদান থাকা সত্ত্বেও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো মিডিয়ায় ও জনমনে ঝড় তুলতে পারেনি।
প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়েছে কুসিক নির্বাচনে। তাই আওয়ামী লীগ-বিএনপি লড়াই দেখবার একটা সুযোগ ঘটেছে এই নির্বাচনে। সরকারে আওয়ামী লীগ। উন্নয়নের মহাসড়কে দেশকে পৌঁছে দিয়েছে বলে তাদের প্রচারণা রয়েছে। ফলে জনরায় তাদের পক্ষেই আসা উচিত বলে তাদের দাবি। অন্যদিকে বিএনপির দাবি সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। তাই জণগণের মতামতের কোনও তোয়াক্কা করে না সরকার ও তার দল। এই বৈরী অবস্থার মধ্যেও সুযোগ পেলে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেবে বলে বিএনপির দাবি। ন্যূনতম সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির পক্ষেই আসবে গণরায় এই ঢোল তারা বাজিয়ে চলেছে অনেকদিন ধরেই।
কিন্তু বাস্তবে কী ঘটলো? কেন হারলো আওয়ামী লীগের প্রার্থী? বিএনপির প্রার্থীর জয়লাভেরই বা তাৎপর্য কী? এই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে এই ভোটের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাক।
এক. এই নির্বাচনে মোট ভোটার ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ২ হাজার ৪৪৭ (৪৯.৩৬%)। নারী ভোটার ১ লাখ ৫ হাজার ১১৯ (৫০.৬৪%)। এই নির্বাচনে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি। সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় ৩৮ হাজার। নতুন ভোটার প্রায় ৩০ হাজার। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৯০ যার শতকার হার ৬৩.৯২%। ৭৪ হাজার ৮৭৬ জন ভোটার ভোট দেননি। ভোট না দেওয়ার শতকরা হার ৩৬.০৮।
দুই. বিগত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের চেয়ে এই নির্বাচনে ১১ দশমিক ২ শতাংশ কম ভোট পড়েছে। গতবার ভোট পড়েছিল প্রায় ৭৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। এবার পড়েছে ৬৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট।

তিন. ১০৩ টি নির্বাচন কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টির নির্বাচনি ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। ২টি কেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। বিএপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু পান ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট ( প্রাপ্ত ভোটের ৫১.৯৬%)। আওয়ামী লীগ প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা পান ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট (প্রাপ্ত ভোটের ৪৩.৬০%)। দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ১১ হাজার ৮৫ ভোট (প্রাপ্ত ভোটের ৮.৩৫%)।

চার. ১০১টি কেন্দ্রের মধ্যে বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ৬৭টি এবং আঞ্জুম সুলতানা সীমা ৩৪টি কেন্দ্রে জয়লাভ করেছে। ২৩টি কেন্দ্রে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে।

পাঁচ. ৬টি ভোটকেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। এই ভোট পড়ার হার প্রায় ৮২% থেকে ৯১% পর্যন্ত। অস্বাভাবিক ভোটপড়া কেন্দ্রগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছে।

ছয়. অন্যদিকে শতকরা ৫০ ভাগ ভোটারও ভোট দিতে যায়নি বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে। এর মধ্যে নবাব ফয়জুন্নেচ্ছা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র-২ এ ৪৪ দশমিক ৪২ ভাগ এবং কেন্দ্র -১ এ ৪৫ দশমিক ৬৮ ভাগ, ভিক্টোরিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবন কেন্দ্রে ৪৭ দশমিক ৫৯ ভাগ ভোট পড়ে। বাগিচাগাঁও ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রে মাত্র ভোট পড়েছে ৪৭ ভাগ।

সাত. ১০টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়ে। জাঙ্গালীয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে ৯০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বাঁদুরতলা নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সর্বনিম্ন ভোট পড়েছে ৪৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। ৩১ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশের নিচে; যার মধ্যে সব কয়টিতেই জিতেছেন সাক্কু। অর্থাৎ বেশি ভোট পড়া কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী এবং কম ভোট পড়া কেন্দ্রগুলোতে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।

আট. মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এই ভোটেও প্রকাশ্যে জাল ভোট, কেন্দ্রদখল করে ব্যালট ছিনতাই, ভোট কর্মকর্তাদের মারধর এবং ভাড়া করা নেতাকর্মীদের শো-ডাউন ছিল ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত।

কমপক্ষে ২০টি ভোটকেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে নৌকার প্রার্থীর নিজের মডার্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫টি ভোট কেন্দ্রে ব্যাপক জাল ভোট প্রদান করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। এই কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী ১ হাজার ৬২ ভোট পায় আর ধানের শীষের প্রার্থী পায় মাত্র ৯৭ ভোট।

নয়. নির্বাচনে বিএনপির কোনও তৎপরতা ছিল না বললেই চলে। ধানের শীষের সমর্থকরা নীরবে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। কোথাও কোথাও তারা বুকে নৌকার ব্যাজ পরে ধানের শীষের ব্যালটে সিল মেরেছে বলে ভোট শেষে সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন ভোটারদের একটি অংশ।

০২.

আওয়ামী লীগ প্রার্থী হারলো কেন? তা নিয়ে এখন নানান হিসেব চলছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। কুমিল্লার বিখ্যাত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আফজল খান বনাম আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার দ্বন্দের নীরব পুনর্জীবনকে দায়ী বলছেন অনেকে। এই অনুমান মিথ্যে নয় হয়তো। তবে এইটাই যে একমাত্র কারণ তা নয়। অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা মেয়র নির্বাচনের চাইতে নিজ নিজ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচনে মনোযোগী হয়েছেন। ফলে নিজের ওয়ার্ডে নিজের পছন্দের কাউন্সিলরকে জেতাতে অনেক ধরনের ভোটের আপষকে তারা কাজে লাগিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিজের ইমেজ স্বচ্ছ বলে দাবি করলেও তার পরিবারের অনেকেরই নেতিবাচক ইমেজ দলীয় সমর্থকদের বিমুখ করেছে।

দলের সব কর্মীরাই কি সমানভাবে সক্রিয় থেকেছেন? না সেটা ঘটেনি। নির্বাচন উপলক্ষে সরকারি দলের পক্ষে খরচ করা টাকাটা মাঠে ব্যয়ের চেয়ে বিশেষ কিছু নেতার পকেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটাও কর্মীদের অনেককে বিমুখ করতে পারে। এইরকম নির্বাচনে স্থানীয় নেতাদের চাইতে কেন্দ্রিয় নেতারা বেশি গুরুত্ব পেলে সেটাও দলের অনেককে বিরাগভাজন করতে পারে। সেই ক্ষুব্ধতাও নির্বাচনি ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে।

বিএনপির প্রার্থীর নিজস্ব ইমেজ একটা বড় প্রভাব ফেলেছে। কুমিল্লার রাজনীতিতে বিএনপির মধ্যে দলীয় কোন্দল বিরাজমান। কিন্তু বিএনপি যেহেতু রাজনৈতিকভাবে সরকারের রোষানলে আছে তাই বিপদের দিনে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কর্মীদের ততটা তাড়িত করে নাই। বরং তার চাইতে ঐক্যবদ্ধ থাকাকেই তারা জরুরি মনে করেছেন। বিএনপির প্রার্থী সদ্য-সাবেক মেয়র। সরকার তার বিরুদ্ধে অতীতে যেসব বৈরীতা দেখিয়েছে সেটা ভোটারদের কাছে তার প্রতি সমবেদনার কারণ হয়েছে।

০৩.

এখন এই নির্বাচন কী শিক্ষা দেয়?

এক. সকল প্রস্তুতি সত্ত্বেও এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন জণগণের আস্থা পূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনতে পারে নাই। জালভোট, জোর করে দেওয়া ভোট, নির্বাচন স্থগিত করার মতো ঘটনা ঘটেছে এই নির্বাচনে। ব্যাপক সংখ্যক ভোটার এই নির্বাচনে ভোট দিতে আসে নাই।

দুই. বিগত তিন বছরে অনুষ্ঠিত অধিকাংশ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপি হয়। যে কারণে ধীরে ধীরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সাধারণ ভোটাররা। নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় এখনও সম্পূর্ণ আস্থা ফিরেনি ভোটারদের।

তিন. সরকারি দল কার্যত নানামুখী স্বার্থের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। এই নির্বাচনে তার উপস্থিতি সরবে দেখা গেছে। দলীয় প্রতীক, দলীয় প্রধানের নির্দেশনাও এই দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রভাব ফেলে নাই। সরকারি দলের জন্য এটা একটা অশনি সংকেত।

চার. দলীয় ভোটের বাইরেও যে বিস্তর ভোট আছে আমাদের দলীয় প্রার্থীরা ব্যাপকভাবে তা ভোটকেন্দ্রে হাজির করতে পারে নাই। বাংলাদেশের নির্বাচনি সংস্কৃতির বড় ধরনের পরিবর্তন না হলে এই পরিস্থিতির কোনও নাটকীয় পরিবর্তন হবে কিনা সেই সংশয় রয়ে গেছে।

পাঁচ. বিএনপির জন্য শিক্ষা হচ্ছে রাজনীতির মাঠে তাদের থাকতে হবে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির জন্যে মাঠে নেমে জনগণের কাছে যেতে হবে। দলের প্রার্থী নির্বাচনের সময় মাঠের প্রকৃত অবস্থার মূল্যায়ণ করতে হবে। কোনোভাবেই কোনোকিছুর বিনিময়েই তুলনামূলক অযোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে তাদের পক্ষে বিজয় আনা সম্ভব হবে না।

০৪.

তা হলে এই নির্বাচনের শিক্ষা কী?

এক.  মোটামুটি একটা স্বচ্ছমানের নির্বাচন হলে সরকারি দলকে অনেক বিপদের মুখে পড়তে হবে। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে  সংসদ নির্বাচনের মতো ক্ষমতার পালাবদলকারী নির্বাচনে কি রাজি হবে আওয়ামী লীগ?

দুই. একটা ন্যূনতম স্বচ্ছ নির্বাচন করার দাবি আদায় করার সক্ষমতা যদি বিএনপি অর্জন করতে না পারে তাহলে সরকারি দলের দাপটের মুখে নির্বাচনি মাঠে কি টিকতে পারবে বিএনপি?

তিন. শঙ্কাটা তাই বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে। কুসিক নির্বাচনে তার কিছুটা ইঙ্গিত আছে। কোনও প্রভাব ছাড়া মানুষ যদি ভোট দেওয়ার সুযোগ পায় তাহলে মানুষের মনে কী আছে তার একটা ইঙ্গিত এই নির্বাচনে আছে। আওয়ামী বিরোধী ভোটের যোগফল এখনও ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ