X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘নারীবান্ধব’ নতুন সৌদি আরবের যাত্রা শুভ হোক

শারমিন শামস্
২৪ জুন ২০১৮, ১৪:১৬আপডেট : ২৪ জুন ২০১৮, ১৪:২৩

শারমিন শামস্ সৌদি আরবই ছিল পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা মেয়েদের গাড়ি চালাতে দিত না। পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বাইরে বের হওয়ার অনুমতিও নেই সৌদি মেয়েদের।
সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য ২০১১ সালে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন দেশটির নারী অধিকার বিষয়ক অ্যাকটিভিস্ট মানাল আল শরিফ। মানালই প্রথম সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তিনি নিজের গাড়ি চালানোর দৃশ্য ভিডিও করেন এবং সেটা ইউটিউব আর ফেসবুকে পোস্ট করেন। ২০১১ সালে মানাল যে ক্যাম্পেইন শুরু করেন, তারা মূল স্লোগানটি ছিল- ‘Teach me how to drive so I can protect myself’.
এরপর মানালের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হন অনেক সৌদি নারী। এবং তার পরিণতিতে তাদের ওপর নেমে আসে খড়গ। সে সময় প্রায় ৪৭ জন নারীকে গ্রেফতার করা হয়। মানালকে জেলেও যেতে হয়।

পরে অ্যাকটিভিস্টদের দিয়ে ‘আর কখনো গাড়ি চালাবো না’– এই লিখিত বক্তব্যে সই করিয়ে নেয় সৌদি সরকার।

যদিও নারীদের গাড়ি চালানো বিষয়ক সরাসরি কোনও নিষেধাজ্ঞা সৌদি আইনে ছিল না, তারপরও দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্যোগে ১৯৯০ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

এরপর ২০১২ সালে সৌদি সরকার এক অদ্ভুত উদ্ভট প্রযুক্তি বানিয়েছিল মেয়েদের ওপর নজরদারি রাখার জন্য। নারীদের চলাফেরা মনিটর করার জন্য নতুন এক ইলেকট্রনিক সিস্টেম চালু করেছিল তারা। সেই প্রযুক্তির সাহায্যে সৌদি নারীদের পুরুষ অভিভাবকরা মোবাইল ফোনে এসএমএস পেতে শুরু করেছিল মেয়েদের চলাফেরার ব্যাপারে। ম্যাসেজে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তার তত্ত্বাবধানে থাকা নারীরা দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন কিনা। এমনকি সঙ্গে অভিভাবক থাকলেও মোবাইলে এ ম্যাসেজ আসছিল।

আবারও মঞ্চে মানালের আবির্ভাব হয়। এক দম্পতির কাছ থেকে এসব জানতে পেরে টুইটারে দ্রুত ছড়িয়ে দেন সেই মানাল। ওই স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ে রিয়াদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যাওয়ার সময় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে স্বামীর মোবাইলে একটি এসএমএস আসে, যাতে জানানো হয়, তার স্ত্রী রিয়াদ বিমানবন্দর ছাড়ছেন। পুরুষ অভিভাবকের লিখিত অনুমতি ছাড়া সৌদি মেয়েরা দেশত্যাগ করতে পারে না।

নারীদের ওপর নজরদারি করার জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের এ কাণ্ড মানাল আল শরিফের টুইট থেকে জানার পর নিন্দার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এভাবে সৌদি আরব সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয়- সবদিক থেকে নারীকে আটকে রাখার সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল এবং এখনও সে দেশে নারী খাঁচায় আটকে থাকা এক ‘প্রাণিবিশেষ’, যাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে কখনও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষের দিনেও সৌদি মেয়েদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসেনি। তবে এরমধ্যে ২০১১ সালে সৌদি বাদশা আব্দুল্লাহ প্রথমবারের মতো সৌদি নারীদের ভোটাধিকার দেন এবং ২০১৫ সালে পৌর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেন।

২০১২ সালে জানুয়ারিতে দেশটির শরিয়া আইন কার্যকর করার প্রধান মাধ্যম পুলিশ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় শেখ আব্দুল্লাতিফ আব্দেল আজিজ আল-শেখকে। তিনি সৌদি নারীদের হয়রানি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন পুলিশ বাহিনীর ওপর।

ইদানীং সৌদি আরবের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিতে শুরু করেছেন ক্রাউন প্রিন্স সালমান। প্রিন্স সালমানের নতুন পদক্ষেপ, তার ভিশন ২০৩০’র অংশ নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত সৌদি নারীদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে।

নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছে সৌদি আরব। ২৪ জুন রবিবার থেকে ১৫.১ মিলিয়ন সৌদি নারী স্বাধীনভাবে গাড়ি চালানোর সুযোগ পাবেন। এরইমধ্যে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে আগ্রহী হয়েছেন অনেকে।

প্রিন্স সালমান আধুনিক চিন্তাধারার অধিকারী, তা টের পাওয়া যাচ্ছে বটে। তবে তার নারী জাগরণ সম্পর্কিত চিন্তা মূলত অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই এসেছে। এরই মধ্যে নারীদের গাড়ি চালাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অথনীতিবিদ মহলে প্রশংসিত হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত সৌদির অর্থনীতিতে প্রভাব রাখবে। এতে প্রতি বছর সৌদি আরবের সাশ্রয় হবে ২০ বিলিয়ন রিয়াল।

কীভাবে?

গবেষণা সংস্থা বলছে, আগামী ২০২০ সাল নাগাদ আনুমানিক ৩ মিলিয়ন সৌদি নারীকে রাস্তায় নিয়মিত গাড়ি চালাতে দেখা যাবে। এতে কমে যাবে বিদেশি শ্রমিকদের চাহিদা। বর্তমানে সৌদি আরবে ১.৩৮ মিলিয়ন বিদেশি চালক কর্মরত। এদের অধিকাংশই বাংলাদেশি ও ভারতীয়। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়বে এই দুই দেশের শ্রমবাজার।

যুবরাজের এই পদক্ষেপে, ধারণা করা যায়, সৌদি নারীদের কর্মক্ষেত্র এবার বিস্তৃত হবে। অবধারিতভাবে তা দেশটির অর্থনীতির পালে নতুন হাওয়া দেবে।

নারীদের গাড়ি চালানোর মতো একটি সাধারণ ঘটনাকে নিষেধাজ্ঞার আবরণে মুড়ে অসম্ভব করে রেখেছিল সৌদি আরব। আর আজ সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চলেছে, কোনও জাতি তাদের জনসংখ্যার একটি অংশকে বঞ্চিত, অধিকারহীন, কর্মহীন করে রাখলে একদিন তা পুরো জাতির অগ্রযাত্রার নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এবং যখন তারা নারী পুরুষ উভয়কে সমান মর্যাদা দিয়ে কর্মক্ষেত্রে দুইয়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে, তখনই সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ধরে রাখা সম্ভব হয়।

অর্থাৎ সেই পুরাতন কথাটিই সত্য- সভ্যতার বিকাশের গতি ধরে রাখার জন্য নারী ও পুরুষ দুজনকেই প্রয়োজন- অর্ধেক তার করিবে নারী, অর্ধেক তার নর। সৌদি আরব এই ২০১৮ সালে এসে এটি অনুধাবন করতে পারলো। তবে এখনও আরো অনেক কিছুই তাদের অনুধাবন করা বাকি। আশা করা যায়, তারা তা দ্রুতই বুঝবে এবং পদক্ষেপ নেবে।

যদিও প্রিন্স সালমানের নারীর অধিকার নিয়ে নানান বক্তব্য ও পদক্ষেপ, পর্যটন ক্ষেত্রের প্রসারে নানা উদ্যোগ, এমনকি হলিউডের সিনেমায় বিনিয়োগসহ একের পর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বিশ্বকে যেমন তাক লাগিয়ে দিচ্ছে, একই সঙ্গে নানান সমালোচনারও জন্ম দিচ্ছে। এসবের পেছনে প্রিন্স সালমানের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার মতো ষড়যন্ত্রের গন্ধও পাচ্ছেন কেউ কেউ। তবে বিস্তৃত আকারে বিষয়টি যাই হোক, নারী অধিকার ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত সালমানের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো ইতিবাচক এবং এ কথা দ্ব্যার্থহীনভাবে বলতে বাধ্য, তিনি ছাড়া এভাবে নারী স্বাধীনতার কথা সৌদি আরবে আর কেউ প্রকাশ্যে বলেননি।

তাই সালমানের শাসনের এই কালে নিজেদের অধিকার আদায়ের যে সুযোগ সৌদি নারীদের সামনে এসেছে, তা তারা কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিন, সেটিই একমাত্র চাওয়া।

অভিনন্দন সৌদি নারীদের। গোড়ামি আর অন্ধত্ব ভেঙে বেরিয়ে আসার শুভ সূচনার এই মুহূর্তে তারা আরও আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাক। নারীর হাতে স্টিয়ারিং মানেই নারীর স্বাধীনতায় একটি অর্জন। আর এই স্বাধীনতা তারা উপভোগ করুক, অনুধাবন করুক এবং কাজে লাগাক। সামনের দিনগুলোতে সৌদি আরব সকল অন্ধত্ব ও কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে একটি নারীবান্ধব দেশ হিসেবে যাতে বিকশিত হতে পারে, সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাক স্বয়ং সৌদি নারীরাই। সঙ্গে থাকুক দূরদর্শী উদার ও আধুনিক সৌদি পুরুষেরা।

লেখক: প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ