X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

# মি টু এবং যৌন নিরাপত্তা

হারুন উর রশীদ
১৫ নভেম্বর ২০১৮, ১৩:১৪আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:০৩

হারুন উর রশীদ বাংলাদেশে # মি টু আন্দোলন শুরু হয়েছে। অনেকেই শুরুতে মনে করেছেন এটা চাপা পড়ে যাবে। বেশিদূর এগোবে না। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে একের পর এক নারী তাদের যৌন হয়রানির কথা প্রকাশ করছেন। আর এতে এটা স্পষ্ট যে ধীরে ধীরে ভয় ভাঙছে। নিজের জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে নারীরা সাহসী হচ্ছেন। আমাদের সমাজে যৌন হয়রানি বা যৌন সন্ত্রাসের যারা শিকার তারা অনেকেই আগে তা প্রকাশ করতে সাহস পেতেন না। কারণ, যে নারীরা এসব ঘটনার শিকার তাদেরই উল্টো ‘কলঙ্ক’ দেওয়া হয়। যে সমাজে ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ধর্ষণের শিকার নারীকে বলা হয় ‘খারাপ মেয়ে মানুষ’, সেই সমাজে নারীদের ভয় ভাঙতে তো সময় লাগবেই। কিন্তু ভয়টা যখন ভাঙতে শুরু করেছে তখন এটা অনেক দূর পর্যন্ত যাবে বলেই আমার মনে হয়। আর নারীরা এটা এখন বুঝতে শুরু করেছেন, লজ্জা তার নয়, লজ্জা নিপীড়কের।

কিন্তু আমরা এখনও ওই নারীদের পাশে দাঁড়াচ্ছি না। যারা ভয় ভেঙে কথা বলতে শুরু করেছেন তাদের ‘কলঙ্কিত’ করার নানা চেষ্টা বেশ স্পষ্ট। তাদের সমর্থনে যে একদম কেউ এগিয়ে আসছেন না তা নয়। তবে আমার মনে হয়েছে এগিয়ে আসাটা তেমন জোরালো নয়।

বাংলাদেশে আমার জানামতে এ পর্যন্ত # মি টু’র মাধ্যমে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের মধ্যে দুজন সাংবাদিক, একজন প্রকাশক, একজন আবৃত্তিকার, একজন শিল্পপতি, একজন উপস্থাপক, একজন প্রয়াত শিক্ষক রয়েছেন। আরও হয়তো থাকতে পারে, তবে তা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে।

এরই মধ্যে # মি টু’র এই অভিযোগগুলো নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে তার মধ্যে দুটি প্রশ্ন অন্যতম।

১. এতদিন পরে কেন অভিযোগ?

২. তারা কেন মামলা করছেন না?

সাধারণ চোখে এই প্রশ্ন দুটি নিরীহ মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয় না। আমার কাছে মনে হয়েছে অভিযোগগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলাই এর উদ্দেশ্য।

আমার কথা হলো, এই ধরনের অভিযোগ করার মতো সময় ও পরিস্থিতির প্রয়োজন হয়। অভিযোগ করার মতো সাহস ও মানসিক শক্তি অর্জন করতে হয়। বিষয়টি বোঝার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে হয়। আশপাশের মানুষের, আপনজনদের সমর্থন পেতে হয়। # মি টু বিষয়টা না এলে হয়তো এই অভিযোগগুলো তারা আর কখনোই তুলতে সাহস পেতেন না।

আর কোথায় অভিযোগ করতেন। থানায়? আদালতে? সে তো এক দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার আরেক হয়রানির ক্ষেত্র। বাংলাদেশে ১৫ ভাগের বেশি মামলায় আসামিদের শাস্তি হয় না। তারা খালাস পান। তাহলে কি আমরা বলবো যে ৮৫ ভাগ মামলা ভুয়া। ভুয়া মামলা আছে। তবে কি ৮৫ ভাগ?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম না হলে এই অভিযোগ নারীরা জানাতে পারতেন কিনা আমার সন্দেহ। বিচার পাওয়ার প্রশ্ন তো আরও পরে। এখন # মি টু আন্দোলন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ায় নারীরা সাহস পাচ্ছেন। পরিবার তাদের পাশে থাকছে। এটার একটা বৈশ্বিক চরিত্র আছে। বিশ্বব্যাপী এক ধরনের একাত্মবোধ তৈরি হচ্ছে। আর সে কারণেই বাংলাদেশেও নারীরা এগিয়ে আসছেন।

অভিযোগগুলো পড়ুন–

বাংলাদেশের যে নারীরা অভিযোগ করেছেন তাদের অভিযোগগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছি। মনোযোগ দিয়ে পড়লে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, সেখানে ঘটনা বর্ণনা করা আছে। আর কোন পরিস্থিতিতে ঘটনা ঘটেছে তারও বর্ণনা আছে। যে পুরুষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তারা কেউ তাদের অপরিচিত নন। গবেষণা বলছে, ৮০ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনা পরিচিতজনদের মাধ্যমেই ঘটে। একটু চিন্তা করলেই, ঘটনা ক্রম মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে অভিযোগ সত্য কিনা। কারণ, মিথ্যা বর্ণনায় ফাঁক থাকবেই।

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা কিন্তু পরিচয়ের কথা, পারিবারিক বা অফিসিয়াল সম্পর্কের কথা অস্বীকার করছেন না। শুধু যৌন হয়রানির অংশটুকু অস্বীকার করছেন। আমাদের দেশে যিনি অভিযোগ করেন প্রমাণের দায় তার। কিন্তু উল্টো ব্যবস্থাও আছে। আর তা হলো, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনিই প্রমাণ করবেন যে তিনি নির্দোষ। সেটা কীভাবে? তারা তো যৌন হয়রানি ছাড়া বাকিটুকু স্বীকারই করছেন। তাহলে ওই অংশে কী ঘটেছিল তার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য উপস্থাপন করতে পারেন। সত্য বুঝতে তাহলে খুব বেশি কষ্ট হবে না। ইনিয়ে বিনিয়ে অভিযোগ অস্বীকারের মধ্য দিয়ে কি দায় এড়ানো যায়?

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে তাদের কেউ কেউ আদালতে যাওয়ার কথাও বলছেন। আদালতে যেতেই পারেন। এটা যেকোনও মানুষের অধিকার। কিন্তু আদালতে যাওয়ার উদ্দেশ্য যদি হয় উল্টো হয়রানি করা, সত্য ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া, তাহলে সেটা নতুন আরেকটি সংকট তৈরি করতে পারে। আর আমার আবেদন থাকবে এক্ষেত্রে নারীদের সরকারের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা দেওয়া। কারণ, তা না হলে কোনও কোনও গোষ্ঠী ভয় দেখিয়ে # মি টু মুভমেন্ট বন্ধ করার অপচেষ্টায় নামতে পারে। এই আন্দোলনটি সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য খুব প্রয়োজনীয়।

আমি মনে করি এই আন্দোলনের মাধ্যমে শুধু অতীতের ঘটনা উঠে আসবে না, ভবিষ্যতে যৌন হয়রানির ঘটনা কমবে। নারী ও পুরুষ উভয় সচেতন হবেন। আগামী প্রজন্মের মধ্যে যৌন নিরাপত্তাবোধ জন্ম নেবে।

# মি টু আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য বিচার করে জেলে পাঠানো নয়। এর উদ্দেশ্য যৌন নিপীড়কদের মুখোশ খুলে দেওয়া। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তাদের আসল চেহারা প্রকাশ করা। আর সচেতন করা সবাইকে। কিন্তু এটা সহজ নয়। সততার সঙ্গে অভিযোগ করাই এর প্রধান শক্তি। এই শক্তি বজায় রাখতে হবে। আশার কথা, এখন পর্যন্ত # মি টু-তে বড় কোনও বিচ্যুতি পাওয়া যায়নি।

আর একজন নারী যিনি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে ট্রমার মধ্যে আছেন, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, তাকে তার কষ্টের কথা বলতে দিতে হবে। এর মাধ্যমে তিনি কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। হাল্কা বোধ করবেন। স্বাভাবিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হবেন। আইনের কথা বলে, সময়ের অজুহাত দিয়ে তার মুখ বন্ধ রাখলে ওই নারীর ক্ষতি আরও বাড়বে।

প্রশ্ন আছে, যদি মিথ্যা অভিযোগ হয়? হতে পারে। কিন্তু আমাকেই তা প্রমাণ করে দিতে হবে ওই নারীর অভিযোগ মিথ্যা। আমার যদি সৎ সাহস থাকে, আমি যদি সত্যিই ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত না হয়ে থাকি, তাহলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা কি খুব কঠিন হবে? সেই কাজটা এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই করা যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

রাষ্ট্র ও সমাজের দায়:

রাষ্ট্র যদি মনে করে এই আন্দোলনে নীরব দর্শক হয়ে থাকবে তাহলে ভুল করবে। রাষ্ট্রের উচিত হবে এই আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া। কারণ, এটা একটি সামাজিক আন্দোলন। যার প্রকৃতিটি হলো প্রধানত জিজিটাল। তাই রাষ্ট্রকে এখনই অভিযোগগুলো সংগ্রহ করতে হবে। এজন্য একটা সেল বা কমিশন গঠন করা যায়। এরপর অভিযোগের মাত্রা বুঝে দুইপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আইনি, প্রশমনমূলক অথবা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। এতে সুবিধা যেটা হবে তা হলো, কেউ যদি মিথ্যা অভিযোগ করেন তাও ধরা পড়ে যাবে। কে মামলা করলো আর কে করলো না সেই অপেক্ষায় বসে থাকলে হবে না।

স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান করে গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজে যৌন হয়রানির মাত্রাও বোঝা যাবে, যা রাষ্ট্রের পরবর্তী যৌন নিরাপত্তা নীতি প্রণয়নে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার, নারী অধিকার ও সামাজিক সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, একটি পক্ষ এরইমধ্যে এসব অভিযোগ নিয়ে ঠাট্টা তামাশা শুরু করেছে। অভিযোগগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে নানা উদ্দেশ্য খোঁজার চেষ্টা করছে। তারা যদি সফল হন তাহলে বাংলাদেশে নারীদের জন্য সামনে আরও কঠিন সময় এগিয়ে আসছে। তাই সবাইকে যৌন হয়রানির শিকার নারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের অভয় দিতে হবে। প্রয়োজনে আইনি সহায়তা দিতে হবে।

প্রতিষ্ঠানের দায়:

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ আছে সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠনের। অভিযোগ করার জন্য কমিটি গঠনের। সেটা কি আদৌ কোনও প্রতিষ্ঠান মানছে। না মানলে তারা আইন লঙ্ঘন করছেন। এটা দ্রুতই এখন করা উচিত। এটা করলে যৌন হয়রানি কমবে।

যাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত অভিযোগ উঠেছে তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সেসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থান পরিষ্কার করা প্রয়োজন। সেটা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই করতে হবে। ঘটনা যখন ঘটেছে তিনি তখন আমাদের প্রতিষ্ঠানে ছিলেন না, এটা বলে দায় এড়ানো যায় না। আপনার প্রতিষ্ঠানে যিনি এখন কাজ করছেন তার অতীতের নৈতিক স্খলনের কোনও অভিযোগ যদি ওঠে সেটা দেখা আপনার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। কারণ, অভিযোগ সঠিক হয়ে থাকলে সেই ধরনের কর্মীকে আপনি কীভাবে গ্রহণ করবেন সেই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। আর আপনার প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মীদের যৌন নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদমাধ্যমকেও দায়িত্ব নিতে হবে। ঘটনাগুলো এড়িয়ে গেলে চলবে না। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।

আমিও মনে করি এটা শুধু নারীর আন্দোলন নয়। আমাদের নারী পুরুষ সবার আন্দোলন। আমার কন্যা, আমার স্ত্রীর নিরাপত্তার আন্দোলন। আমার বোন, আমার নারী সহকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আন্দোলন। যৌন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আন্দোলন।

পাশে আছি # মি টু।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ