X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কেন ধর্মকে ঘিরেই সন্ত্রাসবাদ?

রাশেদা রওনক খান
২৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৬:৩৯আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৬:৪১

রাশেদা রওনক খান আমি এক ধর্মে বিশ্বাসী,আপনি আরেক ধর্মে। আমি এক শ্রেণির, আপনি আরেক শ্রেণির। আপনি হয়তো পুরুষ, আমি নারী। আপনি অসম্ভব ধনী, আমি চরম গরিব। আপনি অনেক উদার,আমি অনেক কিপটে। আপনি মুক্ত চিন্তার, আমি হয়তো কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আপনি অনেক জ্ঞানী মানুষ,আমি মূর্খ, অর্বাচীন বলতে পারেন।
আপনি সাদা, আমি কালো। আপনি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান, আমি হয়তো আমার শহরটাই তেমন ঘুরে দেখিনি কোনোদিন। আপনি বড় অফিসার, আমি হয়তো আপনার অফিসের দারোয়ান, নয়তো বাসার ড্রাইভার কিংবা কাজ করে খাই। আপনি যখন দুধ-কনফ্লেক্স কিংবা বাটার মাখানো ব্রেড টোস্ট খান সকালের নাশতায়, আমার তখন সকাল হয় একমুঠো ভাতে শুকনো মরিচ মেখে।
ধনীর সন্তানরা যখন দামি গাড়িতে চড়ে ইংলিশ মিডিয়ামের এসি রুমে বসে পড়ালেখা করে, গরিবের সন্তানরা হয়তো বাবার কাজে সাহায্য করে, বড়জোর কেউ কেউ হেঁটে ক্লান্ত শরীরে স্কুলে যায়। ধনীর সন্তান যখন দেশের দামি দামি এমনকি বিদেশের দামি শপিংমলে ঘুরে ঈদের জুতা-জামা কেনে, গরিবের সন্তান হয়তো ঈদের দিন আপনার বাসায় যায় এক টুকরো মাংসের খোঁজে! কখনও পায়, কখনও ধনীর দারোয়ান তাড়িয়ে দেয় লাঠির গুঁতোয়।  ধনীরা যখন সুন্দরের খোঁজে পার্লারে গিয়ে হাজার টাকা খরচ করে ফেসিয়াল করেন, গরিবেরা হয়তো রোদে দাঁড়িয়ে  চামড়া পুড়িয়ে পার্লারের সামনে বসে থাকে একটা টাকা ভিক্ষা পাওয়ার আশায়। এইমাত্র ওপরে পার্লার রুমে হাজার টাকা দিতে পারলেও গরিবের বাটিতে এক টাকা ফেলতে ধনীর অনেকের কৃপণতা দেখে করুণা হয়, তবুও মেনে নিই।

রেস্টুরেন্টে গিয়ে হাজার টাকা খরচ করে ধনীরা নিজের সন্তানকে খাওয়াচ্ছেন, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গরিবের বাচ্চাকে বলে দিচ্ছে, ‘কাজ করতে পারিস না?’

প্রবাসে কিংবা দেশে ধনীরা যখন কে কত ধনী এই লোক দেখানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, গরিবেরা তখন অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে, ক্ষুধার সঙ্গে তীব্র সে লড়াই। ধনীরা বুঝবেন না সেই লড়াই কত কষ্টের, কতটা আত্মগ্লানির। তবুও গরিবেরা ধনীর বিরুদ্ধে লড়াই করি না, বেঁচে থাকার যে লড়াইটা লড়ি, তা কেবলই নিজের সঙ্গে নিজের নিজের পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে।

নারীদের পুরুষ নামি অনেক অমানুষই অত্যাচার করছে প্রতিনিয়ত। আবার পুরুষদের অনেককেই নারীরা কেউ কেউ সামাজিক/মানসিক অত্যাচার করছেন অনেক সময়। নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও। শিশুরা নিপীড়িত হচ্ছে পুরুষ নামের কিছু জানোয়ারের দ্বারা। ঘরের বউ নির্যাতিত হচ্ছে বদমেজাজি স্বামীর দ্বারা, আবার বদমেজাজি বা চতুর স্ত্রী দ্বারা স্বামী নির্যাতিত হচ্ছে। যৌতুকের জন্য নারীরা গ্রাম শহর নির্বিশেষে প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হচ্ছে আবার কাবিনের টাকা নিয়ে আজকাল চলে নানাভাবে পুরুষ নির্যাতন। মেয়েশিশু হতে শুরু করে বয়স্ক নারী বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কারণে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা নিপীড়িত, নির্যাতিত হচ্ছে। এই নির্যাতন, অত্যাচারের মাঝেও নারী বেঁচে থাকার লড়াই করে,এই লড়াইটাও একান্তই নারীর একার লড়াই। পুরুষের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, কেউ কেউ (খুব কম সংখ্যায়) হয়তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলে, ব্যস এইটুকুই।

শ্রেণি নিয়ে নয়, লিঙ্গ নিয়ে নয়,তবে কেন ধর্মকে ঘিরে এত বড় হাঙ্গামা প্রতি দেশে প্রতি মুহূর্তে? শ্রেণি বৈষম্য, বর্ণ বৈষম্য  মানুষকে পীড়ন দেয়, কিন্তু এমন বিদ্বেষ তৈরি করে না যে, পুরো সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দেওয়ার চক্রান্ত করে। কিন্তু ধর্মের অপব্যাখ্যা এতটাই বিদ্বেষী করে তোলে যে,কিছু মানুষ কেবল বিভ্রান্তই হয় না, বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। কেন ধর্মকে নিয়েই এত নিরপরাধ মানুষ মেরে ফেলার পরিকল্পনা চলে? একজন ধনীর বিরুদ্ধে আক্রোশ থাকতে পারে দরিদ্রের, কিংবা নারী সমাজের  বিরুদ্ধে পুরুষের কিংবা পুরুষদের বিরুদ্ধে নারীদের, কিন্তু উত্তরাধুনিক এই যুগে কী করে ধর্মকে ঘিরে চলে এসব বর্বরতা? এতটা মেধাশূন্য মানুষ কীভাবে এই সময়ে এসে জন্ম নেয়? ধর্ম তো যার যার, সেখানে কেন অপরের হস্তক্ষেপ? তাহলে এর পেছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। এই উদ্দেশ্য যতটা অমানবিক, ততটাই ব্যবসায়িক!

নয়তো, কী অপরাধ ছিল  ৯/১১-এর টুইন টাওয়ারের অধিবাসীদের? কী অপরাধ ছিল নিউজিল্যান্ডের মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া মানুষদের? কী অপরাধ ছিল শ্রীলঙ্কার গির্জায় ও হোটেলে থাকা মানুষগুলোর? কী অপরাধ ছিল আমাদের ছোট্ট জায়ানের? ও-তো মুসলিম, তাহলে মুসলমান  দাবি করে কেন জায়ানকে মেরে ফেলল? তাহলে আসলে কার বিরুদ্ধে কার লড়াই চলছে এই জঙ্গিদের? এই ক’দিন ধরে জায়ানের মায়ের চেহারাটা কল্পনা করার চেষ্টা করছি, ভাবছি এই মা কীভাবে বাঁচবে এমন ফুটফুটে বাচ্চাটার এমন মৃত্যুর পর? কী দোষ ছিল ওর? কিংবা ওর মতো আরও ৪৫টি শিশুর? ধর্মই যদি তাদের মূল উদ্দেশ্য হতো, তাহলে এতগুলো মায়ের আরশ কাঁপিয়ে তারা কোন বেহেশতে যাবে? এই অবুঝ বাচ্চাগুলোর কী দোষ ছিল?  শিশুদের তো এখনও ধর্ম সম্পর্কে কোনও বোঝাপড়াই হয়নি, অথচ তাদের ধর্মের জন্য প্রাণ দিতে হলো?

অসম্ভব! কোনোভাবেই তা ধর্মের জন্য হতে পারে না। ব্যবসায়িক চিন্তাগুলো কতটা অমানবিক আর পৈশাচিক হলে এভাবে দেশে দেশে লাখো মানুষের মৃত্যু মিছিল দেখতে ইচ্ছে হয়? কেউ যদি তার সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে, তাকে তো সৃষ্টিকর্তা সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত করেন না। তাহলে আমি বা আপনি কে অন্যকে বঞ্চিত করার? আর ওই শিশু জায়ান বা তার মতো আরো ৪৫টি শিশুর ধর্ম সম্পর্কে কি বোঝাপড়া ছিল যে তাদের মেরে ফেলা হলো? কোথায় তখন ধর্ম? কোথায় তাদের মানবতা?

যারা এখনও এই পথে হাঁটছে বা হাঁটার চেষ্টা করছে, তাদের প্রতি একটাই অনুরোধ নিজের ধর্মকে এতটা ছোট করবেন না যেন, প্রবাসে আপনার দেশের, আপনার ধর্মের, আপনার সমাজের মানুষজন প্রতিমুহূর্তে লজ্জিত হয়, অপমানিত হয়, অন্য জাতির কাছে ছোট হয়। যার যার ধর্ম তার তার, মানুষ মেরে কেউ কারও ধর্ম  বড় করতে পারে না। যারাই ধর্ম নিয়ে এসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কথা বলে, তাদের থেকে তরুণদের দূরে সরাতে হবে আমাদের, পিতামাতা, ভাইবোন-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের। ধর্ম যেমন সকলের, দায়িত্বটাও সকলেরই। যারা ধর্ম প্রচার করছেন, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওয়াজ মাহফিল করছেন তাদেরও রয়েছে অনেক বড় দায়িত্ব। গ্রামেগঞ্জে এমনকি শহরেও অনেকেই ওয়াজ মাহফিলের নামে আজেবাজে কথা ছড়াচ্ছেন ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। একদিকে সরকার যেমন কঠোর হাতে জঙ্গি দমন করছেন, একইসঙ্গে উসকে দেওয়ার মতো ওয়াজ মাহফিলকে নিয়ন্ত্রণে আনাটাও খুব জরুরি। কিশোর-তরুণ-তরুণীদের মনোজগৎ খুবই নাজুক থাকে, তাদের এই ধরনের ধর্ম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা শোনানোর মধ্য দিয়ে অন্য ধর্ম সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রক্রিয়া হতে বিরত রাখতে হবে। ওয়াজ মাহফিল হবে মানবিকতার সফল উদাহরণ দিয়ে, নবী-রসুলের বাণী ও সৎ উপদেশ দিয়ে, কোরআনের সহি ব্যাখ্যা প্রদানের মধ্য দিয়ে, দেশের উন্নয়ন নিয়ে, মানবতার উন্নয়ন নিয়ে,সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা বলে, পুরো মানব জাতির প্রতি ভালোবাসা প্রদানের কথা বলে। সেখানে ধর্মের বিষবাষ্প যারা ছড়ায়, তাদের অবশ্যই কঠোর হাতে দমন এখনই করতে হবে।

মনোজগৎ এমনই এক বিষয়, একবার কোনও একটি ভাবনাচিন্তা  গ্রথিত হলে তা বের করে ফেলা অনেক কঠিন। আর তা যদি হয় ধর্মীয় বিদ্বেষ, তাহলে তা হয়ে উঠে/উঠবে ভয়ানকরূপে! এসব তরুণ কেবলই ব্যবহৃত হচ্ছে, যাদের যা স্বার্থ হাসিল করার তা তারা করে নিচ্ছে, মাঝদিয়ে কিছু গর্দভ জাতীয় প্রাণী অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজ ধর্মকে মাটির সাথে মিলিয়ে দিচ্ছে, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা  নিজ দেশের মানুষকে সেসব দেশের মানুষের কাছে নত করছে, সারা পৃথিবীতে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করছে। কয়েক দিনের দুনিয়ায় এসেছি আমরা, এই এক জীবনে ভালোবাসাই তো হওয়া উচিত একমাত্র অবলম্বন। কোনও ঘৃণা নয়,বিদ্বেষ নয়,মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, মমত্ববোধ- সেটাই হোক একমাত্র আমাদের চাওয়া ও পাওয়া।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ