X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

আয় বৈষম্য বাড়ে কেন?

শুভ কিবরিয়া
২১ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:৫২আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:৫৪

শুভ কিবরিয়া দুঃশাসন কি বৈষম্য বাড়ায়? এরকম সরাসরি গবেষণা হয়তো নেই, হয়তো আছে, আমার জানা নেই। তবে, কানকথা বলে দুঃশাসন বাড়লে, সুশাসনের গতি কমে। সুশাসনের অভাবের ফলে সরল অর্থনীতি অনেক পকেট অর্থনীতির জন্ম দেয়। দুঃশাসনের সুইচ যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা তো বটেই, তাদের দলবল, আত্মীয়স্বজন, চেনা-পরিচিতিজন নানাভাবে ক্ষমতা বিস্তার করে অন্যায়ভাবে প্রভাব খাটিয়ে নানা নয়ছয় করে। তারা নিয়ম-নীতি মানার চাইতে ভাঙতে পছন্দ করেন। নিয়ম-নীতি অন্যায়ভাবে ভেঙে দুঃশাসনের সুবিধাভোগী এসব ক্ষমতাবানরা কোনও চ্যারিটি করে না। তারা যা করে, তা হচ্ছে অবৈধ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ টাকা বানায়। অন্যের হক মেরে দেয়। ফলে অর্থনীতি নানান অন্যায্য বুদবুদে ফুলে উঠলেও, বাজেট দিনকে দিনকে বড় হতে থাকলেও তার সুফল বিশেষ ওই গোষ্ঠীটির পকেটেই যায়। ক্ষমতাবানদের স্থানীয় পকেট ভরে ওঠার পর বিদেশি পকেটও ওই দুঃশাসনের সুফলজাত ডলার-পাউন্ডে ভরে ওঠে। ফলে আর যাই হোক দুঃশাসন একশ্রেণির নতুন টাকাওয়ালার জন্ম দেয়। আর এর বিপরীতে নিঃস্ব হতে থাকে ক্ষমতাকাঠামোর নিচের শ্রেণির একদল মানুষ। এই প্রক্রিয়া দুই দলকে দুই প্রান্তে ঠেলতে থাকে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ দেশের সম্পদের বড় অংশের মালিক বনে যায় আর ব্যাপকসংখ্যক মানুষ নিঃস্ব হতে হতে দেশের খুব সামান্য সম্পদের মালিকানা নিয়ে কোনও রকমে বেঁচে-বর্তে থাকে।

দুই.

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি এক জরিপ প্রকাশ করেছে। ‘সর্বশেষ খানার আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬’ শীর্ষক এই জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ আয় কুক্ষিগত আছে। অন্যদিকে ১০ শতাংশ সবচেয়ে গরিবের কাছে আছে দেশের মোট আয়ের ১ শতাংশ। ২০১০ সালে ছয় বছর আগে বিবিএস এরকম একটা জরিপ করেছিল। সেসময় দেশের দশ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা ছিল মোট আয়ের ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ ছয় বছরে ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর আয় বেড়েছে মোট আয়ের ৩ শতাংশ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১০ সালে দেশের মোট আয় ১০০ টাকা হলে তার ৩৫ টাকা যেত শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর কাছে। এখন যায় ৩৮ টাকা। এই জরিপ বলছে দেশের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মালিক ওপরের দিকে থাকা ৩০ শতাংশ মানুষ।

এটা প্রমাণ করে দেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে। আয় বৈষম্য বাড়ার একটা সূচকের নাম গিনি সহগ। গিনি সহগের মান থাকে শূন্য(০) থেকে এক(০১) এর মধ্যে। গিনি সহগ শূন্য হলে বুঝতে হবে দেশে কোনও আয় বৈষম্য নেই। আর গিনি সহগ ১ হলে বুঝতে হবে দেশে রয়েছে সর্বোচ্চ আয় বৈষম্য। ২০১০ সালে এই গিনি সহগের মান ছিল ০.৪৫। ২০১৬ সালে ছয় বছর পর এই গিনি সহগের মান দাঁড়িয়েছে ০.৪৮। অর্থাৎ বছর বছর দেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে।

এই জরিপ বলছে, দারিদ্র্য কমছে শ্লথগতিতে। দারিদ্র্য কমার গতিও কমেছে আগের তুলনায়। দেশে এখনও ৩ কোটি ৯৩ লাখ দরিদ্র মানুষ আছে। হতদরিদ্রের সংখ্যা ২ কোটি ৮ লাখ। এই জরিপ বলছে, গ্রামে আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ছে। অর্থাৎ গ্রামে একটি পরিবার মাসে যত আয় করে খরচ করে তার চেয়ে বেশি। এটাও খুব সুখকর খবর নয়। এই জরিপের বিবেচনা হচ্ছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতি ১০ জনে একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এসব তথ্য-উপাত্ত বলছে, উন্নয়নের ঢাক যত বেড়েছে তাতে পাল্লা দিয়েই আয় বৈষম্য বাড়ছে। বিপুল আয় যাচ্ছে অল্পসংখ্যক মানুষেরই ঘরে।

তিন.

এখন এই যে আয় বৈষম্য বাড়ছে, অনেক ক্ষমতাহীন মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে আর কিছু ক্ষমতাবান মানুষ ফুলে ফেঁপে বড় হচ্ছে, তার কারণ কী? এটা কি দুঃশাসনের কারণে ঘটছে? দুঃশাসনের সঙ্গে কি এই আয়-বৈষম্য বাড়ার কোনও নিগুঢ় সম্পর্ক আছে? এই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে দেখা যাক আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয় কী বলছেন?

দেশের জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ১৯ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে মান্যবর অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের বিশেষ একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে এই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন তিনি। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের এই মার্কিন মুল্লুক যাত্রা।

এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন,

১. ব্যাংকখাত তেমন ভালো চলছে না। আমাদের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে সরকারি ব্যাংক। কিছু কিছু লুটপাট বেসরকারি ব্যাংকেও দেখা যাচ্ছে। সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারটা খুব বেশি।

২. প্রতিযোগিতা হলে আমাদের অনেক এমপিকে পাস করতে বেগ পেতে হবে। কারণ, আমাদের অনেক এমপি অত্যাচারী, অসৎ। তারা মানুষের কাছ থেকে নানাধরনের টাকা-পয়সা আদায় করেন।

চার.

অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের এই সরল স্বীকারোক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংক খাতের লুটপাটের টাকার অ্যামাউন্ট হাজার হাজার কোটি টাকা বলে অভিযোগ উঠলেও, অর্থমন্ত্রী অতীতে তাকে খুব সামান্য টাকা বলে উল্লেখ করেছেন। তবে, এটা আর লুকাছাপা নেই যে, হলমার্ক দুর্নীতি, বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি, ডেসটিনি দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি- এসব ঘটনার আর্থিক পরিমাণ যাই হোক না কেন, এটা প্রমাণ করে আর্থিক খাতে বড় বড় ও ভয়ঙ্কর সব দুর্নীতির কথা চাউর হলেও এর হোতাদের ধরা যায়নি। বা ধরতে দেওয়া হয়নি।

এখন, দেখা যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকেও দুঃশাসনের কালো ছায়া পড়ছে। ব্যাংক আইন পরিবর্তন করে ক্ষমতাবান পরিবারের হাতে প্রাইভেট ব্যাংকের মালিকানা ছেড়ে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে।

তাই অর্থমন্ত্রী যখন বলছেন, তাঁর দলের অনেক এমপি অসৎ এবং তারা মানুষের কাছ থেকে নানা ধরনের টাকা পয়সা আদায় করছেন, তখন বোঝার বাকি নেই এসব ক্ষমতাবান ‘দুষ্টু’ মানুষরাই ক্রমশ দেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী মানুষদের অংশ হয়ে উঠছেন। ২০১৬ সাল থেকে ছয় বছরে দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর হাতে যে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ দেশজ আয় জমা হচ্ছে এই দলে ঢুকে পড়েছেন এসব ‘রাবিশ’ অত্যাচারী মানুষেরাই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সুশাসন সবল থাকলে এই অত্যাচারী, অসৎ এমপিরা (অর্থমন্ত্রীর ভাষায়), কি এই কাজটি করতে পারতেন?

দেশের আয় বৈষম্যের কারণ হয়েও, কোনও আইন-কানুনের মোকাবিলা না করেই কি বহাল তবিয়তে টিকতে পারতেন এই ক্ষমতাবান ‘অসৎ’ মানুষেরা?

রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মে বলা যায়, সুশাসন থাকলে, এসব অনৈতিক, রাবিশ-দুষ্টু এবং আইনের চোখে অপরাধীরা এরকম ফ্রি-স্টাইল চলতে পারতেন না। দুর্বৃত্ত সব দেশে সব কালেই উৎপাদিত হয়। সেটাই দুর্নীতির ফলাফল। কিন্তু সুশাসন সেই দুর্বৃত্তদের পাকড়াও করে শাস্তি দেয়। ফলে, সবাই এরকম দুর্বৃত্ত হয়ে ওঠার বাসনা পোষণ করে না। সুশাসনের হাত ধরেই দেশে একটি ন্যায্য ও শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রগতি রচিত হয়।

বলাবাহুল্য বাংলাদেশ এখন তার উল্টোপথে হাঁটছে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, বিবিএসের জরিপ, আর গিনি সহগের অংক কিন্তু সেই কথাই বলছে।

পাঁচ.

ঈশপের একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। গল্পটা এরকম– একবার একটা সাপ বারবার অনেক লোকের পায়ের তলায় পিষ্ট হচ্ছিল। ক্ষোভে-দুঃখে অতিষ্ট হয়ে ঈশ্বরের কাছে গিয়ে সাপটি নালিশ জানালো। ঈশ্বর তখন বললেন, প্রথমবার যার পায়ের তলায় পড়েছিলে তারই পায়ে যদি ছোবল বসিয়ে দিতে তাহলে আর দ্বিতীয় ব্যক্তির পায়ে তোমাকে পড়তে হতো না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্থায়ী জামিন পেলেন না ড. ইউনূস
স্থায়ী জামিন পেলেন না ড. ইউনূস
আইপিএল থেকে অনির্দিষ্টকালের বিরতি নিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল!
আইপিএল থেকে অনির্দিষ্টকালের বিরতি নিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল!
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
রাশিয়ায় বন্যা, শত শত ঘরবাড়ি প্লাবিত
রাশিয়ায় বন্যা, শত শত ঘরবাড়ি প্লাবিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ