X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

গাধার পিঠে চড়বেন, না হেঁটে যাবেন?

হারুন উর রশীদ
১২ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৩০আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৩১

হারুন উর রশীদ গল্পটা একটু পরেই বলি। তার আগে বলে নিই, আপনি যে সিদ্ধান্তই নেবেন তার সমালোচনা থাকবেই। এমন কোনও কাজ নেই যার সমালোচনা নেই বা করা যায় না। যারা বলে ভালো কাজের সমালোচনা নেই তাদের বলি, একটা ভালো কাজ করেই দেখেন না। কত বন্ধু শত্রুতে পরিণত হবে।
গল্পটা এরকম। এক দম্পতি একটি গাধা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন রাস্তা দিয়ে। পথচারীরা তাদের দেখে বলছেন, কত বড় বোকা গাধার পিঠে না চড়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর ওই দম্পতি গাধার পিঠে চড়েই চলতে শুরু করলেন। তখন আরেক দল পথচারী বললেন, কী নির্মম! একটি গাধার পিঠে দুজন চড়েছেন। এটা পশুর প্রতি চরম নির্মমতা। এবার শুধু স্বামী গাধার পিঠে চড়লেন, স্ত্রী চললেন হেঁটে। সমালোচনা থামছে না। কেউ কেউ বললেন, কেমন স্বামী! স্ত্রী হাঁটছেন আর স্বামী গাধার পিঠে চড়ে যাচ্ছেন! এমন স্বামীও হয়!এবার গল্পের শেষ পর্ব শুনুন। স্ত্রী গাধার পিঠে আর স্বামী হেঁটে চলছেন। সমালোচনার তীর আরও তীব্র। তারা বললেন, কোনও স্ত্রী কি পারে নিজে গাধার পিঠে চড়ে স্বামীকে হাঁটিয়ে নিতে?
আরও একটি গল্প বলি। এক ভোজন রসিক ব্যক্তিকে কেউই দাওয়াত খাইয়ে খুশি করতে পারতো না। একদিন পড়ার ছেলেরা চ্যালেঞ্জ নিলো তাকে দাওয়াত খাইয়ে খুশি করার। তার তাই কৌশলে তার প্রিয় খাবার, কী পরিমাণ খেতে পারেন, সবকিছু জেনে তাকে দাওয়াত করলেন। তারপর তাকে তার প্রিয় সব খাবার খাওয়ালেন। লোকটি তৃপ্তি করে খেলো। তৃপ্তির ঢেকুর তুললো। এবার ওই তরুণরা ভাবলো তাদের জয় হয়েছে। তারা ভাবলো লোকটিকে খাইয়ে খুশি করতে পেরেছে। তাই তারা ভীষণ আগ্রহী হয়ে লোকটি শেষে জিজ্ঞেস করলো, খাবার ভালো হয়েছে? লোকটি তাদের দিকে তাকালেন, হাসিমুখ করলেন। তরুণরা আশান্বিত হলো। কিন্তু উত্তর শুনে তারা দপ করে নিভে গেলো। লোকটি কী জবাব দিয়েছিলেন জানেন? জবাব দিয়েছিলেন, ‘অত ভালো ভালো না’।

সাধারণ মানুষের এই নানা ধরনের মন্তব্যের ভেতর শুধু দোষ খুঁজে লাভ নেই। জ্ঞানী, মনীষীরাই এরকম করেছেন। যেমন আমরা জানি মনীষীরা বলেছেন, অর্থই অনর্থের মূল। আবার তারাই বলেছেন টাকা মধুর চেয়েও মিষ্টি। আবার দেখেন, জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড। এর বিপরীতে আছে জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন। আবার বলা হয়েছে মানুষই তার ভাগ্যের নির্মাতা। ব্যর্থতাই সাফল্যের চাবিকাঠি। এর বিপরীতে আছে সাফল্য আরও সাফল্য বয়ে আনে। এরকম আরও অনেক প্রবাদ বাক্যের উদাহরণ দেওয়া যাবে, যা একই বিষয়ে বৈপরীত্যমূলক। আসলে আমরা মনে হয়েছে এসব প্রবাদ বাক্য মনীষীরা তৈরি করেছেন পরিস্থিতি অনুযায়ী। যেকোনও পরিস্থিতিতে মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য। আর মানুষও সমালোচনা করে তার অবস্থান থেকে। সে যেভাবে চিন্তা করে বা ভাবে অথবা তার স্বার্থ যাতে সংরক্ষিত হয় সেভাবেই সে বক্তব্য দেয়।

বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা নড়াইল-২ আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাকে দোয়াও করেছেন। সাকিব আল হাসানও মাশরাফির পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নাকি নির্বাচন এবার করছেন না। প্রধানমন্ত্রী তাকে খেলা নিয়ে আরও মনোযোগী হতে বলেছেন।  

কে নির্বাচন করবেন আর কে করবেন না তা তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু আমার কথা হলো– হায়! হায়! রব নিয়ে। তারা নির্বাচন করলে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। জাতি রসাতলে যাবে। ক্রিকেটের শবযাত্রা হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ বলছেন, তারা তো পুরো জাতির ভালোবাসার ধন। কেন তারা খণ্ডিত হয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করবেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, তারা কেন রজনীতির মতো ‘নোংরা’ বিষয়ে জড়াবেন। কেউ বলেছেন, রাজনীতি করা মানে বিতর্কিত হওয়া। তারা কেন নির্বাচন করে বিতর্কিত হবেন?

এসব বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে আমাদের চরিত্রের বৈপরীত্য গভীরভাবে ধরা পড়ে। আমরা আলাপে, আলোচনায়, আড্ডায়, টকশোতে, সেমিনারে, মাঠে-ঘাটে বলতে শুনি রাজনীতিতে ভালো মানুষ আসার প্রয়োজন। এখানে যোগ্য মানুষের আসার দরকার। কিন্তু তারাই এখন মাশরাফি, সাকিবের মতো ‘জাতীয় বীররা’ যখন রাজনীতিতে আসতে চান, নির্বাচন করতে চান, তখন সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। তারাই নানা ফন্দি করেন। গেলো, গেলো বলে চিৎকার শুরু করেন।

এবার আমার শুরুর গল্পের সঙ্গে মিল পাচ্ছেন? আবার যদি মাশরাফিরা মনোনয়ন চেয়ে না পান তাহলে সমালোচনা উঠবে, ‘ওরা জাতীয় বীরদের সম্মান করতে জানে না। রাজনীতিতে ওরা ভালো মানুষকে চায় না। রজনীতি একটা নোংরা খেলা’।

ক্রিকেটার ছাড়াও এবার ফুটবলারও আছেন। আছেন শোবিজের অনেক তারকা, যারা নির্বাচনে দাঁড়াতে চান। তারা কেউ আওয়ামী লীগ আবার কেউ বিএনপি বা অন্য দলের মনোনয়নের অপেক্ষায় আছেন। দলগুলো যদি তাদের যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দেবে। ভোটাররা ভোট দিলে তারা এমপি-মন্ত্রী হবেন। এতে দোষের কিছু আমি দেখছি না। আর কেউ যদি তাদের পেশা পরিবর্তন করতে চান সেটা তার সিদ্ধান্ত। আমাদের এত হইচই করার কী আছে! আসলে এই হইচইয়ের মধ্যেও আরেক ধরনের রাজনীতি আছে। সেটা হলো, তাদের সিদ্ধান্ত কার পক্ষে যাচ্ছে। তা দিয়ে দোষ-গুণ চিন্তা করা হয়।

বাংলাদেশ কেন, এই উপমহাদেশ তথা সারা বিশ্বে ক্রিকেটার, ফুটবলার বা শোবিজের তারকাদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া, মন্ত্রী এমপি হওয়া সাধারণ ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস তো অনেককেই এভাবে রাজনীতির মাঠে এনেছে। তাকে কি খুব ক্ষতি হয়েছে?

হ্যাঁ। আমিও মনে করি রাজনীতি একটি চর্চার বিষয়। রাজনীতিবিদদেরই উচিত রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, কেউ রাজনীতিতে প্রবেশ করতে পারবেন না। আর যারা বলেন রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে, ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে, তাদের জন্য তো এটা সুখবর। কারণ, বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির ভালো মানুষ যদি রাজনীতিতে আসেন তাহলে রাজনীতি পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

ভোট রাজনীতির একটি বিষয় হলো প্রার্থীকে পাস করিয়ে আনা। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থী নির্বাচনে সেটাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। গাধার পিঠে চড়বেন, না হেঁটে যাবেন সেটা তারা তাদের বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন। চতুর্মুখী সমালোচনায় কান দিলে তো তারা তাদের কাজই করতে পারবেন না।

আমরা যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের বর্তমান সখ্যের সমালোচনা করি, তারা আমাদের আদর্শের জায়গা থেকে সমালোচনা করি, আমাদের অবস্থান থেকে সমালোচনা করি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি বিএনপির একদা প্রবল মিত্র হেফাজতকে নিদেনপক্ষে শান্ত রাখতে পারে তাহলে এটা তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয়। আওয়ামী লীগের ভোটযুদ্ধে অন্তত একটি ফ্রন্ট নিউট্রল থাকলো। তারা যদি এখনো বিএনপির সঙ্গে থাকত তাহলে কি তারা ‘গ্রহণযোগ্য’ হয়ে যেত? কারোর কাছে তারা ভালো হিসেবেই গণ্য হতো। আর এটাই হলো ব্যক্তির রাজনীতি। ব্যক্তিও নিরপেক্ষ নয়। সেও তার স্বার্থের জায়গা থেকে কথা বলে। আমি নিজেও তাই।

রাজনীতিকে, রাজনীতিবিদদের নষ্ট বলা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা নিজেদের কখনও প্রশ্ন করি না যে আমরা কোন ধরনের নেতৃত্ব এবং রাজনীতির যোগ্য। আমরা শুধু পারি যেকোনও সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে। গাধার পিঠে চড়লেও সমালোচনা, পিঠে না চড়লেও সমালোচনা।

আমি মনে করি বাংলাদেশে রাজনীতিবিদরাই সবচেয়ে বড় হিরো। তাই তো সবাই শেষ পর্যন্ত নেতা হতে চায়। এমপি বা মন্ত্রী হতে চায়। আমরা যতই সমালোচনা করি, মানুষের কাছে তারাই যান। তারাই মানুষের খবর রাখেন সবচেয়ে বেশি। রাজনীতি যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তা ঠিক করতে রাজনীতিই প্রয়োজন। গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্রই। এই দেশ কেন, সারা বিশ্বেই পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাজনীতিরই আছে। যুগে যুগে তা-ই হয়েছে। ভবিষ্যতেও তা-ই হবে।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ