X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানুষ এখন দ্বিধাগ্রস্ত এবং প্রচারণায় বিভ্রান্ত

সৈয়দা আখতার জাহান
০২ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:০৮আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:১৭

সৈয়দা আখতার জাহান আমি যে ইমারতে থাকি তার বাহিরটা রঙ করা হচ্ছে। দু’জন রঙমিস্ত্রি রঙের কাজ করছেন আর সঙ্গে চলছে নিজের মধ্যে গল্প। বাসায় থাকার সুবাদে তাদের কিছু কিছু গল্প কানে আসছিল। গল্পে বিষয় ছিল দেশ, দ্রব্যমূল্য, জলবদ্ধতা আর সাম্প্রতিক ইস্যুতে সরকারের গৃহিত সিদ্ধান্ত। ফেসবুক বন্ধ করে আমি তাদের গল্পে মনোযোগ দেই। বলাই বাহুল্য সেই গল্পে গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক মাধ্যমের বাইরেও যে জনমত তৈরি হচ্ছে সে বিষয়টাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষও এখন অনেক তথ্য রাখেন আর সেগুলো নিয়ে নিজের গণ্ডিতে মতামত প্রকাশ করেন। মাঝে মধ্যে সামাজিক মাধ্যম আর গণমাধ্যমের আলোচনায় বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাই। তবে স্ক্রিনের বাইরে যা বাস্তবতা সেখানে সংকটগুলো বড় জীবনমুখী। সে জীবনে সাধ ও সাধ্যের সঙ্গতি সবসময় মেলে না। সেখানে রোদের তাপ বাড়ে, বর্ষায় জল জমে, লোডশেডিং হয়, আর দ্রব্যমূল্য লাগামহীন।
গণমাধ্যম গণমানুষের তথ্য প্রাপ্তির মাধ্যম। গণমাধ্যম তাই জনমত তৈরিতে যে ভূমিকা রাখে সে বিষয়ে দ্বিমত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তবে সে ভূমিকা লঘু না গুরু সেই বাহাস চলতে পারে। প্রশ্ন হতে পারে, জনমত কী? জনমত হলো জন সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গী যা তারা প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পোষণ করেন, অনুকূল পরিবেশে প্রকাশ করেন এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্মরণ করেন। যদিও সব মতামতের সরব প্রকাশের ব্যাপারটা সবসময় হয় না। কেননা যারা গুরুমতের বিপরীতে অবস্থান করেন; যে মত যাকে আমরা লঘুমত বলতে পারি, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে নীরব এবং নিশ্চুপ। যাকে যোগাযোগের ভাষায় বলা হয় ‘স্পাইরাল অব সাইলেন্স’ বা নীরবতার কুণ্ডলী তত্ত্ব। অনেক ক্ষেত্রেই দেশীয় বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে প্রপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাশীনরা জনমতকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নেন। গণমাধ্যম মোটেও জনমতের দর্পন নয় বরং জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তারক। মানুষ বুঝে গেছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্ট। তাই মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মন-মানসিকতাকে খুব বেশি প্রভাবিত করা যাচ্ছে না। তাই তো আমেরিকার নির্বাচনে জনমত জরিপ ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।

সংখ্যাগুরুদের মতামত যেহেতু অনবরত এবং বারবার প্রকাশ পায় তাই অনেকেই ধরে নেন যে, যেহেতু বার বার শোনা যাচ্ছে সেহেতু দেশের সব মানুষ বিষয়টাকে সমর্থন করেন। আসলে বাস্তবে তেমনটা নাও হতে পারে। বরং যে মতটা নিরুদ্ধ থাকে, গোপন থাকে কিংবা সংখ্যায় কম বার প্রকাশ পায় সেটাকে অর্থহীন বা দুর্বল বলে ভাবাটা অনুচিত। অনেক ক্ষেত্রেই গোষ্ঠীগত চাপের কারণে পুরস্কার কিংবা শাস্তির বিধান জনমত প্রকাশকে প্রভাবিত করে। লঘুমতের দুর্বলতা তারা সমাজে সম্পূর্ণ নতুন কোনও ধারার জন্য, নতুন কোনও সংস্কৃতির জন্য মত দেয় না। বরং প্রচলিত এবং বিদ্যমান জনমতের বিপরীতে নিজেদের ভিন্নমতটাই প্রকাশ করে থাকেন। 

লঘুমত কেন নীরব থাকে? নীরব থাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে। কিংবা আলাদা করে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে। লঘুমত পোষণকারীদের মধ্যে থাকে নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কাও। তবে যারা লঘুমত ধারণ করেন এবং তা প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন তাতে এমন নয় যে, তারা তাদের মত পাল্টে ফেলেন। শুধু বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কায় নিজেদের অভিমত চেপে রাখেন। তবে হ্যাঁ, লঘুমতও সোচ্চার হয় তবে বিস্তার হয় না। সোচ্চার লঘুকণ্ঠ বা ‘ভোকাল মাইনোরিটি’ নিজেদের মতামত প্রকাশ করেন এবং তার মতামতকে কে গুরুত্ব দিলো আর কে দিলো না সেটা তাদের মাথাব্যথার কারণ হয় না। তারা জানে হারাবার কিছু নেই। তারা নিজেদের ‘মোরাল হিরো’ বলে মনে করেন। বিচ্ছিন্নতাকে তারা তাদের নিয়তি বলে ধরে নেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে জনমত প্রকাশিত হয় সেটাই সবসময় বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়। কেননা জনগণ তো শুধু শহরে থাকে, প্রত্যন্ত গ্রামেও থাকে। তাদের কাছে প্রযুক্তি নাই তবে অসন্তোষ আছে। অনেক অসন্তোষ সাধারণ মানুষ মুখে প্রকাশ করে বরং মাথায় রাখে। এবং অনুকূল পরিবেশে তা প্রকাশও করে। মুক্ত মতামত প্রকাশের দ্বার যদি রুদ্ধ থাকে তাতে ‘বুমেরাং ইফেক্ট’-এর সম্ভাবনা বাড়ে। গণমাধ্যম হয়ে ওঠে শ্রেণিমাধ্যম। অনেকেই স্বার্থহাসিলের জন্য গুরুমতের অনুসারী হন। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণের মতামত নয় বরং নির্মিত জনমতকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আসলে ‘দায়িত্বশীল গণমাধ্যম’ কথাটা এখন আড়ম্বরি মাত্র!  

পুরনো ক্ষোভ, গ্লানি-অপমান আর নির্যাতিত হওয়ার অভিজ্ঞতা মানুষের মনে থেকে যায়। একটা পর্যায়ে তা প্রকাশ পায়। যাকে বলা হয় ‘গানি-সাকিং’। একটা না একটা সময় লঘুমতও ঘুরে দাঁড়াতে পারে, প্রতিবাদে মুখর হয়ে বিক্ষোভ করতে পারে আবার দাবি আদায়ে সোচ্চারো হতে পারে। ঘটাতে পারে ক্ষমতার পালাবদল। স্ট্র্যাটেজিক সাইলেন্স বা কৌশলগত কারণেও অনেক ক্ষেত্রে জনসাধারণ নিশ্চুপ থাকে। তবে রাতের অন্ধকারের ব্যাপারে সান্ধ্যকালীন পূর্বাভাস বলে একটা কথা থেকেই যায়। কাঁচের ভেতরে থেকে বাইরের সবকিছু সুন্দর! কেউ কেউ সিদ্ধান্ত শুধু জানানই দেন না, সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে বাধ্য করার চেষ্টা তদবিরও চালান। ঢাকা শহরে সবকিছু ঢেকে রাখা গেলেও দুর্গন্ধ ঢেকে রাখা যায় না। প্রত্যেকটা নীতিহীনতাই স্বতন্ত্র। অপেক্ষাকৃত সহনীয় দুর্নীতিপরায়ন বলে কিছু নেই। অথচ এই নির্দয় দাম্ভিক সময়ে ভাববার অবকাশ আমাদের কারোর-ই তেমন নেই। সবারই নিজের আখের গোছানোর চিন্তা।

ক্ষমতার তেজস্ক্রিয়তায় সমাজ ভুলতে বসেছে সততা, নিষ্ঠা আর কর্তব্যবোধের কথা। সমাজ বলে আসলে আলাদা কিছু নেই, ব্যক্তি পুরুষ আর ব্যক্তি নারী মিলেই তো সমাজ। অথচ আমাদের মধ্যে নেই কোনও কমিউনিটি ফিলিং! নিয়মানুসারে নয় বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই চলছে চারপাশ। ক্ষমতাবানরা একে অন্যকে ব্যবহার করে, যদিও সেটা প্রীতিগত ভাবেই করা হয়। তাই তো গাড়ি ঘোড়া চড়তে এযুগে হতে হয় দুর্নীতিবাজ। যে যতবড় দুর্নীতি করতে পারে, সে তত দামি গাড়ি চড়ে। শাসক শ্রেণির মতাদর্শ কিংবা সিদ্ধান্ত, তাদের শ্রেণিস্বার্থেই পরিচালিত হয়। তাই তো দুর্নীতিকে ‘না’ বলার প্রচারণা চলে আয়োজন করে। হ্যাঁ, ভালো পদও খারাপ লোকের অধীনে থাকতে পারে, যেমন ভালো গাড়ি থাকে অদক্ষ চালকের অধীনে। তবে তা কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ সেটা আলাদা করে বুঝিয়ে বলার দরকার নাই।

সামান্য অভাব আর পরিমিত প্রয়োজনের নামই জীবন। যা হবে নির্ভেজাল আর জটিলতামুক্ত। অথচ চরম নিয়ন্ত্রিত আবার অসীম ভোগবাদী সময়ে অপরাধের নিজস্ব কোনও মানদণ্ড নাই। বাজার অর্থনীতিতে ফুলিয়ে ফাপিয়ে মানুষকে স্বভাব অভাবী করে তোলা হচ্ছে। জৌলুস এখন সর্বত্র। অভাব কখনোই সর্বশেষ বলে স্থির হয় না। বরং একটা অভাববোধ আরেকটা অভাববোধের জন্ম দেয়। এবং প্রক্রিয়াটি চলমান। এখন উৎসব মানে কেনাকাটা। উৎসব মানে সামাজিকতা নয়। আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব আর অনাত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটানো নয়। সেটা এখন ‘হ্যাং আউট’। মানুষ তাই ঐতিহ্যগত পথে হাঁটবে নাকি বিশ্বায়নের দিকে এগুবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বিকল্প নেই বলে বিষ খাচ্ছি আমরা, কখনও জেনে আর কখনওবা না জেনেই। 

প্রতিবাদী হওয়ার সৎ শিক্ষাটা পরিবার থেকেই পাওয়ার কথা। অথচ প্রতিনিয়ত প্রতিবাদহীন ঘৃণাবোধ নিয়ে বড় হচ্ছে আমাদের সন্তানরা। নৈতিক সম্পদ আজ কোথায়? কর্মশালার আয়োজন করে কাউকে সৎ বানানো যায় না। সততার ঘাটতি কোনও কিছু দিয়েই পূরণ করার নয়। পারিবারিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে তা থাকতে হয়। যা নিয়ত চর্চার বিষয়। অথচ সবর্ত্র আজ স্থুল রুচির বহিঃপ্রকাশ। চর্চা হচ্ছে ‘ভুল স্বীকার না করার সংস্কৃতির’। চলছে একে অন্য দোষারোপ করার প্রতিযোগিতা। চাকচিক্যময় জৌলুসে ভরা এই সময়টার ভিতরটা বড় শূন্য! বড় নির্দয় আর দাম্ভিক এই সময়ে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ে সারাক্ষণ সিটিয়ে থাকতে হয়। সামাজিক চাপ আমাদের মনস্তত্ত্বকে সংকীর্ণ করে দিচ্ছে, আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে সহনীয়ভাবে সুখি হতে। যেখানে অবিরাম মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অনিবার্য অস্তিত্ব বিদ্যমান। ব্যক্তিচরিত্রগুলোও একটা নির্দিষ্ট ছকে বন্দি, যদি- তবে’র ফাঁদ পাতা ভুবনে। সব ক্ষেত্রে সব কিছুতেই শর্ত প্রযোজ্য। আগে শর্ত পূরণ করো তারপর কাঙ্ক্ষিত সাফল্যকে উপভোগ করা। মানুষ এখন এমন জীবনমান গ্রহণে বাধ্য যা সময়ের অবক্ষয়িত মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। আর ভালো মানুষ হতে চাইলে মুখটাকে বন্ধ রাখতে হয়।

এ এক আশ্চর্য সময়! সবাই স্বার্থপর। সব কাজের পেছনে লোভ কাজ করে। মানুষের মধ্যে বিনয়, মমতা, সহমর্মিতা এসবই দূর্লভ এখন। চরিত্র গঠন, আত্মিক উন্নয়নের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার নেই। মানুষ এখন দ্বিধাগ্রস্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত। নানা ধরনের প্রচারণায় বিভ্রান্ত। যা মানুষের ব্যক্তিগত ও জাতীয় আচরণের প্রকাশ পাচ্ছে। সামাজিক বৈষম্য মানুষকে ক্রমাগত হীন, ক্ষুদ্র করে তুলছে। বিদ্যমান বৈষম্য বোঝার জন্য মাইক্রোস্কোপ বা টেলিস্কোপের দরকার নাই। পৃথিবীর কোথাও যদি ক্ষমার অযোগ্য কিছু ঘটতে থাকে, তাহলে মানুষের তা জানা উচিত, তা নিয়ে ভাবা উচিত এবং পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করা উচিত। জীবনের অসংখ্য স্ববিরোধিতা রয়েছে। রয়েছে যৌথ অভিজ্ঞতা। একজনের অন্যজনের প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত ফুটিয়ে তুলতে পারে মানবিক সৌন্দর্য্য। সেখানে শুধু সৎ ইচ্ছাটাই যথেষ্ট নয়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম অধ্যায়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৩ সদস্য আটক
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৩ সদস্য আটক
বাংলাদেশি আমেরিকানদের প্রশংসা করলেন ডোনাল্ড লু
বাংলাদেশি আমেরিকানদের প্রশংসা করলেন ডোনাল্ড লু
মেটা-ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের ডিজিটাল সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ
মেটা-ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের ডিজিটাল সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো যুবকের
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো যুবকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ