X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

তারেক রহমানের ভিডিও কনফারেন্স, আইন কী বলে?

হারুন উর রশীদ
১৮ নভেম্বর ২০১৮, ১৯:৪৯আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০১৮, ০০:৫৪

হারুন উর রশীদ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু হয়েছে রবিবার (১৮ নভেম্বর)। এতে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সে দেশের বাইরে থেকে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেন। এই খবর ও ছবি এরইমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে—তিনি এটা আইনগতভাবে পারেন কিনা। আর যারা আনুষ্ঠানিভাবে এই আয়োজন করেছেন, তারা আইনের লঙ্ঘন করছেন কিনা। কারণ তারেক রহমান তিনটি মামলায় শুধু দণ্ডপ্রাপ্তই নন, একজন পলাতক আসামিও।
বিএনপি নেতারাও সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের  কার্যালয়ে রবিবার তারেক রহমান মনোনয়ন বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন স্কাইপে। বিএনপি’র ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তার ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে। আর তাতে দেখা যায়, মনোনোয়ন বোর্ডের সদস্যদের সামনের টেবিলে একটি ল্যাপটপে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত আছেন তারেক রহমান। তার বিপরীতে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী তারেক রহমান স্কাইপে তাদের প্রধানত তিনটি প্রশ্ন করেন।

১.কেন দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে?

২. আন্দোলন সংগ্রামে তার অবদান কী?

৩. মনোনয়ন দিলে জয়লাভ করার সম্ভাবনা কতটুকু?

দু’টি মামলায় কারাদণ্ড নিয়ে বিএনপি’র চেয়ারপারসন খলেদা জিয়া এখন কারাগারে। তাই তারেক রহমান এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন। তিনিও তিনটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। কিন্তু তিনি কারাগারে নন, পলাতক। যদিও সবাই জানেন তিনি লন্ডনে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি। আসার চেষ্টাও করেননি। কোনও মামলা চলার সময় তিনি আদালতে হাজির হননি। আদালতে থেকে বিচার চলার সময় তাকে হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ ও সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ হয়। রায়ের পর কোনও মামলায়ই তিনি আপিল করেনি। আর আইনে আত্মসমর্পণ না করে আপিলের কোনও সুযোগও নেই।

বিএনপি দণ্ডপ্রাপ্তদের দলের নেতৃত্বে রাখার জন্য তাদের গঠনতন্ত্রও সংশোধন করেছে। কিন্তু সেই গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে এরইমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। যদিও বিএনপি’র আপিলের সুযোগ আছে।

তারেক রহমান সর্বশেষ একুশে অগাস্ট গ্রেনেড মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এটি একটি হত্যা মামলা। আদালত তাকে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন। রাষ্ট্রীয় হত্যা ষড়যন্ত্রের একটি জঘন্য দৃষ্টান্ত একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা। বিএনপি এই মামলাটি জজ মিয়া নাটকের মাধ্যমে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলার তদন্ত নতুন মোড় নেয়। প্রকাশিত হয় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের কথা।

তারেক রহমান অর্থপাচারের আরেকটি মামলায় ২০১৬ সালে সাত বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। আর এই মামলাটি দায়ের হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তিনি ১০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। তিন মামলায়ই তারেক রহমানের সহযোগীরা কারাগারে আছেন। আর একুশে অগাস্টের মামলা তার সহযোগীদের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে।

তারেক রহমানের কোনও উসকানিমূলক  বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আছে হাইকোর্টের । তবে এই আদেশ ছিল তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে। তখন তার বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন ছিল, তিনি তখনও পলাতক ছিলেন। তাই সেই আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। কিন্তু ২০১৬ সালে তিনি অর্থপাচার মামলায় দণ্ডিত হন। আর এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডিত হন। এরপরে তিনি গ্রেনেড মামলায় দণ্ডিত হন।

এখন প্রশ্ন হলো—দণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ও তার বক্তব্য প্রচারের বিধি কী? কারাগারে আটক দণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে আইন মেনে দেখা করা যায়। তিনি তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শও করতে পারেন। দণ্ডিত ব্যক্তি জামিনে থাকলেও আইনে তার সঙ্গে যোগাযোগ বা তার কথা বলার অধিকার থাকে। কিন্তু দণ্ডিত এবং একইসঙ্গে পলাতক ব্যক্তির ব্যাপারে কী হবে? কারণ, পলাতক ব্যক্তি যে আইনকে উপেক্ষা করছেন, তা স্পষ্ট। তিনি এই অবস্থায় রাজনীতিতে কীভাবে অংশ নিতে পারেন?

বিএনপির ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানানো হয়েছে। আওয়ামী সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি তারেক রহমান কীভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তার আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) অনুরোধ জানানো হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।’
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেছে তাতে এখানে আইনগত এবং নৈতিক দু’টি প্রশ্ন আছে।
আইনগভাবে তারেক রহমান যদি পলাতক অবস্থায় ভিডিও কনফারেন্সে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিতে পারেন, তাহলে খালেদা জিয়ারও কারাগারে বসে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিতে পারা উচিত। কিন্তু খালেদা জিয়া সেটা আইনগতভাবে পারছেন না। খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে কারাগারে আছেন। কিন্তু তারেক রহমান আইনকে উপেক্ষা করে পলাতক আছেন। তাহলে  খালেদা জিয়ার সুযোগ না থাকলে তারেক রহমানের থাকে কীভাবে?
তারেক রহমান একজন পলাতক দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হিসেবেই তার দলের সঙ্গে যেকোনও কৌশলে যোগাযোগ রাখতে চাইতেই পারেন। আইন এড়িয়ে তিনি সে চেষ্টা করতে পারেন তার প্রয়োজনে।  সেটা আইনগতভাবে কীভাবে দেখা হবে, তাও আইনি বিষয়। কিন্তু যারা একজন দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে প্রকাশ্যে কথা বলার সুযোগ করে দেন, অথবা স্কাইপে মনোনয়ন বোর্ডের হাজির হওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন, তারা কি আইন লঙ্ঘন করছেন? তারা কি কোনোভাবে তাকে বেআইনি সহযোগিতা করছেন? একজন পলাতক অপরাধীকে সহায়তা করা যদি আইনে অপরাধ হয়, তাহলে এই ক্ষেত্রে কী হবে?

আইনে যা আছে:

বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ১০৭ থেকে ১২০ পর্যন্ত ধারায় অপরাধে সহায়তাকারীর অপরাধ ও শাস্তির বিধান দেওয়া আছে। অপরাধ ও আর অপরাধীকে সহায়তা একই বিষয়।  আইন অমান্য করা বা দণ্ড এড়িয়ে পলাতক থাকাও একটা অপরাধ। তাই সাধারণ বিবেচনায় এটা স্পষ্ট যে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে দণ্ড এড়িয়ে তার কার্যক্রম পরিচানায় সহায়তা করাও অপরাধ।

আর ২১২ ধারায় অপরাধীকে আশ্রয় দেওয়া অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তবে অপরাধীর স্বামী বা স্ত্রী আশ্রয় দেওয়ার এই অপরাধে অপরাধী হবেন না।

তারেক রহমান তো দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এবং পলাতক। তাই বিএনপি’র মনোনয়ন বোর্ডে  স্কাইপের মাধ্যমে তাকে প্রার্থীদের প্রশ্ন করতে সহায়তা করেছেন যারা,  তারা স্পষ্টই একজন দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে তার রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে সহায়তা করেছেন। এখন আইন এটাকে কীভাবে দেখবে?

অন্যদিকে ২১২ ধারায়  ‘আশ্রয়’ বলতে কী বোঝাবে, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে ঘরে আশ্রয় দেওয়া যায়, টাকা-পয়সা দিয়ে সহায়তা করে অশ্রয় দেওয়া যায়, রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় দেওয়া যায়, ডিজিটাল উপায়েও আশ্রয় দেওয়া যায়। স্কাইপে তারেক রহমানকে এই আশ্রয় দেওয়া এখন আইন কীভাবে দেখবে?

তবে দণ্ডবিধির ৫২(ক) ধারায় আবার ‘আশ্রয়ে’র সংজ্ঞা দেওয়া আছে। সেখানে বলা আছে  আশ্রয় বলতে কোনও ব্যক্তিকে আশ্রয়, খাদ্য, পানীয়, পোশাক, অর্থ, অস্ত্রপাতি, গোলাবারুদ বা পরিবহনের মাধ্যমে সহায়তা বা গ্রেফতার এড়ানোর লক্ষ্যে কোনও ব্যক্তিকে যেকোনও মাধ্যমে সহায়তা করা বোঝায়। কোনও মাধ্যম সম্পর্কে এই আইনে বলা হোক বা না হোক,  সব মাধ্যমই সহায়তা হিসেবে গণ্য হবে।

এখানে বিষয়টি আরও স্পষ্ট। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তারেক রহমান দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। আর তাকে স্কাইপে বিএনপি’র মনোনয়ন প্রার্থীদের যারা আনুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, তারা তাকে গ্রেফতার এড়িয়ে তার রাজনৈতিক কাজ চালাতে সহায়তা করেছেন বলেই আইনে প্রতীয়মান হয়। মাধ্যম যাই হোক না কেন।

নৈতিক প্রশ্ন:

এই বছরেরর ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপি তার গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনে। সেখানে দণ্ডিত ব্যক্তিরও দলের নেতৃত্বে থাকার বিধান করা হয়। কিন্তু এর আগে দণ্ডিত ব্যক্তিরা বিএনপি’র নেতৃত্বের যোগ্য ছিলেন না। নৈতিক প্রশ্ন এখানেই। একজন ব্যক্তি যিনি আইনের মুখোমুখি  হতে ভয় পান অথবা আইন মানেন না। তাকে কেন নানা কৌশলে আশ্রয় দিতে হবে? নেতৃত্বে রাখতে হবে? সেটা বিএনপিই ভালো বলতে পারবে। তবে  বিএনপি’র মনোনয়ন প্রার্থীরা স্কাইপে সাহস করে যদি তারেক রহমানকে তার নৈতিক অস্থান নিয়ে প্রশ্ন করতে পারতেন. তাহলে আমরা হয়তো স্পষ্ট হতে পারতাম।

বিএনপি’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কয়েকদিন আগে বলেছেন,‘বিএনপি পীরমুক্ত হয়েছে। তারেক রহমানের নামে হুক্কাহুয়া ডাক দেওয়া হতো। এখন সেই অবস্থার অবসান ঘটেছে।’ আমার প্রশ্ন এখন জাফরুল্লাহ চৌধুরী কী বলবেন? হুক্কহুয়া কি শেষ হয়েছে?

বিএনপি তারেক রহমানের এই দণ্ডকে মিথ্যা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলতেই পারে। সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু তারা কী আইন আদালতকে অস্বীকার করছেন? যদি না-ই করেন, তাহলে তাদের নৈতিক অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? দণ্ডপ্রাপ্তকে নেতৃত্বে রাখতে গঠনতন্ত্রই বদলে ফেলবেন? আইন অনুসরণ করবে না?

লেখক সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ