X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিডিয়ার জন্য কীভাবে লিখবো?

মো. সামসুল ইসলাম
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:১৭আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:২৪

মো. সামসুল ইসলাম

কয়েক দিন আগে এক পুরনো অসাংবাদিক বন্ধু আমার কাছে পত্রিকায় প্রকাশিত তার দুটো লেখা পাঠিয়ে মতামত জানতে চেয়েছেন। মিডিয়ার অভাবনীয় উৎকর্ষের যুগে অনেকেই মিডিয়ায় লিখতে চান এবং সাংবাদিক বা সাংবাদিকতার শিক্ষকদের পরামর্শ চান। আমার কাছেও সম্প্রতি কয়েকজন পরামর্শ চেয়েছেন, তাদের মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবীরাও রয়েছেন। 

মিডিয়ায় লেখালেখির ব্যাপারে সাজেশন দেয়া বেশ কঠিন একটা ব্যাপার– একেকজন একেক কথা বলবেন। আর এ পরামর্শ দেয়ার ব্যাপারে আমি যে যোগ্য লোক তাও মনে করি না। কিন্তু মিডিয়ায় লেখালেখির ক্ষেত্রে আমি যে নিয়মগুলো মেনে চলি তা শেয়ার করতে পারি। এগুলো নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত। 

তবে কীভাবে লেখালেখি করবো তা জানার আগে কেন লেখালেখি করব এটা জানাও জরুরি। লেখালেখি করে আমি কি উদ্দেশ্য অর্জন করতে চাই সেটা তো আমাকে জানতেই হবে। যেমন, কেউ যদি মনে করেন শুধু মিডিয়ায় লেখালেখি করে এদেশে জীবিকা নির্বাহ করবেন তা খুব একটা ভালো ধারণা নয়। আবার কেউ যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লিখেন তবে এর ঝুঁকি সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে।  

এ প্রসঙ্গে মজার এক ঘটনা মনে পড়লো।  

সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দিককার নাটক এইসব দিনরাত্রি চলাকালীন সময়ের কথা। তুমুল জনপ্রিয় তার নাটকে বুঁদ হয়ে আছে পুরো দেশ। এমন সময় হুমায়ূন আহমেদ কোথায় যেন মন্তব্য করলেন তার এ নাটকটি লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাসায় একটি কালার টিভি কেনা। ইতোমধ্যে টিভিটি কেনা হয়েছে এবং এর ফলে এই নাটকের ব্যাপারে তার আগ্রহ কমে গিয়েছে। 

আমি নিশ্চিত এটা তিনি মজা করেই বলেছিলেন। কিন্ত অসম্ভব সুন্দর এক নাটকের মাধ্যমে অপার্থিব আনন্দে মত্ত অনেক দর্শক এতে নিতান্তই আহত হলেন। হঠাৎ করে লেখকের তুমুল বাস্তব একটি কথা তাদের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। নাটকের দুই একজন শিল্পীও এতে প্রতিবাদ করলেন! 

আমি অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের প্রসঙ্গ কিছুটা ইচ্ছে করেই এনেছি এই কারণে, তিনি লেখক হিসেবে মিডিয়াকে বুঝতেন। কীভাবে মিডিয়ায় লিখতে বা উপস্থাপনা করতে হবে তা তিনি জানতেন। আর সেটি হচ্ছে খুবই সাধারণ একটি সূত্র। মিডিয়ার জন্য যেকোনও লেখাই হতে হবে স্পষ্ট, সহজবোধ্য আর সরাসরি। আমরা যেভাবে কথা বলি ঠিক সেভাবে। কোনও ঘোরপ্যাঁচ থাকা যাবে না। কারণ একটাই। মিডিয়ার পাঠক, দর্শক বা শ্রোতা সব শ্রেণির সব বয়সের– যাদের শিক্ষার স্তরও ভিন্ন ভিন্ন। এমনকি একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তিও যখন মিডিয়ার জন্য লিখবেন তখন তাকেও সহজ করে বলতে হবে, যতদূর সম্ভব টেকনিক্যাল শব্দ বা জার্গন পরিহার করতে হবে।

লেখার মধ্যে অবশ্যই নতুনত্ব থাকতে হবে। নিজের কাছেই প্রশ্ন করতে হবে আমি এ লেখাটিতে নতুন কি তথ্য দিচ্ছি। দুঃখের বিষয় এই মাপকাঠিতে মিডিয়ায় প্রেরিত অনেক লেখাকেই সাংবাদিকরা অনুত্তীর্ণ পেয়ে থাকেন। একজন লেখক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাজনীতি যেকোনও বিষয়েই লিখুন না কেন তাকে লেখায় নতুন তথ্য যোগ করতে হবে। সে তথ্য আবার বাস্তবসম্মত হতে হবে, অবাস্তব কিছু হলে চলবে না।

একটা উদাহরণ দেই। প্রায়ই আমি দেখি আমাদের পত্রিকাগুলোতে স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখাতে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগ সম্পর্কে লেখা হয় এবং একই তথ্য দিনের পর দিন দেয়া হয়। একই পাঠকের সামনে একই তথ্য, যেমন- প্রতিদিন ত্রিশ মিনিট হাঁটুন, ওজন কমান, রেডমিট বাদ দিন ইত্যাদি কিছুদিন পরপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক পত্রিকায় লিখা হয়। এতে পাঠকরা স্বভাবতই বিরক্ত হন। অথচ নতুন উদ্ভাবন, প্রাকৃতিক চিকিৎসা, সুস্থ হয়েছেন এমন রোগীর সাক্ষাৎকার ইত্যাদির মাধ্যমে লেখাকে আকর্ষণীয় করা যেতে পারে, যা পাঠকরা হয়তো পছন্দ করবেন।

মিডিয়ায় লেখার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবাই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তা হলো দেশের বিদ্যমান আইন, সংবিধান, মূল্যবোধ ইত্যাদি মেনে চলা। মিডিয়ায় যে যা লিখবেন বা বলবেন তা তো বহুকাল সংরক্ষিত থাকবে। আমরা তো দেখছি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বিপক্ষে সেই সময় যে যা লিখেছেন বা বলেছেন তা বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টে পরিণত হয়েছে।    

লেখকদের জন্য একদিকে আইন, মূল্যবোধ মেনে চলা, অন্যদিকে নতুন ধারণা দেয়া এক কঠিন চ্যালেঞ্জই বটে। আবার আমাদের মতো অতিমাত্রায় রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল ও বহুধাবিভক্ত সমাজে লেখালেখি কিছুটা বিপজ্জনকও বলা যায়। আমার লেখালেখির অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, আমাদের দেশের পাঠকরা চান লেখক হিসেবে আপনি তাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তীব্র আক্রমণ করে একেবারে ধরাশায়ী করবেন। এতে আপনি অন্তত একপক্ষের সমর্থন আর অন্যদের বিরোধিতার মাঝে খুব সহজেই জনপ্রিয়, আলোচিত হয়ে যাবেন। 

তবে এটি কোনোভাবেই সুস্থচিন্তা বা শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। সাংবাদিকতার টেক্সট বইয়ে আমরা পড়েছি বস্তনিষ্ঠ রিপোর্ট বা লেখা সেটাই যেটা সবপক্ষকে অখুশি করবে। কিন্তু এভাবে লিখে বাংলাদেশে পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। বাংলাদেশের পাঠক খুঁজবে আপনার সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থান– আপনি আসলে কার পক্ষে কথা বলছেন। এরপরও আমি বললো, নির্মোহ বা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের একটা প্রচেষ্টা থাকা উচিত লেখকদের মাঝে। 

মিডিয়ার একজন লেখককে সামাজিক, রাজনৈতিক ও উন্নয়নের তত্ত্বসমূহ জানতে হবে এবং লেখাতে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। আমি এভাবেই লেখার চেষ্টা করি। কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলা ট্রিবিউনে আমার সর্বশেষ লেখায় আমি নিরাপদ সড়ক চাই, শিক্ষা সংস্কার, চিকিৎসাসহ সাম্প্রতিক কয়েকটি অরাজনৈতিক দাবিকে সমাজে এলিট বা প্রভাবশালীদের অনাগ্রহ হিসেবে কিছুটা তত্ত্বগত দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করি। 

নিরাপদ সড়কের দাবির ক্ষেত্রে আমি একপর্যায়ে লিখি যে ঢাকায় প্রভাবশালীদের গাড়ি কমাতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে বলি যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার নিম্নমানের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রভাবশালীরা তাদের ছেলেমেয়েদের দেশি মাধ্যমে পড়ান না, তারা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ান। এরকম আরও কয়েকটা জনদাবির ক্ষেত্রে বলেছি যে এসব সমস্যার সমাধানে এলিটদের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

যেকোনও বিষয়ের তাত্ত্বিক, সাম্প্রতিক ও একটি বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে সমস্যার গভীরে যেতে সহায়তা করবে।  মজার ব্যাপার যে গত ২২শে সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ঢাকা শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণর কথা বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে এবং এতে সমস্যা সমাধানের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যাচ্ছে। 

একইভাবে বলা যায়, কেউ যদি বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ন নিয়ে লিখতে চান তাকে বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জানতে হবে; শিক্ষা নিয়ে লিখতে চাইলে শিক্ষা ব্যবস্থার সাম্প্রতিক দর্শন, কোয়ালিটি এসুরেন্স ইত্যাদি বুঝতে হবে; মানিলন্ড্রানিং নিয়ে লিখতে চাইলে এর ধাপসমূহ, বৈদেশিক বিনিয়োগ, ডিজিটাল কারেন্সি ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। লেখালেখিতে আপনি কি ভাবছেন সেটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পাঠক, নীতিনির্ধারক ও বিজ্ঞজনদের মাঝে আপনার লেখার স্বীকৃতি।

আবারও বলছি, মিডিয়ায় লেখালেখি নিয়ে আমার এসব মতামত একেবারেই নিজস্ব। আরেকজন হয়তো অন্যভাবে পরামর্শ দিবেন। তবে স্বল্পপরিসরে এর চেয়ে বেশি কিছু বলারও অবকাশ নেই। 

 

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]

 

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
নারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
জরিপের তথ্যনারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ