X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নারীর পেশাজীবন কি মানতে পেরেছে পুরুষ?

সাদিয়া নাসরিন
১৩ জুন ২০১৭, ১৬:১০আপডেট : ১৩ জুন ২০১৭, ১৬:১৩

সাদিয়া নাসরিন অফিসে জরুরি মিটিং ছিল। অথচ রুমা আজও অফিস যেতে পারেনি। গত দুদিন ধরে ছেলেটির জ্বর। রুমার স্বামী ইমরুল ঠিকই অফিস ট্যুর করতে ঢাকার বাইরে চলে গেলো। শাশুড়ি তার তিনজন  ছেলেমেয়ে সহ এই বাসাতেই থাকেন। কিন্তু তার ১১ মাসের ছেলেটিকে দেখার কেউ নেই। বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্য একটা মেয়ে আছে। কিন্তু তাকে শ্বাশুড়ি নিজের কাজে ব্যস্ত রাখেন ইচ্ছে করেই। তবু তার কাছে বাচ্চা রেখেই অফিস যায় সে। গত দুদিন ধরে মেয়েটি বাড়ি গেছে বলে অফিস আর অসুস্থ সন্তান নিয়ে শর্ষে ফুল দেখছে রুমা। ইমরুলকে জানাতেই সে বলে, তোমার মতো ফালতু চাকরি আমি করি না যে এইসব ঘ্যানঘ্যান করার জন্য বারবার কাজের সময়ে ফোন করে আমাকে বিরক্ত করবে। একটা সময় সে বসের সাথে কথা বলে বাচ্চা নিয়েই অফিসে যায়। কিন্তু অফিসে বেবি স্পেস নেই। তাই সে সমাধান ও বেশিদিন ধোপে টেকে না। এক সময় আর চালিয়ে যেতে পারে না এতোগুলো মানুষের অসহযোগীতার বিরুদ্ধে চাকরিটা করে যেতে। মাতৃত্বের দায় শোধ করার জন্য জীবনের দরজা জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে কাজটা ছেড়ে দেয়।
২.
পেশাজীবনের জন্য নয়, সংসারের প্রয়োজনেই ফার্মের এই চাকরিটা করে ঊর্মি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তামীমকে। এখনও তেমন কিছু কাজ জুটিয়ে উঠতে পারেনি। অথচ বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর মাতলামিটা সমানে চলে। মাঝরাতে ঘরে ফেরে মেঝে ভাসিয়ে বমি করে দুপুর অবধি ঘুমায়। আর ভোর পাঁচটায় ওঠে নাস্তা বানিয়ে, মেয়েকে স্কুলের জন্য রেডি করে, নিজে রেডি হয়ে, মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে তারপর অফিসের জন্য বাসের লাইনে দাঁড়াতে পারে। যখন বাসা থেকে বের হয়, ঘরের লকটা ও বাইরে থেকেই ঊর্মিকে করতে হয়। তিনি আবার ঘুম ভেঙে উঠতে পারেন না কিনা! নিজে কিছু করে না, অথচ ঊর্মীর চাকরি করা নিয়ে ষোলআনা কমপ্লেক্স আছে তামীমের। তাই যতোভাবে সম্ভব শারীরিক-মানসিক ভাবে চাপে রাখে। অন্যদিকে চাকরির প্রয়োজনটা তার বেশি বলেই মনে হয় বেছে বেছে তাকেই বিকেলের এসাইনমেন্টগুলো দেওয়া হয় অফিসে। আর ফিরতে দেরী হলেই তামীম তো আছেই সন্দেহ, খিস্তি আর ব্যঙ্গ করার জন্য। এর মধ্যেই দাঁতে দাঁত চেপে কাজটা চালিয়ে যায়, আরও অনেক রোজগেরে নারীর মতো দুহাতে ঢেউ ঠেলে ঠেলে।

৩.
রেবা সকাল থেকে অনেকক্ষণ কন্সেলর লাগিয়েও মুখের বাঁপাশের কালশিটে দাগটা লুকোতে পারে না। অথচ আজ ইউএস এম্বেসিতে প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। কাল সেই প্রেজেন্টেশন রেডি করতে গয়েই দেরী হয়েছে বাসায় ফিরতে। রেবার বস শাহেদ চাইলেই আরও আগে তার প্রেজেন্টেশন এপ্রুভ করতে পারতো। কিন্তু যেহেতু রেবার বাসায় ফেরার তাড়া ছিল তিনি ইচ্ছে করেই শেষ সময়ে মিটিংয়ে বসে গেলেন, সে মিটিং শেষ করলেন রাত আটটায়। এর পর লাইনের বাস, ঠেলাঠেলি করে বাসায় ফিরতে রাত দশটা। বাসায় ঢুকতেই এমন বিশ্রি আচরণ করলো আজিম। কথা কাটাকাটি, শেষ পর্যন্ত রেবার গায়ে হাত তুলেছে আজিম।

কিছুদিন আগে একটা পাবলিক পোস্ট দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম নারী কেন পেশা জীবন থেকে ছিটকে পড়ে? সাপোর্ট সিস্টেম এর অভাব? পরিবারের সদস্যদের অসহযোগিতা? নাকি, পেশাগত প্রতিযোগিতার লড়াইয়ে সার্ভাইভ করার যোগ্যতা কিংবা মনোবলের অভাব? অনেক মূল্যবান মন্তব্য পেয়েছি। আবার এমন অনেক নারীর বেদনাগাঁথায় ভর্তি হয়ে আছে আমার ইনবক্স। এই পোস্টে আমার বন্ধু নাহিদ সুলতানা চমৎকার মন্তব্য করেছেন, ‘...নারীর যে একটা পেশা জীবন হবে সেটাই তো সিরিয়াসলি কেউ নেয় না! পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্র্যাকটিসগুলোতে কোথাও এই প্রমাণ নেই যে, নারী একটা পেশা জীবনের অধিকারী হবেন এবং দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা, শিক্ষা ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে’। 

মূলত পুরুষতান্ত্রিক মাইন্ডসেট নারীর পেশাজীবন মানতে পারে না।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ‘বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদন – ২০১৫’ এর মতে, ২০১৪ সালের তুলনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ দুই ধাপ পিছিয়েছে। অগ্রগতির এই হার অব্যাহত থাকলে নারী-পুরুষের সমতা আসতে ১১৮ বছর লাগবে বলে এই প্রতিবেদনে বলা হয়। বিশ্বব্যাংকের ‘নারী ব্যবসা ও আইন-২০১৬’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে নারীর পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নারীরা কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে বৈষম্যের শিকার। পারিবারিক সহিংসতা ও সামজিক  বৈষম্যকে মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে নারীদের। জাতীয় শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, দেশের ৮ লাখ নারী শ্রমিকের সবাই মজুরি বৈষম্যের শিকার। একই কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা গড়ে ১৮৪ টাকা পেলেও নারী শ্রমিকরা পান ১৭০ টাকা।  

তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণে না গিয়ে বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মাইন্ডসেট পড়ার চেষ্টা করি চলুন। এই মাইন্ডসেট এর কারণেই পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ হয়ে রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, ‘ঘরেই নারীর সিংহাসন। সেখানেই তাদের রাজত্ব, প্রকৃতিদত্ত কাজের স্থান।’ এখনও পেশা জীবনের ঘরে নারীর জন্য থেকে ‘হাউজ ওয়াইফ’ এর অপশন। আজব জিনিস এই হাউজ ওয়াইফ! যেন, যে নারী চাকরি করেন সে হাউজের বাইরের ওয়াইফ...! এই পুরুষতান্ত্রিক মাইন্ডসেটকে মোকাবিলা করে  নারী কিভাবে পেশা জীবনে এগিয়ে যায় সেটিই তো মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।  

এ ধরনের অর্ধিশিক্ষিত কূটতর্ক করার পুরুষরা জানেন না যে, পৃথিবীর সব সভ্য দেশেই শিশুরা রাষ্ট্রের সম্পদ। সে সব দেশে রাষ্ট্রই শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়, রাষ্ট্রের উদ্যোগে কর্মস্থলে এবং সুবিধাজনক স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্পন্ন শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র থাকে। তারপরেও যে মা সন্তান পালনের জন্য কর্মজীবন থেকে দূরে থাকতে চায় তার জন্য মাতৃত্ব ভাতা আছে। আর আমাদের দেশে নারীকেই বাচ্চাকে ঘণ্টার মতো গলায় ঝুলিয়ে অফিসে নিয়ে আসতে হয়, কারণ আমাদের পরিবারের অসভ্য সদস্যরা সে দায়িত্ব পালন না করে নারীকেই মা হওয়ার দায়ে আসামী বানিয়ে রাখে আর সমাজ- রাষ্ট্র পপকর্ন নিয়ে বসে মাতৃত্বের দম আর ত্যাজ উপভোগ করে।

এই দেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য পরবর্তী দুই/তিন বছরের কর্মচুক্তির বন্ড নেওয়া হয়। গণমাধ্যমে কাজ করা নারীদের দুর্গতি নিজের চোখেই দেখছি। পুরুষতান্ত্রিক মগজের পুরুষ বসরা মাঝরাত পর্যন্ত নারীকর্মীদের এসাইনমেন্টে রেখে নির্বিকার ভাবেই বলেন, পুরুষ রাত বারোটায় ফিরতে পারলে নারীও যদি না পারে তবে কিসের সমান অধিকার? এইসব অর্ধশিক্ষিত পুরুষরা কি জানেন না, কেবল পুরুষের কাছেই আছে নারী ধর্ষণের অমোঘ অস্ত্র যা যখন খুশি তাক করা যায় নারীর দিকে? হোক সে নারী সাংবাদিক, পুলিশ, নাট্যকর্মী।

তারপরেও যে সত্যিটা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না তা হলো, এখনও অনেক নারী পেশাগত জীবনে আসার ঝুঁকিই নিতে চান না। আবার অনেক নারীই ঘরে বাইরে দক্ষতা প্রমাণের চাপ মোকাবিলা করে সার্ভাইভ করার মতো মনোবল ধরে রাখতে পারেন না। কারণ, বাস্তবতা হচ্ছে,  যে পরিমাণ নারী বাইরের কাজে এসেছে, সে পরিমাণ পুরুষ ঘরের কাজে ঢুকেনি পুরুষ।

সুতরাং নারী পুরুষের সমান স্ট্রেস নিতে পারে না বা কাজ করতে পারে না ভেবে আত্মশ্লাঘা বোধ করার কিছু নেই পুরুষের। কারণ, পুরুষের তুলনায় নারীরা অধিক পরিশ্রমী, হাতের কাজে নিপুন এবং পেশাগত আচরণে সুশৃঙ্খল বলেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে  ৮০ ভাগ কর্মীই নারী শ্রমিকদেরই অগ্রধিকার দেওয়া হয়। 

পুরুষ যেখানে শুধুমাত্র রোজগার করেই সর্বশক্তি ক্ষয় করে ক্লান্ত হয়ে যায়, সেখানে নারী একাধারে রোজগার করে অন্যদিকে সামাজিক, মানসিক, শারীরিক এবং প্রথাগত দায়িত্ব পালন করে নিরলস ভাবে। দ্বিগুণ দিন, দ্বিগুন বোঝা, দ্বিগুন কাজ করে এবং অর্থের বিনিময়ে কাজের বোঝা এবং বিনা মজুরির কাজের বোঝা দুই-ই টেনে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে চলে নারীরা। এই দ্বিগুন ভার আর নিরাপত্তাহীনতার চাপ অনেক সময়ই নারীকে ক্যারিয়ার প্লান করা, প্রশিক্ষণ নেওয়া, ভালো কাজের সুযোগ খোঁজা এবং পেশাগত উন্নতির পথে বাঁধা দেয়। তারপরও অসংখ্য নারী স্রোতের উল্টে সাঁতার কেটেই পেশাজীবনের কঠিন সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন সফলতার সাথেই, পুরুষকে পেছনে ফেলে চড়ে বসছেন এভারেস্ট এর উচ্চতায়।

সুতরাং পুরনো ধারণাকে ফেলে দিয়ে এই জীবনযুদ্ধ জয় করে আসা আধুনিক নারীদের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে পুরষকে। তার জন্য সংশোধন করতে হবে এতোদিনের সেবা নেওয়ার বদভ্যাসগুলোর। তাই ঘরের কাজে একটু হাত লাগান সময় থাকতেই। মানছি, হঠাৎ অভ্যাস পাল্টাতে একটু কষ্ট হবে বৈকি! কিন্তু দেখবেন একবার পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারলে নিজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিজেই চমৎকার উপভোগ করবেন। বোনাস হিসেবে পাবেন একজন সঙ্গী, সহযোগী বন্ধু। নাই বা হলো সে অনুগত স্ত্রী কিংবা বিনামূল্যের ‘পার্মানেন্ট বুয়া’!

লেখক: নারীবাদী লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ