X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বজ্রপাত: তালগাছের বিকল্প ‘বজ্র নিরোধক যন্ত্র’

মো. আনোয়ার হোসেন
০৬ জুলাই ২০১৮, ১৯:২৭আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:১৭

মো. আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। এসব খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়েছে বা হচ্ছে। আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। স্নাতক পর্যায়ে মেটিরিওলজি বা আবহাওয়াবিদ্যা এবং ইলেকট্রিক্যাল মেশিনারিজ ও রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন-লাইটনিং অ্যারেস্টার বিষয়ে পড়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে বেলজিয়ামের গেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করার সময় টেরেসট্রিয়াল ইকোলজির ওপর গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব বিষয়ে একটি অধ্যায় পড়ার অভিজ্ঞতা আছে আমার। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বজ্রনিরোধক বিষয়ে অভিজ্ঞতা থেকে বজ্রপাত প্রতিরোধ বিষয়ে এই মতামত প্রকাশ করছি।
বজ্রপাত প্রতিরোধের জন্য আমাদের দেশে সামাজিক বনায়নের মতো তালবীজ রোপণের একটি আন্দোলন শুরু হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি মহৎ উদ্যেগ। বিভিন্ন পরিবেশ ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন সংখ্যামানের তালবীজ রোপণ করেছে বা করবে বলে মিডিয়ায় এসেছে। আগামী ২০-৩০ বছরে তালগাছে ভরে যাবে দেশ। ফলস্বরূপ বজ্রপাতের কারণে প্রাণহানি ঘটবে না বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। কারণ তালগাছ সব বজ্রপাত প্রতিহত করবে।
তালগাছ অন্যসব বৃক্ষের চেয়ে উঁচু থাকে বলে এর ওপর বজ্রপাত হয়। এই জ্ঞান একটি লোকায়াত অভিজ্ঞতা। দীর্ঘদিন পরিবেশে বসবাসের মাধ্যমে এটি অর্জন করেছে মানুষ। আধুনিক সময়ে একে ‘সিটিজেন সায়েন্স’ বলা হয়। এমন একটি সুন্দর জ্ঞান বা বিজ্ঞানের মধ্যে একটু শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। তালগাছ বড় হতে অর্থাৎ বজ্রপাত ধরার মতো বড় হতে তালের জাত ও স্থানভেদে ২০-৩০ বছর সময় লাগবে। এই ২০-৩০ বছর সময়ে যে বজ্রপাত হবে এবং যে প্রাণহানি বা সম্পদহানি ঘটবে তার কী হবে? বর্তমান সময়ে যারা বসবাস করছেন তারা কি বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখেন না? এই প্রশ্ন কিন্তু কেউ করছেন না।

তাছাড়া সব তালবীজ থেকে চারা হয় না। একইভাবে বিভিন্ন কারণে সব চারা বড় তালগাছে পরিণত হয় না। সব জায়গায় তালগাছ লাগানো যাবে না ইত্যাদি কারণগুলো তালগাছ দিয়ে বজ্রপাত প্রতিরোধের প্রক্রিয়ায় অন্তরায় হয়ে আছে। তাহলে কি বজ্রপাত প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়?

কোনও লোকায়ত জ্ঞান যখন কোনও বিশেষ কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে বা দ্রুত করতে পারেনি, তখনই নতুন জ্ঞান বা প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটেছে। আধুনিককালে প্রযুক্তির মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। একইভাবে বজ্রপাতও প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ১৭৪৯-১৭৫২ সালের মধ্যে প্রথম লাইটনিং রড ব্যবহার করে বজ্রপাত প্রতিরোধের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ১৭৭২ সালে ঘুড়ি উড়িয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন— মেঘের বিদ্যুতই বজ্রপাতের কারণ। পরবর্তী সময়ে চেকোস্লোভাকিয়ার বিজ্ঞানী ডম প্রোকোপ ডিভিস ও.প্রায়েম ১৭৫৪ সালে বজ্রনিরোধক যন্ত্রটিকে উন্নত করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের আবহাওয়ার উপযোগী করে প্রয়োজন মতো বিভিন্ন বজ্রনিরোধক যন্ত্র বা ব্যবস্থা তৈরির পর তা ব্যবহার করে আসছে। সবচেয়ে শক্তিশালী বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয় উড়োজাহাজে। আমাদের দেশে বজ্রনিরোধক যন্ত্র বা ব্যবস্থা ব্যবহার করে বজ্রপাতের ফলে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রয়োজন মতো গবেষণা করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী লাইটনিং অ্যারেস্টার বা বজ্র নিরোধক যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব যা বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রের চেয়ে অনেক সস্তা হবে।

বজ্র নিরোধক যন্ত্রটি মূলত তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। এর একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত থাকে। প্রথমটি বায়ুমণ্ডলীয় রড বা দণ্ড, যা বজ্রবিদ্যুৎ ধরে থাকে। দ্বিতীয় অংশটি পরিবহন তার, যা বায়ুমণ্ডলীয় রডে বা দণ্ডে ধারণকৃত বজ্রবিদ্যুৎ পরিবহন করে থাকে। তৃতীয় অংশটি ভূমিস্থ রড, যা পরিবাহিত বজ্রবিদ্যুতকে মাটির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিউট্রালাইজ করে দেয়।

হাওর অঞ্চলের কোনও এলাকার বিশাল মাঠে তালবীজকে ২০-৩০ বছর পর বজ্রবিদ্যুৎ ধরার মতো বড় করা প্রায় অসম্ভব। কারণ এসব অঞ্চল বছরের অর্ধেকটা সময় পানির নিচে থাকে। এ কারণে তালের চারা বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম। এছাড়া অন্য অনেক কারণ আছে। এমন মাঠে বিদ্যুৎ পরিবহন লাইনের ট্রাসের মতো টাওয়ার তৈরি করে (মোবাইলের টাওয়ারের মতো) লাইটনিং অ্যারেস্টার বা বজ্র নিরোধক যন্ত্র বসানো যায়। সেজন্য তালগাছ বড় হতে ২০-৩০ বছর অপেক্ষা করা দরকার নেই। সরকার চাইলে এখনই এটি স্থাপন করতে পারে।

বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় এ ধরনের বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রয়োজনে হাওরের জ্যোতদার (যারা জমি বরগা দেয়) ও ধনী ব্যক্তিদেরকে তাদের জমির এলাকায় বজ্র নিরোধক যন্ত্র বসানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এর মাধ্যমে তাদের কৃষি জমিতে কাজ করা কৃষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

দেশে সাম্প্রতিক সময়ে আবহাওয়া অধিদফতরসহ বিশেষজ্ঞরা বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা, আলোচনা, প্রচারণাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছেন। মিডিয়ায় এগুলো উঠেও আসছে। বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল বজ্রপাত সৃষ্টিকারী মেঘ শনাক্তের জন্য ‘রাডার’ ও বজ্রপাত শনাক্তের জন্য ‘লাইটনিং ডিটেক্টর’ যন্ত্র আমদানি করে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে। রাডার দিয়ে বজ্রপাত সৃষ্টিকারী মেঘ শনাক্ত করে পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে সেই পূর্বাভাস পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরেক যন্ত্র ‘লাইটনিং ডিটেক্টর’ দিয়ে বজ্রপাত হয়েছে কিনা তা জানার চেষ্টা চলছে।

পশ্চিমা বিশ্বে এ ধরনের ব্যবস্থা গত শতকেই নেওয়া হয়েছে। আমরা অনেক দেরিতে তাদের অনুসরণ করছি বা তাদের আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণা করছি। পূর্বাভাসের এই প্রক্রিয়া কতটা সফল হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ কত সময় আগে পূর্বাভাস দেওয়া যাবে, কৃষকের সঙ্গে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন থাকবে কিনা, যে জায়গায় কৃষক আছেন সেখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবেন কিনা (অনেক হাওর এলাকায় কৃষকের দ্রুত যাওয়া প্রায় অসম্ভব) ইত্যাদি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

তবে দুঃখের বিষয় এত আলোচনা ও প্রচারণার মধ্যে কোথাও বলা হচ্ছে না, বজ্রপাত প্রতিরোধ কীভাবে হবে! কিছু বিশেষজ্ঞ লোকায়ত জ্ঞান ধার করে প্রচার করা হচ্ছে— তাল, নারিকেল, সুপারি গাছের চারা রোপণ ছাড়া বিকল্প নেই। আবার বজ্রপাত প্রতিরোধে ব্যবহৃত ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার যন্ত্র’ ব্যবহার দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। এই যন্ত্র কৃষকের সুরক্ষায় কাজে আসবে না বলে অভিমত তাদের।

মতামতটি বিপরীতমুখী। বজ্রপাত প্রতিরোধে তাল, নারিকেল, সুপারি গাছের বিকল্প ব্যবস্থা হলো ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার যন্ত্র’। আড়াই শতক ধরে পশ্চিমারা এটি ব্যবহার করে আসছে। দেশে রাডার ও ‘লাইটনিং ডিটেক্টর’ বসিয়ে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করা লাভজনক, কিন্তু যে যন্ত্র বজ্রপাত ধরে প্রাণহানি ও সম্পদহানি কমাবে তা কি অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক? এক্ষেত্রে কোনও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া সিদ্ধান্ত দেওয়ার মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন বজ্রপাতে ভুক্তভোগীদের মুক্তি নেই।

লেখক: অধ্যাপক, ফার্ম স্ট্রাকচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ