X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেতার: সেকাল-একাল

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
৩০ মার্চ ২০১৮, ১৫:২৮আপডেট : ৩০ মার্চ ২০১৮, ১৮:৪৭

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান কথা ছিল রয়্যালটি নিয়ে লিখবো। কিন্তু এর মধ্যে,বেশ ক’টি মেসেজ ও টেলিফোনে,কিছু প্রশ্ন এসেছে। সবগুলোর মোটামুটি বক্ত্যব্য এমন, যারা এখন বেতারে চাকরি করছেন,তাদের কি যোগ্যতা নেই? আমি যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি। আগ্রহের কথা বলেছি। যোগ্যতা না থাকলে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন কী করে? প্রশ্ন হলো, বিসিএস যারা করেছেন, তাদের একজনও বেতারে চাকরি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে করেছেন কিনা? যোগ্যতা আছে বলেই, তাদের অনেকেই ক্রমে ক্রমে বিষয়টি আয়ত্ত করে নিয়েছেন। বেশ কয়েকজন এখন আগ্রহী হয়েছেন এবং কাজে আনন্দও পাচ্ছেন। কারো কারো মধ্যে, আমাদের সময়ের মতো, ‘আমার অনুষ্ঠানটি সবচেয়ে ভালো হতেই হবে’–এমন প্রয়াস নেওয়ার প্রবণতাও এসেছে। তবে এটা সার্বিক চিত্র নয়। 

আমরা, বিশেষ করে স্বাধীনতার পর, প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছিলাম কাজপাগল। অফিস ছুটি হওয়ার পর আবুল মিয়ার ক্যান্টিনের আমতলায় বসে নিত্যনতুন পরিকল্পনা। কে থাকতেন না সেখানে? আব্দুল আহাদ ভাই,সমর দা, খোন্দকার নূরুল আলম, অনুপ ভট্টাচার্য, আশরাফুল আলম,আসতেন শামসুর রাহমান ভাই, আবু হেনা মোস্তফা কামাল ভাই, সত্য সাহা, আর বেতারের প্রায় সবাই তো থাকতামই।


সেই সব আড্ডা, আর জ্ঞানী গুণীদের সঙ্গে কথা বলার মধ্যেই নতুন নতুন অনুষ্ঠানের ধারণা পেয়ে যেতাম আমরা। সে অনুষ্ঠান গানের হতে পারে, সাহিত্য আড্ডার হতে পারে, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের হতে পারে, নাটকের হতে পারে, এমন অনেক কিছু। আর স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ফেরা টগবগে যুবকেরা তো ছিলেনই।
রয়্যালটি নিয়ে পরে বলবো। আজ বরং শাহবাগ বেতার ভবনের সুবর্ণ দিনগুলো নিয়ে বলি। সে দিনের অনেকেই আজ নেই। যারা আছেন, তারাও অবসরপ্রাপ্ত। বেতারের প্রতি সত্যিকারের প্রেম যাদের ছিল,তারা থাকলে, শাহবাগ বেতার ভবন, বেতারের হাতছাড়া হয়ে যেত না। অন্তত একটি মাত্র কারণে হলেও,এটি বেদখল হওয়া প্রতিরোধ করতো সবাই। সেটা ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ঘটনা।
নির্ধারিত ছিল,বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি বেতারেও প্রচারিত হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বহিঃপ্রচারের দায়িত্বে থাকা অনুষ্ঠান সংগঠক নাসার আহমেদ চৌধুরী গোপনে পুরো ভাষণ রেকর্ড করে নেয়, ইশারায় আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফুজ্জামানের অনুমতি নিয়ে। ভাষণ যে বেতারে প্রচারিত হচ্ছে না, সেই কথা বঙ্গবন্ধু জেনে যান। তিনি নির্দেশ দেন,তাঁর কথা প্রচার করতে না দিলে,কোনও বাঙালি যেন বেতারে না যায়। এদিকে পুরো ভাষণ রেকর্ড হয়ে যাওয়ার পর,লুকিয়ে সেই টেপ দুটি নিয়ে নাসার বেরিয়ে আসেন। দ্রুত ভাষণের কয়েকটি কপি করে ফেলে,তাঁরা সবাই সিদ্ধান্ত নেন,এই ভাষণ প্রচার করতে না দিলে, বেতার বন্ধ করে দেবেন। এই ঐকমত্য প্রকাশে প্রকৌশল এবং সংবাদ বিভাগও সমান উদ্যোগী ছিলেন। গানের একটি ত্রিশ মিনিটের টেপ প্রচারের জন্যে চালু করে দিয়ে,তাঁরা বেতার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেন।
ত্রিশ মিনিট পর বন্ধ হয়ে যায় বেতারের প্রচার। উল্লেখযোগ্য, তখন বেতারই ছিল দেশব্যাপী প্রচারের একমাত্র মাধ্যম। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সংযোগেরও প্রধান মাধ্যম ছিল ঢাকা বেতার। হঠাৎ বেতার বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, সারা দেশে যেমন সাড়া পড়ে যায়,তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরাও হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কী হলো পূর্ববাংলায়? তারা কি স্বাধীন হয়ে গেলো? বহির্বিশ্বেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করলো। পাগলের মতো হয়ে পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে যেকোনও মূল্যে রেডিও চালু করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু তাদের পক্ষে বেতার প্রচার চালু করা সম্ভব হয় না। আঞ্চলিক পরিচালকও গোপনে সব খবর রাখছিলেন। একসময় তিনি একটি পাবলিক টেলিফোন থেকে এখানকার সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন,বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছে। ওই রেকর্ড প্রচার করার মাধ্যমেই মাত্র বেতার প্রচার শুরু হতে পারে। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা বাধ্য হয় নতিস্বীকার করতে। সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের মাধ্যমেই বেতার প্রচার শুরু হবে। ৮ মার্চ, ১৯৭১- সকাল থেকে বারবার ঘোষণা দিয়ে প্রচারিত হয়, সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।
এই প্রথম সারা দেশের মানুষ শুনতে পায়, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। দেশের প্রতিটি মানুষ জানে, এই ভাষণ প্রচারের পর পরই সারা দেশের মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে।
একটি বিশেষ লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই দিন থেকে,২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের সময় পর্যন্ত শাহবাগ বেতার কেন্দ্র থেকে আর রেডিও পাকিস্তান বলা হয়নি। ঘোষণা করা হতো,ঢাকা বেতার নামে।
গত ৯ মার্চ শেষবার গিয়েছিলাম,শাহবাগ বেতার ভবনে। যে স্টুডিও বুথ থেকে প্রচারিত হয়েছিলো,সে ঐতিহাসিক ভাষণ, সেখানেও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। জানি না ঐতিহ্যের এই কক্ষটি এরপর কী হিসেবে ব্যবহৃত হবে? আজকের বেতার কর্মী বা কর্মকর্তাদের হয়তো এ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু সেদিনের যারা আজও বেঁচে আছেন,তাদের বুকটা কেঁদে ওঠে।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট



/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ