X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাতীয় নির্বাচনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ

ফারজানা মাহমুদ
২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৭:৫৯আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ২২:০৪

ফারজানা মাহমুদ যেকোনও গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন একটি অন্যতম প্রক্রিয়া। কারণ, এর মাধ্যমে সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। একইসঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের পথ সৃষ্টি হয়। সরকার গঠনের বৈধতা দেয় সুষ্ঠু নির্বাচন। দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে। কিন্তু নির্বাচনি সহিংসতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে লুণ্ঠিতও করে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনগুলো সহিংসতামুক্ত নয়, সাম্প্রদায়িক উসকানি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন ব্যক্তি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়ের চরম ক্ষতিসাধন করে।
নির্বাচনে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা রাজনীতির বলির পাঁঠায় পরিণত হয়, উগ্রবাদী দলগুলোর আক্রমণ ও আক্রোশের শিকার হয়। কারণ, মূলত তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার শক্তিকে সমর্থন দেয়, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুসরণ করে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। অনেক নির্বাচনি এলাকায় সংসদ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় দশ ভাগ হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এই ১০ ভাগ জনসংখ্যা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনাকে লালন করে এমন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে–এই শঙ্কা থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তাদের সহযোগী জামায়াত সংখ্যালঘুদের চিরশত্রু হিসেবে গণ্য করে। তাই স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনের সময় এই চরমপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের বাড়িঘর, মন্দির ভাঙচুর করে।
ঐতিহ্যগতভাবে দেশের হিন্দু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় নির্বাচনের আগে হিন্দুরা ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি ও আক্রমণের শিকার হয়ে থাকে। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নারকীয় জঙ্গি হামলা চালানো হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত হানার আগে বিএনপি ও এর সমর্থকেরা বড় আকারের সহিংসহতা চালায়, যা প্রায় ১৫০ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সেই সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। হিন্দু সম্প্রাদায়ের ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও লুট করা হয়। মন্দির পুড়িয়ে ফেলা হয়, নির্যাতন করা হয় ও মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়। ওই সময়ে নির্বাচনি সহিংসতার সবচেয়ে করুণ পরিণতি ভোগ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী ও কন্যাশিশুরা। কয়েক হাজার সংখ্যালঘু নারীকে নির্যাতন করা হয়, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের সামনে ধর্ষণও করা হয়। রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়।

বরিশাল জেলায় জামায়াত-বিএনপির হামলার শিকার হয়ে  কয়েক হাজার সংখ্যালঘু গোপালগঞ্জ জেলায় আশ্রয় নেয়। আবার অনেকে আক্রমণের ভয়ে ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। ২০০১ সালের ২রা অক্টোবর বাংলাদেশ  অবজার্ভার তাদের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করে যে, ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল সবচেয়ে সহিংসতাপূর্ণ। যেখানে নির্বাচনের বহু আগে থেকেই সংখ্যালঘুদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট না দেওয়ার জন্য হুমকি ও ভয় দেখায় বিএনপি-জামায়াত। নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা ছিল রীতিমতো ভীতিকর। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুরের কিছু অংশ, খুলনা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, কুমিল্লা ও নরসিংদীতে সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালানো হয়। বিএনপি-জামায়াতকর্মীরা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আক্রমণ চালিয়ে তাদের সম্পদ কেড়ে নেয়। এসব জেলায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগুন দেওয়া হয় এবং দুই শতাধিক সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণ করা হয়। সেন্টার ফর রিসার্চ ও ইনফরমেশনের ২০০৩ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ সালের নির্বাচনে এ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রধান হোতা বিএনপি ও এর মিত্রশক্তি জামায়াতের নেতা-কর্মী এবং তাদের নির্যাতনের কারণে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে কয়েক হাজার হিন্দু ভারতে পালিয়ে যায় তাদের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার স্বার্থে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চরমপন্থী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত জামায়াত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের বৈধতা হারায়। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন যে, জামায়াতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থী। যার ফলে জামায়াত ও এর দোসর বিএনপি জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে। ওই সময় দেশব্যাপী সহিংসতা চালিয়ে অরাজকতার মাধ্যমে নির্বাচনকে বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে নির্যাতন করা হয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়। যথারীতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সংখ্যালঘু নারীদের ওপর   বর্বর নির্যাতন চালায়।

দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমা অঞ্চলের জেলাগুলোতে নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা চালানো হয় ব্যাপকভাবে।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন, অনুযায়ী যশোর সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁ, পঞ্চগড়, চট্টগ্রাম, নিলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও দিনাজপুরে প্রায় ৫ হাজার পরিবার আক্রমণের শিকার হয়। যথারীতি তাদের বাড়িঘর, মন্দির ও নারীদের ওপর চালানো হয় আক্রমণ। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন পরবর্তী এই সব সহিংসতার মূলহোতা বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। আর এই সহিংসতার সর্বোচ্চ শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।

তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘুদের আক্রমণকে নিন্দা জানিয়ে  তাদের  পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন।

সামনে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচন যেন সংখ্যালঘুদের জন্য একটি আতঙ্কের নাম। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আবারও উৎকণ্ঠায় দিন যাপন করছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অতীতের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আবার নির্যাতন হবে—এই আশঙ্কায় তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই অবস্থায় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার যদি অগ্রিম প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে জাতি হয়তো ২০০১ ও ২০১৪-এর চেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা দেখবে। যার প্রধান শিকার হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশেষভাবে নিরাপত্তা দেওয়া, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, সতকর্তা অবলম্বন, নজরদারি—ইত্যাদি পদক্ষেপগুলো দ্রুতত নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষত বিএনপিকে সাম্প্রদায়িকতা বর্জন এবং জনসম্মুখে রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত সব ধরনের সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে দৃঢ় বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে জাতীয় সামনে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া অবশ্যই জরুরি।

বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিত, তারা ধর্মকে রাজনৈতিক লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে না এবং তাদের নেতাকর্মীরা সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত হলে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করবে। গত মাসে নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামির গঠনতন্ত্র অগণতান্ত্রিক বিধায় তা বাতিল করেছে। যার ফলে জামায়াত নির্বাচনে আর অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের অসংখ্য নেতাকর্মী বিএনপির সঙ্গে যোগ দেওয়ায় সংখ্যালঘুরা শঙ্কা করে যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এই জামায়াত-বিএনপি ঐক্য আরও বড় ধরনের সহিংসতা তাদের ওপর বয়ে আনবে।

এ অবস্থায় একটি নিরাপদ গণতান্ত্রিক নির্বাচন পরিচালনা ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। জামায়াত-বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও অগ্রগতির পথে মূল হুমকি। তাই সরকারকে ধর্মের অপব্যহার ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার রোধে সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বাস্তবায়ন করতে হবে। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ, যা নাগরিকদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে কিংবা নাগরিকদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করার জন্য গঠিত সংগঠন বা আমাদের সংবিধানের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতে কাজ করে এমন দল/সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে–এই অনুচ্ছেদ বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি (১৮৬০) ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদানে যথেষ্ট নয়। তাই ধর্মের নামে উসকানি ও সাম্প্রদায়িক, অস্থিতিশীলতা বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে।

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখতে ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সব নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সরকারকে বলিষ্ঠ হাতে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী দলগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। সংখ্যালঘুরা এদেশের নাগরিক এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব। তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই নির্বাচনকালীন সংবেদনশীল সময়ে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন, সেটাই আমাদের কাম্য।

লেখক: আইনজীবী

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
কোল্ড চেইনের উন্নয়নে সমন্বিত নীতির বাস্তবায়ন চান উদ্যোক্তারা
কোল্ড চেইনের উন্নয়নে সমন্বিত নীতির বাস্তবায়ন চান উদ্যোক্তারা
নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক নিহত, যা জানা গেলো
নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক নিহত, যা জানা গেলো
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৩ সদস্য আটক
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৩ সদস্য আটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ