X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডুব: পুনর্নির্মাণের স্বাধীনতা

আনিস পারভেজ
১৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:০৪আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:৪০



আনিস পারভেজ সিনেমার প্রধান চরিত্র জাভেদ বাবাকে জরুরি কথাটা পুরো না বলে পরের দিনের জন্য রেখে দিত, যেন শেষ শোনার অপেক্ষায় বাবা বেঁচে থাকে। খোলাসা করে না বলা কথায় স্বাধীনতা পাওয়া যায় নিজের মতো করে ভাবনার ও পুনর্নির্মাণের, আর সেই ভাবনাটাই অভিষ্ট যে কোনও শিল্পের, সিনেমার তো বটেই। মোস্তফা সরয়ার  ফারুকী সিনেমাকার, এবং সে সূত্রে তার চ্যালেঞ্জ পর্দায় সাহিত্যের মতো গল্প না বলে সিনেমার নিজস্ব ভাষায় একটি আবহ তৈরি করা, যেখানে একটি বার্তা বা গল্প থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু এ মাধ্যমটির নিজস্ব শৈলীতে একটি আখ্যানের জন্ম দেওয়া, হয়তো পুরো আখ্যান নয়। দর্শক তার ভাবনায়, বুদ্ধিতে ও আবেগে এবং নিজস্ব পটভূমিতে নিজের মতো করে আখ্যানের পুরোটা সৃষ্টি করবে। এভাবেই একটি সিনেমা অনেকগুলো সিনেমায় রূপ নেয়।   

গল্পের একটি সিনেমাটিক অবয়ব ও নির্মিতি আছে ডুব-এ। ডুব জাভেদ, মায়া, সাবেরি ও নিতুর গল্প, যেমন আমাদের সবারই  নিজস্ব গল্প আছে আমাদের জীবনে। আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত গল্পে আমরা ডুবে থাকি, অন্য কেউ দেখতে পায় না—এমনকি  আপনজনও না। অপরদিকে ভালোবাসা, মায়া, মমতা ও সম্মান এসব আমাদের ডুবিয়ে রাখে পরিবারের বন্ধনে। ব্যক্তিগত ডুব আর পরিবারে ডুবের ভেতর কখনও তাল কেটে যায়, মানুষের সম্পর্ক হয়ে যায় সুতো ছেঁড়া, আমরা অন্য এক অতলে ডুবি। এক ডুবের সাথে অন্য ডুবের সমন্বয় না থাকলে, অর্থাৎ পরিবারে যোগাযোগহীনতা বাড়লে, মানুষ মরে যায়; ডুব-এর মূল চরিত্র জাভেদ তাই বলে।   
দিগন্ত বিস্তৃত একটি শটে পাহাড়ি প্রকৃতি।  জাভেদ ও মায়ার পরিবার গাড়িতে হল্লা করে করে ছুটিতে বেড়িয়েছে।  গাড়ি ঊর্ধ্বগামী।  সে গাড়িই পরবর্তীতে নিম্নগামী হয়ে ঘরে ফেরে যখন জাভেদ ও মায়া যার যার ডুবের জায়গায় অটল।  জাভেদ চেষ্টা করেছিল, যদিও সে দুঃখের সাথে অনুধাবন করে সংসারটা হয়ে গেছে চাকরির মতো, শুরুর দিনের সেই অনিশ্চয়তার সুন্দর কামড় আর নেই।  মিড ক্লোজ শটে ক্যামেরা প্যান করে—ডানে ও বাঁয়ে।  জাভেদ ও মায়ার যোগাযোগ হয় না। জাভেদের স্ক্যান্ডাল মায়াকে করেছে দূরের বাসিন্দা, আর জাভেদ সব নতুন করে গড়তে চাওয়ার মিনতি করে সাড়া না পেয়ে ডুব থেকে উঠতে চেয়েও ডুবেই থাকে।  আবারও দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতি, লং শট, মিড শট ও ক্লোজ শটে। হাওয়া বইছে, হাওয়ার কসমিক শব্দ। প্রকৃতির প্রশান্তিতেও মানুষ কতোটা দুঃখী!   

সংসারটার মৃত্যু হচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে আঁধারে।  চরিত্রগুলুকে আমরা দেখি ফ্রেমের ভেতরে ফ্রেমে।  কখনও  জানালার এপাশ থেকে ভেতরে, অথবা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে।  মায়া সন্তানদের নিয়ে মায়ের বাড়ি চলে যায়।  ক্লোজ-আপে জাভেদ, ফ্রেমটি ঈষৎ দোলে।  ফ্রেম কাঁপে যখনই চরিত্রটি সংকটে বা সিদ্ধান্তহীনতার দোদুল্যমানতায়। নিতু জাভেদকে কাছে পাবার প্রয়াসে সিগারেট শেয়ার করতে বলে, জাভেদ যুক্তি আর অনুভূতির টানাটানিতে দুলছে, শটটিও দোলে।

রাতের বৃষ্টি গাড়ির ছাঁদ জুড়ে, হলে বসে দর্শকের শরীর ভিজে যায়, ক্লোজ-আপে এ দৃশ্য একটি মায়াবি জগত তৈরি করে, শুরু হয় জাভেদ ও নিতুর সংসার। সম্পাদনার এরকম সৌকর্য এদেশে অনুপস্থিত।  হয়তো গ্লানি, এবং নিশ্চিত মনোকষ্টের পীড়ায় ডুবছে জাভেদ। কিন্তু এর জন্য কোনও নাটক নেই, নেই কাহিনির ঘোড়দৌড়। জাভেদ নিতুকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে, আমরা অস্পষ্ট কিছু শব্দ শুনতে পাই। একই শট, ক্যামেরা বাঁয়ে প্যান করে, শব্দ স্পষ্ট হয়—লোকজন দোয়াদরুদ পড়ছে। জাভেদ মারা গেছে। একটি শটে অনেকটুকু সময় পার হয়ে যায়, অনেক ঘটনা মারিয়ে সময়, কিন্তু সব ঘটনা দেখার প্রয়োজন নেই সিনেমায়। অনুপস্থিতিই তো সিনেমায় অনেক উপস্থিতির জানান দেয়।   

মৃত্যুতে মানুষ ডুবে যায়। কিন্তু মৃত্যুই আবার আপনজনের কাছে মায়া মমতা ও সম্মান ফিরিয়ে আনে। মৃত্যু মানুষকে ডুব থেকে তুলেও আনে। তাই জাভেদের প্রথম স্ত্রী মায়া ড্রয়ারে তুলে রাখা জাভেদের ছবি বের করে দেয়ালে টাঙায়। মায়াও উঠে আসে তার যন্ত্রণা ও কষ্টের ডুব থেকে, কিছুটা হলেও। বাইরে তখন প্রকৃতিতে প্রশান্তি—হাওয়ায় দুলছে গাছের ডাল ও পাতা।

ডুব এখানেই শেষ। শেষ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ফারুকী এতোটা সময় সিনেমার ভাষায় কথা বলে এবার হোঁচট খেলো। অবান্তর কিছু দৃশ্য জুড়ে দিয়ে সিনেমার অঙ্গহানি ঘটালো। আমি বিস্মৃত হবো এসব দৃশ্য, নইলে একটি মনকাড়া সিনেমা দেখার আনন্দ ও অনুভূতিতে কালি লাগবে।   

প্রায় বিশ বছর আগে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রত্যাবর্তন নাটকটি দেখে আমি আলোড়িত হয়েছিলাম তার সিনেমাটিক সেন্স দেখে। সে সেন্সের বিকাশ দেখেছি পিঁপড়াবিদ্যায়, ডুব-এ যা অনেক পরিণত। ডুব সিনেমা দেখতে থাকা দুঘণ্টায় ডুবিয়ে রাখে না, হল থেকে বেরিয়ে এসে ডুবে যেতে হয় একটি মৃদু কিন্তু বয়ে যাওয়া আলোড়নে। মগজে আলোড়ন এবং হৃদয়ে হাওয়া। মগজ ঘটনার পুনর্নির্মাণ করে, আর হৃদয় কষ্ট পায় এ ভেবে যে মানুষ সম্ভবত ট্র্যাজেডির সন্তান।  

লেখক: অতিরিক্ত পরিচালক, সংলাপ ও যোগাযোগ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ