X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘দেশে কোনও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি বিরাজমান নেই’

গোলাম মোর্তোজা
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:৩৩আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:৩৬

গোলাম মোর্তোজা পরিষ্কার বিষয় যে, সময় মতো উদ্যোগ না নেওয়ায় এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে না পারায় বা সাধারণ মানুষের দুঃখ- কষ্ট- দুর্ভোগকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করায়, জনজীবনে ভয়ঙ্কর সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বলছি চালের বাজারের কথা। নজীরবিহীন টালবাহানা এবং ইচ্ছে করে সময় ক্ষেপন করে, তিন দফায় চালের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। সংকটের শুরুতে শুল্ক শূন্য বা ২ শতাংশে নামিয়ে আনলে, চাল নিয়ে সংকটের কোনও সম্ভাবনা ছিল না। বিশ্ববাজারে চালের দাম তখন বেশ কম ছিল। মজার বিষয় হলো, সপ্তাহদুয়েক আগে পর্যন্তও ভারত- থাইল্যান্ড - ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে দাম একদম স্বাভাবিক ছিল। এসব দেশ এই মুহূর্তে একটু বেশি চাইছে। বেশি মানে কত বেশি? বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা গত তিন সপ্তাহ বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করছিল কলকাতা থেকে। এলসি খোলার বাইরে হুন্ডি করে টাকা নিয়ে চাল কিনেছে। এর প্রভাব কলকাতার বাজারে পড়েছে। কেজিতে দাম বেড়ে গেছে ২ থেকে ৫ রূপি। সেই প্রভাবের পরেও ১৯ সেপ্টেম্বর কলকাতার বাজারে চালের দাম স্বর্ণা ২২ থেকে ২৭ রূপি কেজি, রত্না ২৮ থেকে ৩০ রূপি কেজি, মিনিকেট ৩২ থেকে ৩৫ রূপি কেজি। এটা কলকাতার বাজারে কেজিতে ২ থেকে ৫ রূপি বৃদ্ধির পরের দাম এবং খোলা বাজারের দাম, পাইকারি বাজারের নয়।
রূপি - টাকার পার্থক্য, ২ শতাংশ শুল্ক, পরিবহন খরচ, ব্যবসায়ীদের লাভ যোগ করলে বাংলাদেশে স্বর্ণার কেজির দাম হতে পারে সর্বোচ্চ ৩২ থেকে ৪০ টাকা। মিনিকেটের দাম হতে পারে সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ঢাকা বাজারে আজ (২০ সেপ্টেম্বর) স্বর্ণা এবং লতা ( মোটা চাল) বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকা কেজি, মিনিকেট ৬৫- ৭০ টাকা কেজি। নাজিরশাইল ৭০ থেকে ৭৪ টাকা কেজি।ভারতের বাজারে পর্যাপ্ত চাল থাকার পরও, জি টু জি পদ্ধতি চাল কেনার আগ্রহ অবিশ্বাস্য রকম কম। সরকার চাল কেনার জন্যে ছুঁটছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম। কী মধু সেখানে, কে জানে!
আমরা জানছি, থাইল্যান্ড থেকে দু’টি জাহাজ ৩২ হাজার ১৪০ টন চাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙরে দাঁড়িয়ে আছে গত ৩০ আগস্ট থেকে। চাল খালাস করা হচ্ছে না। কারণ চাল অত্যন্ত নিম্নমানের। পঁচা গমের পর এখন নিম্নমানের চাল! তাও চাল পরিস্থিতির এই উদ্বেগজনক সময়ে!
মিল মালিক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হুমকি- ধামকি একদিনের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। যত অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল, মিটিং করতে এসে তারা সব অসত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে। ‘দেশের ভেতরে এক কোটি টন চাল আছে’- খাদ্য মন্ত্রীর এই বক্তব্য চালেঞ্জ করলেন ব্যবসায়ীরা। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা তো দূরে থাক, তিন মন্ত্রী চ্যালেঞ্জের জবাবই দিতে পারলেন না ঠিকমত। টেবিল ওয়ার্ক বা খোঁজ- খবর না নিয়ে যে মন্ত্রীরা কথা বলেন, তা আর একবার প্রমাণ হলো। এর মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ীরা আরও ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেন।
মন্ত্রীদের এই অগোছালো অবস্থাটা মাঝে মধ্যে দৃশ্যমান হয়। সরকারের নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ আমলাতন্ত্র। তাদের কাজ, চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় কখনও দৃশ্যমান হয় না। কারণ সাধারণত তারা কথা বলেন না, কথা বলেন রাজনীতিবিদ মন্ত্রীরা। আমলাতন্ত্রের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি সরকারের কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।
চাল পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শুভাশীষ বসুর চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি জানা- বোঝার সুযোগ হয়েছে। পাঠকের সামনে সেটা তুলে ধরতে চাই।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে টেলিফোনে সংযুক্ত হয়েছিলেন সচিব শুভাশীষ বসু। অতিথি ছিলেন সাংবাদিক নাজমুল আশরাফ এবং আমি। চালের মজুদ এবং মিল মালিকদের বিরুদ্ধে সরকারের উদ্যোগ বিষয়ে কথা বলছিলেন তিনি। তার কথার প্রেক্ষিতে আমি যা বলেছিলাম, বিশ্লেষণ ও প্রশ্ন করেছিলাম এবং তিনি যা বলেছিলেন- সেই অংশটুকু তুলে দিলাম:
২.
আপনারা মজুদ দেখার জন্যে, পর্যবেক্ষণ করার জন্যে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে, ডিসি এসপিদেরকে বললেন। এটা কি একটি বিশেষ সময়ে বিশেষ ব্যবস্থা, নাকি এটা আপনাদের একটা চলমান প্রক্রিয়া?
‘মূলত এটা এখনকার পরিস্থিতির কারণেই করা হয়েছে। তার কারণ হলো চালের যে মূল্য, সেই মূল্যটা এখন বাড়তি অবস্থায় রয়েছে। সে কারণে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বাজার মনিটরিংয়ের যে ব্যবস্থা, সেটা কিন্তু নিয়মিতভাবেই করা হয়। সেটা নির্দিষ্ট একটি পণ্যের জন্যে করা হয় না।’
চালের বাজার এখন অস্থিতিশীল, বাজারের ওপর আপনাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনাদের কাছে অর্থাৎ সরকারের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ নেই। আপনারা বলছেন মজুদ আছে ব্যবসায়ীদের কাছে। এই সংকটময় সময়ে আপনারা যখন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন, আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, বিগত ২০০৭-০৮’র সময়েও দেখেছিলাম, ব্যবসায়ীদের ওপর এমন সময়ে এই প্রক্রিয়ায় যদি চাপ প্রয়োগ করা হয় তাহলে পরিস্থিতি উল্টো হয়। মজুদের বিরুদ্ধে অভিযান যদি চলমান প্রক্রিয়া হতো, তবে সমস্যা ছিল না। সরকারের কাছে যদি পর্যাপ্ত মজুদ থাকত তাহলে আপনারা বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু আপনারা ব্যবসায়ীদের ওপর এখন যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অতীত অভিজ্ঞতা বলে এতে সাধারণ জনমানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। আপনি কী মনে করেন?
‘আমি ওই রকম পরিস্থিতির কথা চিন্তা করছি না। তার কারণ হলো, আমরা যে পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণ করছি এটা কারও ওপর চাপ প্রয়োগ করা নয়। আমরা স্বাভাবিকভাবে দেখতে চাচ্ছি যে, মজুদ পরিস্থিতিটা কেমন আছে। এখন কেউ যদি অবৈধভাবে মজুদ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন, সেটা ভিন্নতর কথা। এই জন্যে কারও ওপর কোনও চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে না। আমরা মনে করি সরকারের কাছে যে পরিমাণ চাল মজুদ আছে, এতে সাধারণ মানুষের দূর্ভোগের বিষয়টা এখনও ওই রকম হবে না’।
এটা আসলে আপনি কিসের ভিত্তিতে বলছেন, যে পরিমাণ মজুদ আছে তাতে দুর্ভোগ হবে না? চালের কেজি ১০ টাকা বেড়ে গেলো, তারপরে যদি আপনি বলেন, যে পরিমাণ মজুদ আছে তাতে সাধারণ মানুষের কোনও দুর্ভোগ হবে না, কিসের ভিত্তিতে বলছেন? আপনাকে বিব্রত করা উদ্দেশ্য না, বোঝার জন্যে ভিত্তিটা জানতে চাইছি। ওএমএসের চাল বিক্রি করতে গেলেন। ১৫ টাকার চাল ৩০ টাকা করলেন। দেওয়ার কথা সিদ্ধ চাল, সেখানে আতপ চাল দিচ্ছেন। আর আপনারা বলছেন জনগণের দুর্ভোগ হবে না, প্রভাব পড়বে না। কিসের ভিত্তিতে এসব কথা বলছেন?
‘আমরা যেটা বলছি সেটা হলো যে, দেশে কোনও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি বিরাজমান নেই। কারণ আমি যদি দেখি আমি চাল চাচ্ছি চাল পাচ্ছি না, তখন একটা দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি বিরাজমান থাকতে পারে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি নেই। আপনি যদি বাজারে যান আপনি যে চালই যাচ্ছেন সেই চালই পাচ্ছেন’।
হ্যাঁ, পাচ্ছি। অনেক বেশি দামে পাচ্ছি।
‘সেটাই তো কথা। আপনি তো পাচ্ছেন চাল। সুতরাং...’।
আমার তো টাকা থাকতে হবে। আপনার চালের মজুদ যদি পর্যাপ্ত থেকে থাকে তাহলে ১৫ টাকার চাল ৩০ টাকা করলেন কেন?
‘এখন কথা হলো চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হচ্ছে চালের মূল্য কেন বৃদ্ধি পেয়েছে’।
ব্যবসায়ীরা মূল্য বৃদ্ধি করছে, যেটা বৃদ্ধি করার কথা নয়। আপনারাও এটা মনে করছেন, আমরাও মনে করছি। ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে মূল্য বৃদ্ধি করে মানুষকে জিম্মি করছে। সরকারও মূল্য বৃদ্ধি করে তো সেই অনৈতিকটাকে সমর্থন করে ফেলল। আপনারা দ্বিগুণ করে দিলেন দাম।
‘অনৈতিকভাবে মজুদ করছে কিনা সেই পরিস্থিতিটাই তো আমরা এখন পর্যবেক্ষণ করে দেখছি। কারণ হলো, আপনি জানেন চাল আমদানি করার জন্যে যে শুল্ক ছিল তা ২৮ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে’।
হ্যাঁ, কমিয়ে আনা হয়েছে। কমিয়ে আনার পরে দাম সরকার দ্বিগুণ করে দিল। তার মানে ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোটা আপনি মানে সরকার জাস্টিফাই করছে?
‘সরকার দ্বিগুণ করে দিচ্ছে কোথায়?’
ওএমএসের চাল ১৫ টাকারটা ৩০ টাকা করেছে।
‘করেছে, সরকার করেছে?’
কে করেছে?
‘বাজারে যে টাকায় চাল বিক্রি হচ্ছে এটা তো স্বাভাবিকভাবেই হয়...। ডিমান্ড... সাপ্লাই সিচুয়েশনে এটা হয়...।’
বাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন আপনি?
‘আপনি তো ফ্রি মার্কেট ইকোনমিতে বাজার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবেন’।
আপনার হাতে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই?
‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সর্বতভাবে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে সহায়তা দিচ্ছে। যারা আমদানিকারক আছেন তাদেরকেও কিন্তু আমরা উদ্বুদ্ধ করছি যে, আপনারা চাল আমদানি করেন। আমদানি করার ফলে অ্যাভেলঅ্যাভেলিটি বেড়ে যাবে। অ্যাভেলঅ্যাভেলিটি বেড়ে গেলে, দাম অটোমেটিক্যালি কমে যাবে’।
সেটা হবে তখনই, যদি সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ থাকে। যদি সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকে, ব্যবসায়ীরা প্রায় কেউ-ই ওই পরিমাণ নৈতিকতা নিয়ে ব্যবসা করেন না যে, জনগণের দুর্ভোগ হবে ভেবে তারা দাম বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগবেন না।
৩.
এই আলোচনা যেদিন হয়েছিল তার পরের দিনই সরকার মিল মালিক- চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করেছে। আগের দিন মন্ত্রী যাকে ধরার জন্যে পুলিশ পাঠিয়েছেন, পরের দিন তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে যুক্তি- তর্ক বা ঝগড়া করে বিজয়ী হয়ে দাপটের সঙ্গে ফিরে গেছেন। সরকার ব্যবসায়ীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা চালের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে জনজীবনে যে গভীর সঙ্কট তৈরি হয়েছে, সরকার আদৌ তা অনুধাবন করছেন বলেই মনে হচ্ছে না। সরকারের বাণিজ্য সচিবের বক্তব্য থেকে সেই বিষয়টি বেশ পরিষ্কারভাবেই বেড়িয়ে এসেছে। ‘দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি’ তৈরি না হওয়ায় সম্ভবত সরকার খুব একটা চিন্তিত নয়!
বাণিজ্য সচিবের বক্তব্যকে তার ব্যক্তিগত বক্তব্য হিসেবে ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারের ভেতরের আলোচনা, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটেছে সচিবের বক্তব্যে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে দুদক
রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির অভিযোগবিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে দুদক
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ