X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

তাজউদ্দীন আহমদ: জন্মদিনে শ্রদ্ধা

শুভ কিবরিয়া
২৩ জুলাই ২০১৭, ১২:২০আপডেট : ২৩ জুলাই ২০১৭, ১৩:২৭

শুভ কিবরিয়া দলবেঁধে চলাটাই রাজনীতির নীতি। তবে দলের মধ্যে সবাই দলবেঁধে চললেও অনেকে আছেন যারা সেই দলে চলেন বটে তবে দলের মধ্যে থেকেও থাকেন সম্পূর্ণ আলাদা। অনেকের মধ্যে থেকেও থাকেন নিজ আলোয় উদ্ভাসিত। কারণ তার থাকে নিজের মতো করে এক ধরনের কর্মপদ্ধতি। আদর্শবাদের প্রশ্নে তিনি থাকেন অবিচল। সততা, দক্ষতা, লক্ষ্যে পৌঁছানোর নিষ্ঠা আর পঠন-পাঠনের এক মননজাত অর্জন তাকে করে তোলে দলের মধ্যে থাকা দলছাড়া এক মানুষ। এক নির্জন পথিক। আমাদের এই ভূ-খণ্ডের রাজনীতিতে তাজউদ্দীন আহমদ (২৩  জুলাই ১৯২৫- ৩ নভেম্বর ১৯৭৫) ছিলেন সেই ঘরানার মানুষ। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ সারথি।
সবার সঙ্গে মিশতেন বটে কিন্তু ছিলেন সবার চাইতে অন্যরকম। কথার চাইতে কাজে বিশ্বাস করতেন। প্রচার আর আওয়াজের চাইতে নীরবতাকে ভাবতেন শ্রেয়। এই শ্রেয়তার বোধ ছিল তার চলনে, বলনে এবং কর্মে। তাই যখন যেখানে প্রয়োজন হয়েছে তিনি তার সর্বোচ্চটা দিয়েছেন। প্রমাণ রেখেছেন ১৯৭১ সালের নয় মাসে বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার অভাবনীয় নেতৃত্ব দিয়ে দেশ স্বাধীন করার মতো এক অসাধারণ কর্ম সম্পাদন করে।
স্বাধীন দেশে অর্থমন্ত্রী হিসাবেও ছিলেন সফল। ১৯৭৪ সালে তাকে মন্ত্রীত্ব ছাড়তে হয় দলের হাইকমান্ডের ইচ্ছায়। কিন্তু তিনি আদর্শ আর ব্যক্তিগত নীতিবোধে কোনও ছাড় দেননি আমৃত্যু। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ জেলখানায় নির্মমভাবে নিহত হওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত তার নীতিবোধ আর দেশপ্রেম ছিল এই ভূ-খণ্ডের রাজনীতিতে এক অনুকরণীয় ঘটনা। তাজউদ্দীন আহমদ রাজনীতিতে, ব্যক্তিজীবনে সর্বত্র তার কাজে রেখেছিলেন নিষ্ঠা, দক্ষতা আর পেশাদার রাষ্ট্রনায়কসুলভ এক নজিরবিহীন আচরণের ছাপ। তার কর্মজীবনের সেরকম দুটি ঘটনার বয়ান তুলে ২৩ জুলাই তার জন্মদিনে তাকে জানাই সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
দুই.
ক.
তাজউদ্দীন আহমদ যখন বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তখনকার সময়ের এক ঘটনার চাক্ষুষ বিবরণ দিয়েছেন মুজিবনগর সরকারের সংস্থাপন সচিব মোহাম্মদ নুরুল কাদের তার লেখা ‘একাত্তর আমার’ বইতে। ঘটনাটি এরকম:-

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের কমিশন প্রদান উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিসহ ঊর্ধ্বতন অনেকেই আছেন সেখানে। প্রথম ব্যাচে কমিশন লাভকারি একজন অফিসার ছিলেন বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে কাছাকাছি পেয়ে শেখ কামাল হয়তো আবেগ আপ্লুত হয়েছিলেন। শেখ কামাল প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসে স্যালুট দিয়ে কাকা সম্বোধন করে ব্যক্তিগত খবরাখবর জানতে চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ কামালের সম্বোধনের জবাবে বললেন, পেশাগত আচরণ প্রত্যাশা করি।

সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামাল আবারও স্যালুট করে, স্যার দুঃখিত বলে নিজ অবস্থানে চলে যায়।

এ দৃশ্য দেখে মোহাম্মদ নুরুল কাদের (সংস্থাপন সচিব) ভাবলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি ছেলেটাকে একটু আদর করতেন কেমন হতো। আবার এও ভাবলেন, যে প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধের কারণে একই শহরে অবস্থানকারি স্ত্রী ও সন্তানদের দেখাশোনা করাও বন্ধ করতে পারেন তার পক্ষেই সম্ভব সকল নিয়কানুন কঠোরভাবে মেনে চলা।

কমিশন অনুষ্ঠান শেষে দেখা গেলো এর ব্যাতিক্রম। প্রধানমন্ত্রী শেখ কামালকে ডেকে আনলেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। বাচ্চা শিশুর মতো মনে হলো ওই মুহূর্তে তাজউদ্দীন আহমদকে।

হু হু করে কেঁদে উঠলেন তিনি।

খ.

১৯৭২-১৯৭৪ সালে তাজউদ্দীন আহমদ যখন অর্থমন্ত্রী তখন তার একান্ত সচিব ছিলেন আবু সাইদ চৌধুরী। এই সরকারি কর্মকর্তা তার কর্মকালীন সময়ের একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন ‘তাজউদ্দীন আহমদ: আলোকের অনন্তধারা-প্রথম খণ্ড’ বইয়ে। ঘটনাটি এরকম:-

তাজউদ্দীন সাহেব সাধারণত আমাকে তার বাসায় যেতে বলতেন না। খুব বিশেষ কোনও কাজ থাকলে যেতে বলতেন। এ ছাড়া আমি যদি যেতাম সেটা আমার ইচ্ছা। সেই সময় রবিবারে ছুটি থাকত। এক শনিবারে আমরা কাজ সেরে রাত ১০টার পর যখন সচিবালয় থেকে ফিরছি সেই মুহূর্তে তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, কাল আমরা কিছু অফিশিয়াল কাজ করবো। আমি পিএ-কে বলে দিয়েছি ফাইলগুলো বেঁধে গাড়িতে দিতে।’
আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম, ‘স্যার, পুরো সপ্তাহ ধরে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত কাজ করছি। আগামীকাল ছুটির দিন, স্যার, আমার তো একটা সংসার আছে।’

তিনি বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, কালকের দিনটা একটু কষ্ট করতে হবে, কারণ কাল আমি কিছু জরুরি ফাইল ছাড়বো। আপনি তো জানেন ফাইলগুলো আমার টেবিলে আছে।’

পরদিন সকালে আমি তার হেয়ার রোডের বাসায় গেলাম। আমি যাওয়ার আগেই তিনি দোতলার বারান্দায় বসে ফাইল দেখা শুরু করেছেন। আমি তার পাশে রাখা চেয়ারে বসলাম। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে একটি ফাইলে লিখছিলেন। প্রায় দুই পৃষ্ঠা মতো লিখে সেটা একবার পড়ে সই করে ‘লিলি, লিলি’ ( বেগম জোহরা তাজউদ্দীন) বলে ডাকতে লাগলেন। বেগম তাজউদ্দীন রুম থেকে বের হয়ে আসতেই তিনি বললেন, ‘ওই প্রমোশন কেসটা আমি অনুমোদন দিয়ে দিলাম।’ বেগম তাজউদ্দীন বললেন, ‘তুমি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী, তুমি তোমার মন্ত্রণালয়ের কাকে প্রমোশন দেবে না দেবে সেটা তোমার ব্যাপার, এর মধ্যে আমার তো বলবার কিছু নেই।’ তাজউদ্দীন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ‘লিলি, তুমি ঠিকই বলেছ, কিন্তু এই কেসটার সাথে তোমার একটা সম্পর্ক আছে, তাই তোমাকে জানিয়ে রাখলাম।’ আমি তাজউদ্দীন সাহেবের কথা শুনে ভাবছিলাম ব্যাপারটা কী। ঠিক ওই সময় মুখে প্রশান্তির হাসি নিয়ে তিনি আমার দিকে সেই ফাইলটা এগিয়ে দিলেন।

আমি আগাগোড়া ফাইলটি পড়লাম। একজন কর কর্মকর্তার পদোন্নতির ফাইল। নিচ থেকে নোটিং হয়ে উপরে এসেছে এবং পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তবে লেখা হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়টি বিবেচ্য।

তাজউদ্দীন সাহেব রেফারেন্স দিয়ে দিয়ে লিখেছেন এবং যার সারমর্ম হচ্ছে: আমি তাঁর এসিআরগুলো দেখলাম। চাকুরি জীবনের রেকর্ড অনুযায়ী তাঁর পদোন্নতি পাওয়া উচিত। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বিতর্কিত ভূমিকা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। কারো প্রতি সন্দেহবশত কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না। যদি তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকে তবে তা আলাদাভাবে উত্থাপন করা যেতে পারে। যেহেতু নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ এখানে দেখানো হয়নি বা কোন প্রমাণও নেই, তাই আমি বিষয়টিকে বিবেচনার মধ্যে না এনে তাঁর এই পদোন্নতি অনুমোদন করলাম। পড়া শেষ করে বললাম, ‘স্যার, এখনও বুঝিনি ব্যাপারটা যে কী, আর ভাবীকেই বা আপনি ওই কথা বললেন কেন!’

এবার তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর মুহূর্ত কয়েক আগে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু লিলি যেতে পারেনি, ভাড়াটে সেজে কপালগুণে আর্মির হাত থেকে ছোট দুটো বাচ্চাসহ রক্ষা পায়। তারপর একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ঘুরতে ঘুরতে ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডের লেকের পাশে পরিচিত এক ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে ওঠে পাঁচ বছরের মিমি আর এক বছরের সোহেলকে নিয়ে। সে সময় ভদ্রলোক বাসায় ছিলেন না। ফিরে এসে লিলির উপস্থিতি পছন্দ করলেন না। রাতে কারফিউয়ের মধ্যেই সেই ভদ্রলোক বললেন, আমার বাড়িটা তো একদম বড় রাস্তার পাশে, যদি আর্মি এখানে এসে পড়ে তবে সবার অসুবিধা হবে। তাই আপনি আমার সাথে আসুন, আমি আপনাকে দুটো বাড়ি পরে রেখে আসি। লিলি সেই রাতে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ভদ্রলোকের সাথে বের হল। বাসার গেটের বাইরে গিয়ে তিনি বললেন, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি একটা জরুরি জিনিস নাকি চাবি ফেলে এসেছি, এক মিনিটে নিয়ে আসছি।

ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে কাঠের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লিলি আবার ভেতরে ঢুকে দরজায় কড়া নাড়ল, বেল বাজাল, কিন্তু ভেতর থেকে কেউ আর দরজা খুলল না। তখন আর কোনও উপায় না দেখে লিলি সমস্ত রাত রাস্তার ওপর বাড়ি তৈরির জন্য স্তূপ করে রাখা ইটের পাশে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বড় রাস্তায় আর্মির আনাগোনা আর কারফিউয়ের মধ্যে বসে রইল।

‘এবার শুনুন, সেই ভদ্রলোকটিই এই লোক’ আমি যার পদোন্নতির কেস অনুমোদন করলাম। আমি মনে করি আমাদের জীবনের এই ঘটনার সাথে তার চাকরিজীবনকে এক করে দেখা উচিত নয়। কেউ হয়ত কোনোভাবে জেনেছে আমার পরিবারের সাথে তাঁর এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল, তাই তাঁর ফাইলে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার কথা।’

তাজউদ্দীন সাহেবের কথা শেষ হলে আমি থমকে গেলাম। বিস্মিত হয়ে শুধু বললাম, ‘স্যার, ইউ আর আ গ্রেট ম্যান!’ তারপর আমরা আবার অন্যান্য ফাইলগুলো দেখতে শুরু করলাম।

ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সাংঘাতিক নৈর্ব্যাক্তিক একটা মনোভাব ছিল তাজউদ্দীন সাহেবের।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ