X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচফোড়নে নাড়াচাড়া

দিলশানা পারুল
০৮ মার্চ ২০১৮, ১৪:৫৩আপডেট : ০৮ মার্চ ২০১৮, ১৪:৫৯

দিলশানা পারুল ভদ্রলোক সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠলেন। আয়েশ করে একটা পত্রিকা নিয়ে বারান্দায় বসলেন। এক কাপ চায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। চা খেয়ে তারপর নাস্তা করবেন, তারপর ঠিক আটটায় অফিসের উদ্দেশে রওনা দেবেন। মেজাজ খুবই খারাপ হচ্ছে, কারণ দশ মিনিট হয়ে গেলো এখনও চা হাতে পাননি। ওনার বউটা যে কী এমন ছাতামাথা করছে রান্নাঘরে, উনি বুঝতেই পারছেন না! বিরাট একটা ধমক দিলেন, চা চেয়েছি শুনতে পাওনা নাকি? নাকি দুই পয়সার একটা অফিস করে বিরাট কিছু হয়ে গেছো! সুলতানা পাঁচফোড়নে সবজি বাগার দিচ্ছিলেন। ঘুম থেকে উঠেছে ঠিক ভোর পাঁচটায়। এত সকালে ছুটা কোনও কাজের মানুষ পাওয়া যায় না। চারজনের ছোট সংসার মনে হয়, কাজ কি আর কম? সকালে উঠে পনেরটা রুটি বানিয়েছেন। রুটির সঙ্গে খাবার জন্য একটা সবজি করছেন, ডিম ভেজেছেন। রাতে যে করে রাখবেন সেই উপায় নেই। কারণ, এ বাড়ির কেউ বাসি খাবার খায় না, বিশেষ করে এ বাড়ির সাহেব। ছেলে মেয়ে দুটোর টিফিন রেডি করেছেন, সাহেবের লাঞ্চ রেডি করেছেন। নিজের জন্য লাঞ্চ এই রুটিই নিয়ে যাবেন। আজকাল পেটে কেমন চর্বি জমছে। একটু মোটার দিকে গেলেই ওনার সাহেব আবার বাঁকাত্যাড়া কথা শোনান। তড়িঘড়ি করে চা দিতে গিয়ে গরম চা হাতে ছলকে পড়লো, না ঠাণ্ডা পানি ঢালার সময় নেই। ছেলে মেয়ে দুটো সমানে চেঁচাচ্ছে স্কুলের জামা-কাপড় খুঁজে পাচ্ছে না। সব কাজ সারতে সারতে আটটা বাজতে চললো। ভদ্রলোক এর মধ্যে রেডি হয়ে সমানে চেঁচাচ্ছেন প্রতিদিন তোমার জন্য অফিসে যেতে দেরি হয়। কোনদিন যে চাকরিটা খোয়াই! সুলতানা তাকে বলতে পারলো না সকালে তুমি একটু আমাকে সাহায্য করলেই তো পারো, তাহলে আর কারোরই দেরি হয় না! বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে, আমি কি হাফলেডিস যে রান্না ঘরে কাজ করবো? এত সমস্যা, বিয়ে না করলেই পারতা। তুমি জানতে না বিয়ে করলে মেয়েদের সংসারের কাজ করতে হয়? তোমার মা তোমাকে বলে দেয়নি এসব? এত কথার দরকার কী? সুলতানা অফিসের জন্য কোনও রকমে রেডি হয়ে বাইকের পেছনে গিয়ে বসলো। ভদ্রলোক বিরক্তিতে বললেন, চুলটাও তো ঠিকমতো আচড়াওনি। এত অগোছালো হয়ে চললে প্রেসিটিজে লাগে তো ভাই? বউ তো নাকি? সবাই চায় বউ একটু গুছিয়ে চলুক। গা দিয়ে সমানে পাঁচফোড়নের গন্ধ বের হচ্ছে! ইয়াক! এইভাবে কেউ অফিসে যায়? অতঃপর সুলতানা দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে অফিসের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলো।  

না, এটা কোনও কাল্পনিক সুলতানার শুরু হওয়া সকালের গল্প না। গত দশ বছর আমি এসব সুলতানাদের সঙ্গে কাজ করছি। এই সুলতানারা আমার প্রতিবেশী ছিল। এই সুলতানারা আমার বা আপনার মা অথবা শাশুড়ি অথবা বড় বোন অথবা আপনি নিজেই সুলতানা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, অফিসের বড় বড় নারী বসকেও আমি দেখেছি এই সুলতানার চরিত্রে রোল প্লে করতে।    

গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭-তে ঢাকা ট্রিবিউনে অ্যাকশন এইডের একটা গবেষণা রিপোর্ট এসেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ছয়গুণ বেশি ঘরের কাজ করেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মেয়েরা দিনে ১৫.৩ ঘণ্টা কাজ করে, তার মধ্যে ৬.৩ ঘণ্টা মানে শতকরা ৪১.৪ ভাগ ঘরের কাজ। আর আমাদের পুরুষেরা ঘরের কাজ করে ১.১ ঘণ্টা। ভারতের ভাইয়েরা অবশ্য আরও আগানো, তারা করেন ২৪ মিনিট। অ্যাকশন এইড এই ঘরের কাজের দেখা যাচ্ছে সুন্দর একটা নাম দিয়েছে ‘আনপেইড কেয়ার ওয়ার্ক’, বাংলা করলে দাঁড়াচ্ছে ‘বিনা পারিশ্রমিক সেবামূলক কাজ’। আমাদের পারিবারিক ভাষায় কেয়ার শব্দটার সঙ্গে ভালোবাসা সরাসরি যুক্ত। ‘তুমি আমাকে ভালোবাসলে আমার কেয়ার করতে’। অথবা ‍‘তুমি তো দেখি আমার কোনও টেককেয়ারই করো না, তাহলে তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?’ পরিবারে হরহামেশাই আমরা এই কথাগুলো শুনে আসি। আমাদের মালিক যে পুরুষ তারা সবসময়ই চায় বিনা পারিশ্রমিকে টেকেন কেয়ার অফ হতে। এই ভালোবাসার টেককেয়ারের মানে কী? মানে তুমি আমার তিন বেলা খাবার রান্না করে দিবা, খাবার পর আমার থালাবাসন খানি ধুবে, জামা কাপড় ধোয়ার ব্যবস্থা তুমি করবে, বিছানা করবে, চা চাইলে তাই দেবে। আমার সন্তানদের দেখভাল করার দায়িত্বও তোমার। আমি পুরুষসহ আমার সন্তানের এই সমস্ত কাজ তুমি করো না মানে আমাদের কেয়ার তুমি করো না, যার মানে আমাকে তুমি ভালোবাসো না। নারী তোমাকে পরিবারের সবাই শ্রদ্ধাহীন ভালোবাসি। শ্রদ্ধাহীন কেন? যে কাজের কোনও পারিশ্রমিক নেই সেই কাজের কোনও শ্রদ্ধা এই সমাজে নেই। পুরুষের ভালোবাসাই কি এই সমস্ত সেবামূলক কাজের জন্য যথেষ্ট না নারীর জন্য? আমি বলবো, নারীকে ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়, কিন্তু পুরুষকে তার ভালোবাস প্রমাণ করার জন্য শুধু মুখে বললেই চলে, কেন? বিষয়টা কি এমন, পুরুষের মুখের ভাঁপেই ভালোবাসার আলু  সিদ্ধ হয়ে যায়? পুরুষের ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্য ফুল দেওয়া ছাড়া ঘরের আর কোনও কাজকর্ম করার দরকার নেই? পুরুষ তো সংসার চালানোর টাকা উপার্জন করে। তাহলে যে নারীরা সংসার চালানোর টাকা উপার্জন করে তাদের বেলায় নিয়ম অন্যথা হয় না কেন?

২৪ ঘণ্টায় একদিন। এই ২৪ ঘণ্টাকে আপনি বা আমি চাইলেও ২৫ ঘণ্টা করতে পারবো না। দিনের হিসাব একটাই। ঘুমের সময়টুকু বাদে একটা মেয়েকে যদি গৃহস্থালির কাজের নামে, সংসার করার নামে সার্বক্ষণিক আটকে রাখি তিন কামরার একটা ঘরে, যত প্রতিভাবানই হোক সেই মেয়ের বিকাশ আপনি কি দিয়ে নিশ্চিত করবেন? বাড়তে হলে, নিজেকে মেলে ধরতে হলে একটা মেয়েকে সবার আগে ঘরের বাইরে পা রাখতে হবে। একজন নারী ঘরের বাইরে পা রাখতে পারে না তার অন্যতম প্রধান কারণ তার অনুপস্থিতিতে সংসার ছারখার হয়ে যায়। ছারখার মানে কী? মানে সংসারের কোনও কাজ হয় না। অথচ একটা সংসারের প্রতিটা কাজ হচ্ছে সাধারণ জীবন দক্ষতার কাজ। সাধারণ জীবন দক্ষতার আবার ছেলে আর মেয়ে কি বলেন তো? তারপরও আমরা পুরুষের সব কাজের দায় একটা মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে পেপার পড়ি, চা খাই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেই, টিভিতে খবর বা মুভি দেখি আর তরকারিতে লবণ কম হলে বিরক্তিতে মুখ বাঁকা করে ফেলি!  

লেখক: শিক্ষা বিষয়ক গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ