মৃত্যুর আবার কাছের কী আর দূরের কী! এরপরও এমন শিরোনামটি নেওয়ার কারণ এখানে বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে এক বাংলাদেশি সৃষ্টি সুখের উল্লাসী তরুণের জীবনের শেষ অঙ্ক মৃত্যু নিয়ে লিখবো। যে তার জীবনের বিনিময়ে অস্ট্রেলিয়া দেখতে আসা একদল পর্যটকের জীবন বাঁচিয়েছে। গত ২৫ জুন রোববার অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটোরির রাজধানী ডারউইনে এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশি এই তরুণ ছাত্রের করুন মৃত্যু হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাংলাদেশে একটি নৈমত্তিক ঘটনা। অবস্থা যেন এমন দাঁড়িয়েছে, নামী দামী কেউ বা দুর্ঘটনায় এক সঙ্গে বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু না হলে তা মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করাও হয় না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু অস্ট্রেলিয়ায়ও হয়। কিন্তু তা এখানে অহরহ ঘটনা নয়। কোনও বাংলাদেশির মৃত্যু এখানে বিশেষ করে ছাত্রদের অকাল মৃত্যুর ঘটনা ছোটখাটো প্রবাসী কমিউনিটিকে খুব নাড়া দেয়। কারণ তরুণ ছাত্রটি এদেশে পড়তে এসেছে। অপঘাত মৃত্যুর শিকার হয়ে কফিনের ভেতরে লাশ হয়ে ফেরার জন্যে নয়।
সিডনি থেকে ডারউইন বহুদূর। প্রায় ৫ ঘণ্টার ফ্লাইট। আবহাওয়াও অনেকটা বাংলাদেশের মতো। একটা উদাহরণ দিলে ডারউইন আরও ঘনিষ্ঠ বোঝা যাবে। বাংলাদেশে টেস্ট খেলতে যাবে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল। এ উপলক্ষে তারা কন্ডিশনিং ক্যাম্প করবে ডারউইনে। কারণ ডারউইন বাংলাদেশের মতো। খুব স্বল্প সংখ্যক বাংলাদেশির বাস ডারউইনে। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েসন অব চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয় নামের বাংলাদেশি ছাত্রদের একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ সংগঠন সেখানে আছে।
২৫ জুন রোজার ঈদের দিন ছিল ডারউইনে। দুপুরের পর কয়েক বন্ধু মিলে তিনটা গাড়ি নিয়ে ঈদের বেড়ানো বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। সরু একটি জঙ্গলাকীর্ণ সড়কে হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা একটি টুরিস্ট বাসকে বাঁচাতে গিয়েই দুর্ঘটনার সূত্রপাত। ইরফান মুন্না নামের এক বাংলাদেশি ছাত্র সামনের গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। মুখোমুখি বাসটিকে দেখে তিনি সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাছের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খায় মুন্নার গাড়িটি। সঙ্গে সঙ্গে সেটি বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। সেই গাড়িতে মুন্না সহ ছিলেন চারজন। চালকের পাশের আসনে ছিলেন তাদের এক ফিলিপেনো সহপাঠি। পেছনের আসনের দুই বাংলাদেশি ছাত্র কোনোক্রমে বিধ্বস্ত গাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু তারা বেঁচে গেলেও সারাজীবনের জন্যে বয়ে বেড়ানো এক দুঃস্বপ্নের প্রত্যক্ষদর্শী হন! চোখের সামনে তারা দেখেন আগুনে জ্বলেপুড়ে মরে যাচ্ছেন তাদের প্রিয় মুন্না এবং ফিলিপেনো সহপাঠি। অপর দুটি গাড়ির পাঁচ বাংলাদেশি ছাত্রও কমবেশি আহত হন।
ঈদের দিন এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনা ডারউইন প্রবাসী বাংলাদেশিদের হতভম্ব শোকার্ত করে। এরপর থেকে তারা শুধু কাঁদছেন। কারণ কয়েক ঘণ্টা আগে যে মুন্না তাদের সঙ্গে জামাতে ঈদের নামাজ পড়েছে, ছবি তুলেছে একসঙ্গে তার এমন করুণ মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারেন না। ডারউইন থেকে আমার এক বন্ধু তারেকুর রহমান মর্মন্তুদ ঘটনাটি জানিয়ে চট্টগ্রামে থাকা মুন্নার স্বজনদের খুঁজে বের করতে সহায়তা চান। আমি সহজ পথে এ ব্যাপারে সহায়তা চাই আমার প্রিয় প্রজন্ম চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির। ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে মুন্নার এক চাচা, চাচাতো ভাইর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন রনি।
তাদের কাছে জানতে পারি মুন্নার বাবা-মা থাকেন ওমানে। ঈদ উপলক্ষে তাদের বাংলাদেশে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুঃসংবাদটির কারণে তারা যাত্রা স্থগিত করেছেন। মুন্নার মা’কে এখনও সন্তানের মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হয়নি। তাকে বলা হয়েছে হাসপাতালে আছেন মুন্না। এডিলেইডে মুন্নার এক ভাই থাকেন। ঈদের পরদিন তারও দেশে যাওয়ার টিকেট কাটা ছিল। হতভম্ব অবস্থায় সেও তার যাত্রা স্থগিত করে।
এ পর্যায়ে শুরু হয় এক ধরনের তথ্য ঘাটতি। কারণ অস্ট্রেলিয়ায় এমন কোনও ঘটনা যখন পুলিশের করায়ত্তে চলে যায় তখন পুলিশের বক্তব্য-ব্রিফিং ছাড়া কোনও রিপোর্ট করা যায় না। তথ্যও পাওয়া যায় না। ঘটনার দিন স্থানীয় একটি দৈনিকে দুর্ঘটনায় দু’জন নিহত হওয়ার খবর বেরোয়। কিন্তু পুলিশ যেহেতু কোনও ব্রিফিং করেনি তাই নিহতদের নাম পরিচয় সে রিপোর্টে ছিল না। ঘটনার পরদিন ২৬ জুন ছিল মুন্নার জন্মদিন। এদিন পুলিশের ব্রিফিং সহ একটি রিপোর্ট করে এদেশের অন্যতম প্রধান টিভি স্টেশন চ্যানেল নাইন। জন্মদিনের উৎসব কিভাবে শোকের উৎসব হয়ে উঠেছে এমন একটি রিপোর্টে প্রথম ভিকটিমদের নাম-ছবি প্রকাশ করে একটি বেসরকারি বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল। মুন্না এবং তার সহপাঠি নিহত মেয়েটির ফেসবুক আইডি থেকে তাদের ছবিও জুড়ে দেওয়া হয় ওই চ্যানেলে। কিন্তু পরের দিনই একটি অনুরোধে টিভি চ্যানেলটি রিপোর্টের ভিডিওটি সরিয়ে ফেলে বা মুছে দেয়। ফিলিপাইন থেকে নিহত মেয়েটির স্বজনরা ফোন করে চ্যানেলটিকে অনুরোধ করে। কারণ নিহত মেয়েটির দেশে একটি শিশু সন্তান আছে। অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার এমন নানান দায়িত্বশীল ভূমিকা দেখে শেখার মতো।
মুন্নার মৃতদেহ সংগ্রহে প্রথম থেকে তথ্য সংকট হয়ে ওঠে বড়। কারণ আইন অনুসারে পুলিশ শুধু স্বজন এবং তাদের অনুমতি সাপেক্ষে তথ্য দেয়। এক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়ায় ক্যানবেরাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন। তাদের সঙ্গে পুলিশ তথা অস্ট্রেলিয় কর্তৃপক্ষের একটি অফিসিয়াল যোগাযোগ, ই-মেইল করেসপন্ডেড প্রতিষ্ঠিত হয়। ই-মেইল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় ওমানে অবস্থিত মুন্নার বাবার সঙ্গেও। এরপর শুরু হয় পুলিশি আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ হস্তান্তর এবং পরবর্তী প্রক্রিয়ার অপেক্ষা। সৃষ্ট মনখারাপ পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের একটি মিডিয়ার রিপোর্টের ভুল তথ্যে আরও মন খারাপ হয় মুন্নার বন্ধুদের। ওই রিপোর্টে লেখা হয়েছে স্পিডিং’এর কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। রিপোর্টার একটু কথা বলে নিলে ভালো করতেন। অস্ট্রেলিয়ার রাস্তাঘাটে স্পিডিং নৈরাজ্যের সুযোগ কম। পথে পথে ক্যামেরা, পুলিশ। পঞ্চাশ গতিসীমার পথ আমাদের তাই পঞ্চাশ, ষাট-সত্তুর গতিসীমার পথ ষাট-সত্তুরই চালাতে হয়। এদেশেরও বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ভিকটিম চালক নয়, পারিপার্শিক পরিস্থিতির কারণে ঘটে। আর মুন্না কোনও আনাড়ি গাড়ি চালকও নয়।
কারণ মুন্না ডারউইনের সেই পাঁচ বাংলাদেশির একজন যারা গাড়ি চালিয়ে আটাশ দিনে পুরো অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ পাড়ি দিয়েছে! এর আগে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কোনও বাংলাদেশি গ্রুপ এমন কোনও অভিযানে নেমেছিল বা চিন্তা করেছিল শোনা যায়নি। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ অভিযানের সেই সময়ে সিডনিতে আমাদের মুন্নার সঙ্গে দেখা-সখ্য হয়। সে কারণে মুন্নার ঘটনা আমাদেরও খুব স্পর্শ করেছে। মুন্নাকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র আরেক করুণ পারিবারিক অধ্যায়ও সামনে চলে আসে। ওমানের বাবা মুন্নার বায়োলজিক্যাল বাবা নন। মুন্নার বয়স যখন চার বছর তখন তার সঙ্গে বিয়ে হয় মুন্নার মায়ের। কিন্তু তিনি তাকে সন্তান স্নেহেই এতটুকু নিয়ে এসেছেন। মুন্নার পাসপোর্ট সহ অফিসিয়াল কাগজপত্রে বাবা হিসাবে ওমান প্রবাসী ভদ্রলোকের নামই আছে।
কিন্তু এই সংকটে ডারউইনে মুন্নার সহপাঠীদের কাছে বিষয়টি খোলাসা করে বলেন মুন্নার ওমানের বাবা। তাদের জানানো হয় মুন্নার আসল বাবাকে খবর দেওয়া হয়েছে। সেই ভদ্রলোকের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। এখন থাকেন আমেরিকার নিউইয়র্কে। সেখানকার ছেলে আমাদের সাংবাদিক বন্ধু বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী সোহেল মাহমুদ ও আতাউর বাবুল তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেন। সন্তানের অপমৃত্যুর সংবাদে মানসিকভাবে মুষড়ে পড়া এই পিতা ঘনিষ্ঠ হিসাবেও তাদের বাসায় ডাকেন। আগে আমার পোস্টে ঘটনা জেনে সেই পিতার বক্তব্য সহ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন সোহেল। বুধবার এই একাকী সব হারানো পিতা যখন সিডনিতে ফোন করে তার একটি আকুতি জানান তখন চোখের পানি বাঁধ মানেনি। মুন্নাকে পড়াশুনায় এতদূর নিয়ে আসায় তার বর্তমান পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি অনুরোধ করেন তার বায়োলজিক্যাল বাবা। তার অনুরোধ মুন্নার মৃতদেহ দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলে তাকে যেন একটু আগেভাগে জানানো হয়। ছেলের জানাজা-দাফনে তিনি অংশ নিতে চান। লাশ না হোক একটু জড়িয়ে ধরতে চান কফিন। এভাবে নিহত সন্তানের প্রতি শেষ দায়িত্ব পালনের সুযোগটি চান এক অসহায় বিধ্বস্ত পিতা। এমন আকুতি কোন পাষাণকে না কাঁদাবে?
লেখক: অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী সাংবাদিক