X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

যে স্মৃতি ভোলার নয়

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
২০ এপ্রিল ২০১৮, ১২:০৭আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:০৩

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান আজ আমি যে স্মৃতিচারণ করতে যাচ্ছি, সেটা আসলে পয়লা বৈশাখের আগে বা সেই দিনেই করলে ভালো হতো। যে কারণেই হোক সেটা করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে সেটা করা দরকার।
আমি ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিলাম। হয়তো এখনও কখনও কখনও। তবে সেই ছোটবেলার মতো নয়। তখন, আব্বার কঠিন শাসনের মধ্যেও এমন এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসতাম, যা আমার অন্য ভাইয়েরা কল্পনাও করতে পারতো না। প্রায়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, ইচ্ছে হলেই মামাবাড়ি বা মায়ের মামাবাড়ি গ্রামে চলে যাওয়া, স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়ে ছবি আঁকার স্কুলে ভর্তি হয়ে, বৎসরাধিককাল গুম হয়ে থাকা ইত্যাদি অনেক কিছু। মায়ের কান্নাকাটি, আব্বার অস্থির হয়ে খোঁজা, কিছুই আমাকে বিচলিত করতো না। যাই হোক, সেই স্মৃতির কাছে ফিরি। গ্রাম আমাকে খুব টানতো। আমাদের বাড়িটি ছিল তখনকার যশোরের শহরতলিতে। গ্রাম গ্রাম ভাব হলেও সেটা প্রকৃত গ্রাম নয়। মামাবাড়ি ছিল আমার আদর্শ। কারণ, সেখানে আমি ছিলাম পুরো গ্রামের আদরের ভাগ্নে বা নাতি।
তখন আমার বয়স এগারো কী বারো হবে। হঠাৎ ছুটি পেয়ে চলে গেলাম মামাবাড়িতে। সেখানে তখন খুব তোড়জোড় চলছে হালখাতার। পরদিনই পয়লা বৈশাখ। তখন, এবং সম্ভবত এখনও, সেখানে পয়লা বৈশাখ পালিত হয় পঞ্জিকামতে। নির্ধারিতভাবে ১৪ এপ্রিলে নয়। তো, সেই পরদিন অর্থাৎ হালখাতার দিন গ্রামের সবার সঙ্গে আলমখালির হাটে। বলে রাখা দরকার, আমার নিজের মামারা কেউ যাননি। তারা ছিলেন, আমার নানার আমল থেকে শিক্ষিত ও সচ্ছল। কেউ কৃষিকাজ করতেন না। তাদের জমিজমা সব বর্গা দেওয়া থাকতো। বাকি-বকেয়া বা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে হতো না তাদের। ফলে তাদের কোনও হালখাতাও ছিল না। ফলে আমি গেলাম, গ্রামের অন্যসব মামা-নানাদের সঙ্গে।

হাটে পৌঁছে, আমি যথারীতি আমার মতো ঘোরাফেরা শুরু করলাম। দেখলাম কিছু বড় বড় দোকান এবং গদিঘর সাজানো। সবাই সেখানে যাচ্ছে, টাকা দিচ্ছে, মিষ্টি খাচ্ছে। কয়েকটা নগরদোলা ঘুরছে বাচ্চাদের নিয়ে। কিছু মাটির বা কাঠের অথবা লোহার দ্রব্য বেচাকেনা হচ্ছে। হাটের পাশেই খাল। ঘুরতে ঘুরতে খালের দিকে যেতেই, লাঠিহাতে একজন হইহই করে ছুটে এসে আমাকে ধরে ফেলে চিৎকার করে উঠলো, ‘এই এই এই ছাবাল, এইদিরি কনে যাইস? যা অইদির যা।’একথা বলে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিলো দোকানপাটের দিকে। আমি তো হতভম্ব। যাই হোক, ভয়ে আর ওদিকে তাকাতেও পারলাম না। পরে অবশ্য এক নানার কাছ থেকে জেনেছিলাম, খালপাড়ে পাঁচটা অস্থায়ী ঘর তুলে, একদিনের পতিতালয় বানানো হয়েছিল। আমার মতো নাবালোক যেন সেদিকে না যাই, তাই ওই পাহারা।
কিন্তু যে ঘটনাটা আমাকে আজও বিচলিত করে তা অন্য রকম। মেলায় ভিড়ের মধ্যে দেখি, এক পাঁচ কী ছয় বছরের বাচ্চা, ধুলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে আর চিৎকার করছে, ‘রসুগুল্লা খাবো। তার বাবা তাকে প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করছে, তার কাছে আর পয়সা নেই, সব ধার শোধ করে শেষ হয়ে গেছে। ওরা যে একটা রসগোল্লা দিয়েছিল, সেটাও তো ছেলেকেই খাইয়েছে। আর কোথায় পাবে? ছেলে তা মানতে চায় না। সে আছাড় খেয়ে খেয়ে ধুলায় গড়াচ্ছে, আর কেঁদে কেঁদে বলেই চলেছে, ‘রসুগুল্লা দে, ও বাজান, আরেট্টা রসুগুল্লা খাবো।’ নিরুপায় বাবা একসময় ছেলেকে তুলেই চেঁচিয়ে উঠলো, ‘শালার ছাবাল, খা রসুগুল্লা’ বলেই চড় কশিয়ে দিলো তার গালে। এক চড়েই ছেলে ছিটকে পড়ে অসাড়। বাবা প্রথমে না বুঝলেও একটু পরেই ছুটে গিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে, হায়মাউ করে কেঁদে বাচ্চাকে ঝাঁকি দিতে দিতে বলতে লাগলো, ‘ও বাজান চোখ ম্যাল, বাজান রে ও বাজান…।’ লোকজন জুটে গেলো। একজন পানি এনে মাথায় ঢালতে শুরু করলো। সবাই ‘পাষণ্ড’ বাবাকে তিরস্কার করতে থাকলো। প্রায় ১০-১২ মিনিট পর, ছেলে যেন হিক্কা দিয়ে শ্বাস নিলো। বাবা তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে, যেন ভিড় এবং সমবেত লোকজনের গালিগালাজ থেকে ছুটে পালিয়ে বাঁচলো।
আমি এক বালক, কতক্ষণ হতবাক হয়ে ছিলাম জানি না। এক মামা এসে হাত ধরে ডাকলো, ‘চলো মামু, বাড়ি যাতি হবি না?’
লেখক: কবি ও কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ