X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাম্প্রতিক রাজনীতির এক নির্মোহ পর্যালোচনা

মো. সামসুল ইসলাম
২৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৫০আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৫১

মো. সামসুল ইসলাম দেশের রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে আসলে কী ভাবছে জনগণ? একজন বিশ্লেষক হিসেবে আমি পত্রপত্রিকায় জনগণের মতামত জানতে সবসময় আগ্রহী থাকি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙা-গড়ার খেলা বা তাদের নিয়ে বিভিন্ন লেখকদের বিশ্লেষণ আসলে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারক নয়। ভোটযুদ্ধ তো হবে মাঠে। বিদেশে ভোটের আগে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন নির্বাচনি জরিপ হয়। আমাদের দেশে তো এ ধরনের জরিপ ততটা জনপ্রিয় নয়। যতই বিজ্ঞানভিত্তিক হোক, মানুষজন তা বিশ্বাসও করে না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। একজন গবেষক হিসেবে আমি আমাদের দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির কয়েকটি দিক তুলে ধরতে চাই, যা নির্বাচনের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে বা করবে। আমরা সবাই আশা করছি ভোট সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হবে। আর আমার এ পর্যালোচনাগুলো একেবারেই একাডেমিক পর্যবেক্ষণ, এতে যে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করতেই পারেন।
রাজনীতির কয়েকটি প্রবণতা তো বেশ অবাক করা ব্যাপার। যেমন, দল বা জোটের নেতাদের বিদ্বেষ অটুট থাকলেও আমরা দেখছি আমাদের রাজনীতির প্রধান দুই ধারার ক্ষেত্রেই তাদের এতদিনের আদর্শিক ইমেজের পরিবর্তন।

যেমন– প্রথমত, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেনসহ নেতাদের মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা চরম আওয়ামী বিদ্বেষী ভোটারদের মধ্যে কী প্রভাব ফেলবে তা বোঝা মুশকিল। তবে রাজনীতির একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা স্বস্তি পেতে পারেন। আর বিএনপিও এই বিষয়ে নীরব থেকে হয়তো এটা মেনে নিয়েছে যে বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশে এক অপরিহার্য বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে এদেশে আর রাজনীতি সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, দেশের কওমি মাদ্রাসার আলেমদের সঙ্গে সখ্য এবং তাদের ডিগ্রিকে বৈধতাদানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় জোট ইসলামপন্থীদের আরও কাছাকাছি আসতে পেরেছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের এটি একটি বিশাল পদক্ষেপ, যা এতদিনের ভোটের হিসাব-নিকাশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা মাদ্রাসাগুলোর লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষক, আমাদের রক্ষণশীল সমাজে যাদের রয়েছে এক বিশাল প্রভাব– তারা এই স্বীকৃতিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।

আওয়ামী লীগের বা ১৪ দলীয় জোটের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের ওপর এ স্বীকৃতি কোনও আঘাত নয়। বরং এর মাধ্যমে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার যে সংযোগ ঘটবে তা দেশের আর্থসামজিক উন্নয়নের জন্য হয়তো সহায়ক হবে। জাতীয়ভাবে চাকরিতে এবং রাষ্ট্রীয় সব সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বাড়তি পাওনা হিসেবে আওয়ামী লীগ অবশ্যই ভোটযুদ্ধে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন পাবে। এ পদক্ষেপ ভোটযুদ্ধের ক্ষেত্রেও একটি বড় নির্ধারক হবে।

এ পদক্ষেপ আওয়ামী লীগের জন্য ইতিবাচক হলে আওয়ামী লীগের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে প্রতি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সামলানো এবং মনোনয়নের পর নেতাকর্মীদের মধ্যে একতা ধরে রাখা। প্রায় ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এ দলটির দেশের অনেক আসনেই রয়েছে ক্ষমতা প্রত্যাশী অতিরিক্ত নেতাকর্মীদের ভিড়। এর ওপর পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে তারা নাকি জোটের শরিকদের ও মিত্রদের প্রায় ১০০ আসন ছেড়ে দেবে।

সুতরাং সঠিক ব্যবস্থা না নিলে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়তে পারে অথবা নেতারা একে অপরকে নীরব অসহযোগিতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভোট প্রাপ্তিকে প্রভাবিত করতে পারেন।

অপরদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জন্য নির্বাচনি চ্যালেঞ্জ কিন্তু আসলেই বহুমুখী। এই জোটের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা এর নেতৃত্বের বা আদর্শিক সংকটের কথা বলবেন। বিএনপির সমর্থকরাই হয়তো বলবেন গত ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপিকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এখন ভিন্ন আদর্শের কিছু রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক লোক দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নামে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা কতটুকু বাস্তবসম্মত হবে। আবার বিএনপি এর মধ্যে এতদিন পর সংস্কারপন্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা শুরু করেছে। মাঠপর্যায়ে ভোটের অংক যোগ-বিয়োগের খেলায় তাদের সামর্থ্য বা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কিন্তু বিএনপিতেই বিতর্ক হতে পারে।

বেগম জিয়া কারাগারে, তারেক জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ২১ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন। ড. কামাল হোসেন ঘোষণা দিয়েছেন তিনি নির্বাচন করবেন না বা সরকারে থাকবেন না।

আবার টেলিভিশনে বিতর্কিত মন্তব্য করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে সুশীল সমাজের ব্যক্তি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দুইজনেই চাপের মুখে আছেন। ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে উত্তপ্ত বিশ্ব পরিস্থিতিতে নারীদের সম্মানবিরোধী কথা বলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আসলে নিজের বিপদ নিজেই টেনে এনেছেন। টেলিভিশনে সরাসরি কথাবার্তার মাধ্যমে তারা দুজনেই সর্বসমক্ষে এটাই প্রমাণ করেছেন যে সুশীল সমাজের লোকজনকে দিয়ে আর যাই হোক এদেশে রাজনীতি সম্ভব নয়। আমি নিশ্চিত যে, এমনকি বিএনপির কোনও পরিপক্ব রাজনীতিবিদও তাদের মতো এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতেন না।

ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের ব্যাপক সমর্থন থাকলেও কয়েকটি বিষয়ে তাদের অস্বস্তি আছে। প্রথমত তারা জানে না যে ঐক্যফ্রন্টের মূল নেতৃত্ব আসলে কার হাতে; দ্বিতীয়ত, তারা জানেন না এমনকি ঐক্যফ্রন্ট বিজয়ী হলেও তাদের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তৃতীয়ত তাদের সাত দফা মানা না হলে তারা কি নির্বাচনে যাবেন কী যাবেন না সেটাও সমর্থকদের কাছে পরিষ্কার নয়।

ভোট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তি বড় কোনও প্রভাবক না হলেও নতুন সরকারের প্রতি বৈদেশিক সরকারের সমর্থন নিশ্চয়ই বড় একটি ব্যাপার। পাঠকদের হয়তো মনে আছে, পত্রিকার খবর অনুযায়ী গত ১৮ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা যখন কূটনীতিকদের ব্রিফ করছিলেন তখন তারা নাকি বারবার জানতে চাইছিলেন ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। এর উত্তর তো আসলে নেতাদের কাছেও নেই, তারা সংবিধানের কথা বলেছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে আসলে কে এটা জানতে চাইলে যৌথ নেতৃত্বের কথা বলা হয়েছে। কূটনীতিকরা জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা নিয়েও নাকি জানতে চেয়েছেন।     

এটা বোধগম্য ব্যাপার যে পশ্চিমাসহ অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাইবেন। কিন্তু উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে, বা তাদের বিনিয়োগকে সুরক্ষিত করতে তারা চাইবেন দেশে এক ধরনের স্থিতিশীলতা। রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনা, জঙ্গিবাদ দমনে দক্ষতা এই বিষয়গুলোর জন্যও তার জানতে চাইবেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সরকার হলে তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বা আদর্শ সম্পর্কে, জানতে চাইবেন তাদের সঙ্গে জামাতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। বলাবাহুল্য এই বিষয়গুলো নিয়ে বিদেশি বন্ধু দেশগুলোর মধ্যেও কোনও স্বচ্ছ ধারণা নেই।

এরমধ্যে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে পশ্চিমা দেশগুলো ভয় পাচ্ছে যে বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করতে পারে। তফসিল ঘোষণা হলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবিগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনার আর কোনও পথ থাকবে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রসহ দাতা দেশগুলো নাকি চাচ্ছে সংবিধানের ১২৩ এর ‘খ’ ধারা অনুযায়ী অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে নির্বাচন পিছিয়ে মার্চ-এপ্রিলে করতে। যাতে আলাপ আলোচনার পথ খোলা থাকে। যদিও সরকার এটি উড়িয়ে দিয়েছে এবং বলছে নির্বাচন সঠিক সময়েই হবে।  

সবশেষে বলা যায়, রাজনীতি এক চরম অনিশ্চয়তার ‘খেলা’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষরা একে অন্যকে বিভিন্নভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। আবার নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাঙাগড়া বা আলোচনা চলতে থাকবে। নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাই চূড়ান্ত কিছু বলা সম্ভব না– আমরা রাজনৈতিক প্রবণতাগুলো শুধু শনাক্ত করতে পারি মাত্র।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ