X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

গরু-ছাগল চেনা ড্রাইভার ও যাত্রী-পথচারী

এরশাদুল আলম প্রিন্স
০৫ আগস্ট ২০১৮, ১৭:৫৩আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০১৮, ১৮:০৩









এরশাদুল আলম প্রিন্স নিরাপদ সড়কের দাবি আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। নিরাপদ সড়কের জন্য কম কথা-বার্তা হয়নি। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনা কমেনি। কোনও কোনও বছর হয়তো আগের বছরের বেশি দুর্ঘটনা কম হয়। কিন্তু দুর্ঘটনা কমার এ হার ধারাবাহিক নয়। তাই আমরা আশাবাদী হতে পারি না।




তথ্য বলছে, ২০১৫ সালের চেয়ে ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা কম। ২০১৬ সালে ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত, অর্থাৎ দিনে কমপক্ষে ১৬ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু পরের বছরই ২০১৭ সালে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩৯৭। অর্থাৎ গত বছর প্রতিদিন নিহত হয়েছে কমপক্ষে ২০ জন। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকটি দুর্ঘটনা একেকটি করুণ কাহিনী। অনেক গল্প ও স্বপ্নের অপমৃত্যু।
সড়ক দুর্ঘটনা হয়তো পুরোপুরি রোধ করা যাবে না। কোনো দেশই তা পুরোপুরি রোধ করতে পারেনি। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণগুলো অনুসন্ধান করে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যায়। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আমাদের দেশে দুর্ঘটনা না কমার প্রধান কারণ সড়ক ব্যবস্থাপনা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয়নি।
ঘুরেফিরে সেই আইনের কথাই আসে। আসলে আইনের শাসন না থাকলে সেখানে নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকে না। কথায় বলে, একটি দেশ কতটা উন্নত বা সভ্য, তা বোঝা যায় রাস্তায় বের হলে। অবকাঠামোয় আমরা উন্নত হতে পেরেছি, কিন্তু ব্যবস্থাপনায় কি সভ্য হতে পেরেছি?
দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে। কোনও গুরুতর সমস্যা হলে বা কোনও বড় ধরনের অপরাধ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সরকার থেকে আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বলা হয়, দেশে যথাযথ আইন নেই, তাই নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। না হয় বিদ্যমান আইনের সংশোধন করতে হবে। এটি আসলে আপাতত জনগণকে এক ধরন শান্ত বা আশ্বস্ত করার এক সরকারি কৌশলমাত্র। হয়তো এটি অনেকক্ষেত্রে সত্যও। কিন্তু সবক্ষেত্রে নয়। কারণ, আইনের অভাবে অপরাধীদের শাস্তি বিধান করা যায়নি, এমন নজির কম। আবার এটাও মনে রাখতে হবে আইনশাস্ত্র পড়ে কেউ অপরাধ করে না। কাজেই, কঠোর আইন করে অপরাধ দমন করা গেছে বা হ্রাস করা গেছে, এমন নজিরও কম। আইন এখানে শুধুই অজুহাত। আসল কথা হচ্ছে, আইনের প্রয়োগ।
অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের আইনের শাসন যেমন তলানিতে ঠেকেছে, সড়ক ব্যবস্থাপনায়ও সেই একই অবস্থা। সড়ক ব্যবস্থাপনায় আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ঢাকার সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের সড়কে ‘অব্যবস্থাপনা’, ‘আইন ও বিচারহীনতা’ তথা ‘অনিয়ম’-এর উৎকৃষ্ট (নাকি নিকৃষ্ট?) নজির।
ঢাকায় যেসব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলাচল করে, এসব গাড়ির ফিটনেস অনেক পরের কথা, গাড়ির সুরতহাল দেখলেই তো চলাচলের অনুমতি পাওয়ার কথা না। তার ওপর লুকিং গ্লাস, মিরর, বিভিন্ন লাইটের যে অবস্থা, তাতে মনে হয়, ঢাকার সড়ক ব্যবস্থাপনার কোনও রেগুলেটর বা নিয়ন্ত্রক নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আইন কি বলেছে এসব গাড়ি চলাচল করতে পারবে? আইন যারা কার্যকর করেন, তাদের দায়িত্বকে অস্বীকার করে সব দোষ আইনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে পার পাওয়ার এ সংস্কৃতি উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো আর কি।
দেশে মোটরযান বিষয়ক ডজন খানেক আইন আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘জাতীয় স্থল পরিবহন নীতিমালা ২০০৪’, ‘মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩’, ‘মোটরযান বিধিমালা ১৯৮৪’। এ তিনটি আইন মূলত সড়কে যানবাহন চলাচল সংক্রান্ত। অর্থাৎ রাস্তায় মোটরযান চলাচলে নিয়ম-শৃঙ্খলা বিষয়ক। এছাড়া বাকি আরও ১০টি আইন আছে, যেগুলো মূলত মোটরযানের নিবন্ধন, ট্যাক্স, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন ধরনের বিশেষায়িত যানবাহন যেমন ট্যাক্সিক্যাব, সিএনজি, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদি বিষয়ক।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষায় ৯০-এর দশক থেকে দেশে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু দেশের মোটরযান বিষয়ক আইনটি হয়েছিল তৎকালীন চিফ মার্শাল এডমিনিস্ট্রেটরের আমলে। সেই আইন দিয়েই গণতন্ত্রের চার দশক পার হচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা ওই অধ্যাদেশটির সময়োপযোগী সংশোধন করে আইনে পরিণত করতে পারিনি। চার দশকে সে সময়, সুযোগ ও এর প্রয়োজন আমরা অনুভব করিনি। এর একটিই কারণ, সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের কোনও ধরনের মনোযোগ নেই। কারণ, ভিআইপিদের এসব লাগে না। সাধারণ যানবাহন তাদের লাগে না। তাই রাস্তাঘাট উন্নয়নের দিকে যত মনোযোগ, তার সিকিভাগ মনোযোগও নেই রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দিকে।
মোটরযান অধ্যাদেশের অনেক ধারাই সময়োপযোগী না এ কথা সত্য। কারণ গত প্রায় ৪০ বছরে দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা, যানবাহন ও সড়কের ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন এসেছে। সে বিষয়গুলো এখানে সংযোজন করা প্রয়োজন। সড়ক ব্যবস্থাপনার ধারণায়ও অনেক পরিবর্তন এসেছে। দেশ ‘ডিজিটাল’ হচ্ছে। বিআরটিএ’র কার্যক্রমেও কিছু ডিজিটাইলাজেশন হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জনগণ এর সুফল পাচ্ছে না।। বিআরটিএ’র অফিস এখনও দালালের দখলে। নিয়ম অনুযায়ী কেউ গাড়ির ফিটনেস করাতে গেলে তার সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দালাল ধরলে একঘণ্টায় কাজ শেষ। বিআরটিএ’র সামনেই এসব চলছে। দেখার কেউ নেই। ফলে, গাড়ির মালিক ও চালকও সে পথেই চলছেন। ফিটনেসের জন্য সঙ্গে গাড়ি না নিয়ে গেলেও চলে। সে ব্যবস্থাও আছে। সেক্ষেত্রে পয়সা একটু বেশি লাগে। গাড়ির সব কাগজপত্র নবায়নের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য।
ঢাকায় যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করে, তাতে বিআরটিএ’র বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবি। একটি গাড়ির ফিটনেস করাতে যদি সারাদিন লেগে যায় সেটি দুঃখজনক। বিআরটিএ’র লোকবল, সক্ষমতা, সততা ও সদিচ্ছা—এর প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা সড়ক ব্যবস্থাপনার একটি দিক মাত্র। কিন্তু যাদের চোখের সামনে দিয়ে ১০-১২ বছরের শিশুরা লেগুনা চালায়, ১৫-১৬ বছরের নাবালকরা গাবতলী-গুলিস্তানের গাড়ি চালায়, তাদের দায়িত্বশীলতার জায়গাটি তবে কোথায়? ট্রাফিক পুলিশ কি এসব দেখে না?
জাবালে নুর পরিবহনের চালক ও মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা চালকের শাস্তি চাই। তারচেয়েও বেশি চাই ন্যায়বিচার। এটি কোনও দুর্ঘটনা না, হত্যাকাণ্ড। কারণ, সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু দিনের বেলায় ব্যস্ত সড়কে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী তুলতে গিয়ে ফুটপাতের শিশু নিহত হওয়াকে স্রেফ দুর্ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। সড়ক পরিবহন আইনের ৩ বছরের কারাদণ্ড দুর্ঘটনার জন্য প্রযোজ্য। মানুষ হত্যার জন্য নয়। গাড়ি চালনা অনেক বড় একটি দায়িত্ব। সামান্য একটু ভুলে এখানে অনেক মানুষের প্রাণহানি হতে পারে।

জাবালে নুর গাড়ির রুট পারমিট বাতিল করা ও চালকের শাস্তি বিধান করা—সুনির্দিষ্ট এই অপরাধের প্রতিকার হতে পারে। আমরা তা চাই। কিন্তু তাতে ঢাকার সড়ক ব্যবস্থাপনায় কোনও উন্নতি হবে না। কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে দিয়ে আরও শতশত ফিটনেস ও অনুমোদন বিহীন গাড়ি চলাচল করছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওইসব কর্তাব্যক্তির শাস্তি হতে দেখিনি। দেশের পুরো সড়ক পরিবহন একটি ‘সিস্টেমে’ চলে। গাড়ির চালক, মালিক, যাত্রী এই সিস্টেমের ব্যবহারকারী মাত্র। কিন্তু যারা এই সিস্টেমের সৃষ্টি করেছে তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে এই ‘সিস্টেম’কে ঢেলে সাজানো যাবে না। কিন্তু আশু প্রয়োজন এই সিস্টেমে হাত দেয়া। রাস্তায় গরু-ছাগল দেখে চিনতে পারলে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া ওই সিস্টেমেরই অংশ। এ সিস্টেমে যাত্রীরা পিঁপড়ার সমান। চাকায় পিষ্ট হওয়া সেখানে ব্যাপারই না। এই সিস্টেম ভাঙতে না পারলে সেখানে রাজীব বা দীয়া দীর্ঘ তালিকার দুটি নাম মাত্র।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ