X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব ঐতিহ্যের এই শোভাযাত্রা কার মঙ্গলে?

সাদিয়া নাসরিন
১১ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:৫৩আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:৫৭

সাদিয়া নাসরিন বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাংলাদেশের অনন্য সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের মর্যাদা দিয়েছে ইউনেস্কো। কী আনন্দ! প্রতিটি স্কুলে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা বাধ্যতামূলক করে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ইসলামি ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি বর্ষ বরণের নামে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়ার অশুভ পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। মিছিল পূর্ব সমাবেশে বক্তারা বলেন, মূর্তি মানলে মুসলমানিত্ব থাকবে না। তাই ইসলামের আকিদা বিরোধী মূর্তির প্রকাশ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বাতিল করার দাবিতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নববর্ষ উদযাপনের প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে গত ৩০ মার্চ বৃহস্পতিবার ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম- এর বিবৃতিটি খুব উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা সাম্প্রদায়িক। কারণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ধর্ম ও সংস্কৃতির অংশ। মূলত দেব-দেবীকে উদ্দেশ্য করে এসব আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দু জনগোষ্ঠী কল্যাণ কামনা করে থাকে। কেননা হিন্দু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস মোতাবেক পেঁচা মঙ্গলের প্রতীক ও লক্ষ্মীর বাহন, ইঁদুর গণেশের বাহন, হনুমান রামের বাহন, হাঁস স্বরসতীর বাহন, সিংহ দূর্গার বাহন, গাভী রামের সহযাত্রী, সূর্য দেবতার প্রতীক ও ময়ূর কার্তিকের বাহন। এসব প্রতীকের মাধ্যমে তারা পূজা-প্রার্থণা করেন। ইসলামে এটা হারাম। কেননা মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে শিরক বা মহান আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্বের ধারণা জড়িত। সুতরাং প্রকাশ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাতিল করতে হবে।’

খবরটি যখন পড়ছিলাম, তখন আমি দেশি দশ এর কাউন্টারে, বাচ্চাদের জন্য পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার পোষাক কিনে বিল দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু ইসলামের সংরক্ষকদের এই গগনবিদারী হুংকার শুনে আমি আস্তে করে কাউন্টারে পোষাকগুলো ফেরত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাচ্চাদের হাত ধরে বের হয়ে এলাম। বাচ্চারা জিজ্ঞেস করলো, মা ড্রেস কিনবা না? আমি আস্তে করে উত্তর দিলাম, ‘না মা-বাবারা, তোমরা মুসলিম দেশের নাগরিক। এমন হিন্দুদের অনুষ্ঠানে যাওয়া, বিজাতীয় মঙ্গল শোভাযাত্রা করা তোমাদের জন্য হারাম’।

ক্রমশ হেফাজতিকরনের এই দেশে হুজুরদের এই হুমকির পর বিশ্ব ঐতিহ্যের মঙ্গল শোভাযাত্রায় তেরো বছরের মেয়েকে পাঠানোর সাহস আমার অন্তত নেই। বলা যায় না, যদি ওখানেও কোনও দুষ্টু ছেলে ঢুকে পড়ে! যদি পুলিশ অসহায় হয়ে যায়! যদি প্রিন্সিপাল ওদের শোভাযাত্রায় পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে দাবা খেলেন! আমি ভয় পেয়েছি, আমরা ভয় পেয়েছি। নিশ্চয়ই আমাদের মেয়েকে রাজপথে বিবস্ত্র করতে দিতে পারি না আমরা। তাই আমরা পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা বর্জন করলাম। আমার মনে পড়ে গেলো, ঠিক দুবছর আগে এই বিজাতীয় হারাম অনুষ্ঠানে যাওয়ার অপরাধে শত শত মানুষের ভীড়ে আমাদের মেয়েদের প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করেছে ‘দুষ্টু’ ছেলেরা, ওদের ভুভুজেলার শব্দে চাপা পড়ে গিয়েছিলো নির্যাতিত মেয়েদের আর্তচিৎকার। পুলিশ সূত্রে সিসিটিভি ক্যমেরায় যে যুবকদের সনাক্ত করা হয়েছিলো, তারা বলছিলো, ‘কেন তোরা এখানে এসেছিস - হেজাব পরস নাই কেন’। বটেই তো! মুসলিম দেশের পুরুষদের ঈমানি দায়িত্ব মেয়েদের সঠিক পথে চালানো।

একাত্তরে ও এদেশের হাজার হাজার হায়েনা ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আমাদের নারীদের ওপর ‘হিন্দুস্থান’(?) চাওয়ার অপরাধে। এই স্বাধীন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় ও আমাদের মেয়েরা নিরাপদে হায়েনার আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত হয়, বিজাতীয় অনুষ্ঠানে যায় বলে। পুলিশ ভীড় ঠেলে ভেতরে যেতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে, প্রক্টর কম্পিউটারে মনযোগ দিয়ে দাবা খেলেন, থানায় মামলা নেওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হয়, দুবছরেও ধরা পড়ে না আমাদের দুষ্টু ছেলেরা! কেবল সিসিটিভির ফুটেজ থেকে ঝাপসা ছবি প্রকাশ হয়, পুরস্কার ও ঘোষণা করা হয়, কিন্তু...? …থাক ওসব কথা আর না বলে বরং নিজের কথা বলি। যতদিন এই দেশের উৎসব, পার্বন, প্রতিবাদ প্রতিরোধের রাজপথ মেয়েদের জন্য নিরাপদ না হয় ততোদিন মেয়েরা লুকিয়ে থাক ঘরের কোণে। ঠিক এটাই তো চেয়েছিলো ওরা, না? পহেলা বৈশাখ বিজাতীয় সংস্কৃতি, মঙ্গল শোভাযাত্রা মঙ্গলঘট, মঙ্গল প্রদীপ, মাঙ্গলিক প্রতীক অঙ্কন ইত্যাদিকে হিন্দুয়ানি উৎসব বলে, প্রভাতফেরীকে বেদাত বলে, স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়াকে না জায়েজ বলে আমাদের প্রজন্মকে এসব থেকে দূরে রেখে ওদের খালি মগজে ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদের চাষ করাই তো ওদের এজেন্ডা, তাই না? এই জন্যই সুকৌশলে কাজ করেছে বহু বছর ধরে, সঙ্গোপনে, সাবধানে। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য করে দেওয়া, লালন-হাসন-আব্বাসউদ্দিন-আব্দুল আলীমের নাম মুছে দেওয়া, শহীদ মিনার, প্রভাতফেরী, পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেওয়া, বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নারীকে বিবস্ত্র করে ভীতি সঞ্চার করা, জাতীয় সংগীতের মধ্যে হিন্দুদের দেবীকে খুঁজে পাওয়া, জয়বাংলা উচ্চারণ করলে ভ্রু কুঁচকানো, এসব তো সেই পরিকল্পনার অংশবিশেষ...।

তবে তাই হোক, ওরা যা চায়। চুলোয় যাক তবে পহেলা বৈশাখের মঙ্গলযাত্রা কিংবা প্রভাতফেরীর নৈবেদ্য। আমাদের সন্তানের মগজে চাষ হোক ধর্মান্ধতার বিষবৃক্ষের। আমার সন্তান জেহাদের মরণ বীণ বাজানো হ্যামিলনের বাঁশির সুরে যদি জঙ্গিবাদের সাগরে ডুবে মরে, কার কী তাতে? ওদের সেই চিত্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই বারবার হামলা হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর। বোমা মেরে রক্তাক্ত, ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সাংস্কৃতির চেতনাকে। ২০০১ সালে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর বোমা হামলায় মারা গিয়েছিলো ১০ জন মানুষ। ১৪ বছর পর ২০১৪ সালে ঢাকার দায়রা জজ আদালত মুফতি হান্নানসহ ৮ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড ও ৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। তার ও তিন বছরের মাথায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়েছে হাইকোর্টে। ১৯৯৯ সালে মধ্যরাতে যশোর টাউন হল মাঠে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলো ১০ জন, আহত হয়েছিলো আড়াই শতাধিক মানুষ। ১৮ বছরে ও নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞের ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নেত্রকোনা কার্যালয়ে মৌলবাদী অপশক্তির নৃশংস বোমা হামলায় প্রাণ হারান ৮ জন।

এতোবার রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত করে ও রুখতে পারেনি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে, রুদ্ধ করতে পারেনি মুক্তকণ্ঠকে।  তাই এবার মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে হিমঘরে ঢুকে গেছে সেক্যুলারিজমের আদর্শের শান্তিপ্রিয় সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র। তা-ই হয়েছে যা ওরা চেয়েছে। মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করার জন্য একের পর এক ধর্ম পালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে রাষ্ট্র। তাদের দাবি মতো পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে অসাম্প্রদায়িক মানবতার পাঠ্যক্রম। শিশুর মাথায় ওড়না চেপেছে, ইতিমধ্যেই শিশুমেয়ের বিয়ের আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রীতিলতা ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের বীরগাঁথা চাপা পড়ে গেছে ঈশাখাঁ আর তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার নিচে। আমার ভাইয়ের বোনের রক্তে রাঙানো বর্ণমালার ধর্মান্তর তো কবেই হয়েছে!

না, আমার আর কোনও অভিযোগ নেই কারো প্রতি। তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে, নারী নিপীড়নের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে, মৌলবাদীদের মঙ্গলশোভাযাত্রা বন্ধ করার হুমকি দেওয়ার স্পর্ধা বাড়িয়ে, জঙ্গিবাদের উত্থিত চাপাতির নিচে দাঁড়িয়ে এই বিশ্ব ঐতিহ্য দিয়ে আমরা কী করবো? এই শোভাযাত্রায় যে গ্রাম বাংলার জীবন, সংস্কৃতি ও সম্প্রিতি ফুটিয়ে তোলা হয়, সেই বাংলা কি আমাদের চেতনার কোথাও অবশিষ্ট আছে? আমাদের শিক্ষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কি চলে যায়নি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্ধকার ছায়ায়? আমাদের তারুণ্যের মগজের দখল কি নেয়নি ধর্মান্ধ পুঁজিবাদি শিক্ষার বেশাতি করে জেহাদের মরণ বীণ বাজানো বাঁশিওয়ালার হাতে? যে দেশে স্কুলে জয় বাংলা উচ্চারন করার অপরাধে আমার শিশু সন্তান নিন্দিত হয়, শাস্তি হিসেবে এসেম্বলিতে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে হয় ৬ বছরের শিশুকে, সেই দেশে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা কার মঙ্গলের জন্য? 

বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেলেই কি ফিরে আসবে আমাদের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে জন্ম নেওয়া অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ? এই মঙ্গল শোভাযাত্রা কি নিশ্চিত করতে পারবে এই দেশের এক ইঞ্চি মাটি ও আর  যাবে না আর নষ্ট রাজনীতির অধিকারে? একদিন এই দেশের নারীরা রাজপথ কাঁপিয়ে ভাষার জন্য মিছিল করেছিলো, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াই করেছিলো, কিন্তু নারী নিপিড়নের কলঙ্ক লাগেনি, অসম্মানিত হয়নি কোন নারী। আজকে গ্রামে-গঞ্জের স্কুল কলেজগুলোতে এই বাধ্যতামুলক বর্ষবরণে কোন মেয়ে লাঞ্চিত হবে না, কোন দুষ্টু ছেলে দুষ্টুমি করবে না সেই নিশ্চয়তা কি এই রাষ্ট্র আমাদের দিতে পারবে? এই মঙ্গল শোভাযাত্রা কি সেই আলোর দিন ফেরাতে পারবে আর কোনদিন? না যদি পারে এই অন্ধ বদ্ধ কুপের আঁধার কেটে আলো আনতে, তবে কার মঙ্গলে এই বিশ্ব ঐতিহ্যের শোভাযাত্রা ?

লেখক: নারীবাদী লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ