X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে ‘খোঁচাখুঁচি’ করার কিছু নেই?

চিররঞ্জন সরকার
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:৫৮আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:১০

চিররঞ্জন সরকার এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস বিষয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এ প্রশ্নপত্র ফাঁস নতুন বিষয় নয়, যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। কখনও প্রচার হয়, কখনও হয় না। এটা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করার কিছুই নেই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘মন্ত্রী-সচিব গিয়ে তো প্রশ্ন ফাঁস করেননি। তাদের কেন সরে যেতে হবে, যারা করেছে, তাদের ধরিয়ে দিন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। আপনাদের তো সেখানে অনেক সোর্স আছে।’
এসব কথা বলে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গুরুতর বিষয়টিকে একেবারে তরল বানিয়ে দিলেন! এরপর প্রশ্নপত্র ফাঁস ব্যাপারটি যদি ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ হয়ে দাঁড়ায়, এ ব্যাপারে কেউ কিছু না বলে, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না! অথচ আমরা আশা করেছিলাম, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো একটি জাতীয় গুরুতর ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের কঠোর সংকল্পের কথা বলবেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের অঙ্গীকারের কথা বলবেন, দোষীদের শাস্তি ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ব্যক্তিদের সরে যাওয়ার কথা বলবেন। এই সমস্যা সমাধানের কথা বলবেন। আর নিতান্তই যদি সমস্যার সমাধান বাতলাতে না পারেন, তাহলে অন্তত দুঃখ প্রকাশ করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমাদের অবাক করে দিয়ে বলেছেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে এটা চলে আসছে।’ তার মানে দাঁড়াচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস অবৈধ নয়; যেহেতু যুগ যুগ ধরে তা চলে আসছে, কাজেই ‘ঐতিহ্যগত’ভাবেই তা স্বাভাবিক ব্যাপার! প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এই বক্তব্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ-পর্যায় থেকেই আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁসকে বৈধতা দিয়ে দেওয়া হলো! শুধু তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে দায় এড়ানোর একটা চেষ্টাও রয়েছে!

আমরা ছোটকাল থেকে পরীক্ষায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা শুনে এসেছি। পরীক্ষায় নকল হয়, উত্তরপত্র লিখে দেওয়া হয়–এমন সব অভিযোগের কথা আমরা অতীতে শুনেছি, দেখেছি। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়–এটা গত এক দশকের উদ্ভাবন! অন্য সময়ের কথা বাদই দেওয়া যাক, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেই সময়ও তো এসএস‌সি, এইচএস‌সি কিংবা অন্য কোনও পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা আমরা শুনি‌নি। তাহলে কি ওই সময়েও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে? আর তাই য‌দি হয়, তাহলে তিনি সেটা বন্ধ করার উদ্যোগ নেননি কেন? যুগ যুগ ধরে চলা অনিয়ম বন্ধ করা কি প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয়?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ‘এটা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করার কিছুই নেই। মন্ত্রী আর সচিব গিয়ে তো প্রশ্ন ফাঁস করেননি, তাদের কেন সরে যেতে হবে?’

সত্যিই কি তাই? বিষয়টি নিয়ে খোঁচাখুঁচি করার কিছু নেই? প্রধানমন্ত্রীর কাছে সবিনয়ে জানতে চাই, মন্ত্রীর কাজটা তাহলে কী? উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা কেন পদত্যাগ করেন? তারা তো গাড়ি চালান না! আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানই বা কেন পদত্যাগ করেছিলেন? তিনি তো রিজার্ভ চুরি করেননি? শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিবের যদি দায় না থাকে, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় কার? শিক্ষার্থীদের? অভিভাবকদের? নাকি এ দেশের হতভাগ্য নাগরিকদের?

দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় যাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়, সেই মন্ত্রী-সচিবদের যদি কোনও দায়-দায়িত্ব না থাকে, তাহলে দায়টা আসলে কার?

প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’ প্রশ্ন হলো—প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দেওয়া কি গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ? গণমাধ্যমকর্মীরা কি সরকার, প্রশাসন, মন্ত্রণালয় কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য? চোর ধরার দায়িত্ব কি তাদের?

মাত্র তিন মাস আগে (২৪ নভেম্বর ২০১৭) পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুলের দায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষামন্ত্রী। কেবল দুঃখ প্রকাশই নয়, এ ভুলের দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন পরীক্ষা বোর্ড প্রধান কিম সাং-হুন। সাং-হুনের পদত্যাগের সিদ্ধান্তের আগে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী হাওয়াং উ-ইয়ে বলেন, ‘আমি গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি এবং প্রশ্নপত্র তৈরি প্রক্রিয়া আরও উন্নত করতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ দরকার বলে স্বীকার করছি। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটনার দায় স্বীকার, ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করার নজির নেই।’ 

এটা আমাদের চরম দুর্ভাগ্য! শিক্ষাক্ষেত্রে ক্যানসারের মতোই একটি মারাত্মক ব্যাধি হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। তথ্য-প্রমাণসহ গণমাধ্যমে এই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা প্রকাশিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা তা অস্বীকার করার মহান ব্রত নিয়েছেন! বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা, পিএসসি থেকে শুরু করে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, বাদ যায় না ব্যাংক বা অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষাগুলোও। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে, শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকে ট্রলের বন্যা বয়ে যায়। শিক্ষার্থী, তাদের বাবা-মা, সাধারণ মানুষ সবাই প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ব্যাপারটি প্রত্যক্ষ করলেও অন্ধকারে থেকে যান কেবল শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় বাড়ির পাশের পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে বসে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্রের সমাধান খুঁজতে দেখে যখন হতাশ হয়ে বাসায় ফিরে টেলিভিশনের সামনে বসি, তখন নিউজ স্ক্রলে দেখতে পাই, ‘প্রশ্ন ফাঁসের কোনও অভিযোগ পাওয়া যায়নি, পরীক্ষা সুষ্ঠু হয়েছে-শিক্ষামন্ত্রী।’ পরের লাইনটা হতাশা আরও কয়েকগুণ বেড়িয়ে যায়, ‘প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে!’

আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর উদার চোখে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনও প্রমাণ পান না। তাই কারও বিরুদ্ধে ‘উপযুক্ত ব্যবস্থা’ও আর নেওয়া হয়ে ওঠে না! আমাদের দেশে মন্ত্রী-সচিব থেকে শুরু করে চৌকিদার-দফাদার, সরকারি দলের নেতা, বিরোধী দলীয় নেতা—কেউই পদত্যাগের মতো চরম ত্যাগটি স্বীকার করতে চান না। আর এই না চাওয়াটাই আমাদের রাজনীতির একটা মস্ত গলদ। এই গলদ সরানোর গুরুত্বটাই কেউ অনুধাবন করেন না। অনেকেই বলেন, পদত্যাগ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। হ্যাঁ, পদত্যাগে সমস্যার সমাধান হবে না ঠিক কিন্তু সমাধানের পথ খুলে যাবে। কারণ পদত্যাগ মানেই হচ্ছে, ব্যর্থতার দায় স্বীকার করা। আর যতক্ষণ না আপনি স্বীকার করছেন যে, কাজটি ভুল হয়েছে, ততক্ষণ আপনি ভুল শোধরাবেন কী করে? ভুল শুধরে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হতে হলে প্রথমেই ভুল স্বীকার করতে হবে। আপনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে। তা না হলে সেটা হবে চরম নৈরাজ্যেরই বহিঃপ্রকাশ!

দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবেন, এমন বেশিরভাগ অভিভাবকই বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি ক্ষুব্ধ। এর অনেক কারণ আছে। সবচেয়ে বড় কারণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা স্বীকার না করা ও ঠেকাতে না পারা। অনেকেরই অভিযোগ, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে দেশের শিক্ষার গলায় ফাঁস পরিয়ে গোটা জাতিকে অথর্ব বানানোর চক্রান্ত চলছে। যারা লেখাপড়া করে শিক্ষা অর্জন করতে চায় তেমন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বর্তমানে ভয়ানক হতাশ।

একজন পরীক্ষার্থীর বক্তব্য, ‘অনেক খেটেখুটে যে পরীক্ষা দিয়েছি, নিয়মমতো পড়াশোনা করেছি, এখন আমি যদি ‘এ’ পাই এবং একজন পরীক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ‘এ প্লাস’ পায়, তাহলে আমি পড়াশোনায় উৎসাহ পাব কীভাবে? ছোটবেলা থেকে যে শুনে এসেছি, সৎ পথে থেকো, সৎ কাজে সিদ্ধি লাভ হয়, এ বিষয়টাই তো ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। এসব কথার জবাব কে দেবে?’

ছোট ছোট শিশুদের হাতে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ধরিয়ে দিয়ে পরীক্ষা দিতে পাঠানো হচ্ছে, সেই ছোট ছোট শিশুদের অন্যায় করতে শেখানো হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই। একটা দেশের মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙে দেওয়ার এর চেয়ে পরিপূর্ণ কোনও পদ্ধতি আছে কি? প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে গেলো কয়েক বছরে এমন কোনও পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি! অথচ আমাদের শিক্ষামন্ত্রী কী ভয়ানক নির্বিকার! একটা ত্রুটিমুক্ত ও ভালো পরীক্ষার আয়োজন যদি করা না যায়, তাহলে মন্ত্রী হিসেবে এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? এরপরও পদে থাকার নৈতিক সমর্থন মেলে কী?

পাঠদান-পদ্ধতি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী কোনও কার্যকর পদ্ধতির উদ্ভাবন চোখে পড়ছে না। শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানমুখী না হয়ে ক্রমেই সনদমুখী হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানচিন্তা, দর্শনচিন্তা, সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা একটা নির্দিষ্ট মাত্রাতেই আটকে আছে। উল্টো যেন অন্ধকারকেই শিক্ষার মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় কী বলবেন? প্রধানমন্ত্রীই বা কী বলবেন? এসব নিয়ে কথা বলাটা কি নিছকই ‘খোঁচাখুঁচি’?  সত্যিই কি এসব নিয়ে ‘খোঁচাখুঁচি’ করার কিছুই নেই?

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ