X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরে আসুক বই উপহারের দিন

শান্তনু চৌধুরী
২০ মে ২০১৯, ১৩:৪১আপডেট : ২০ মে ২০১৯, ১৩:৪৩

শান্তনু চৌধুরী স্কুল জীবনে খেলাধুলায় খুব একটা ভালো ছিলাম না। তাই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কোনও পুরস্কার পেতাম না। তবে বইপড়া, গান, কবিতা আবৃত্তি দিয়ে সেটা পুষিয়ে দিতাম। সে কারণে পুরস্কার হিসেবে নানা ধরনের বই, খাতা-কলম, জ্যামিতি বক্স পেতাম। বলা উচিত, সেই সময়ে পাওয়া বইগুলো ছিল বেশ নিম্নমানের অথবা বেশ উচ্চমানের (যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ বা নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি এর ‘ইস্পাত’)। যেগুলো সেই বয়সে আসলে পড়লে সাধারণভাবে বোঝার সম্ভাবনা কম থাকে। এরপরও বইগুলো নিয়ে যেতাম। যে মানেরই হোক না কেন বুঝে বা না বুঝে পড়তাম এবং এতদিন পর এসে ভাবি, সেই পাঠপরিক্রমাই আজকের পাঠাভ্যাস গড়ে দিয়েছে। কিন্তু সময় বদলে যেতে থাকে, পুরস্কার দেওয়ার সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে বিদ্যালয়গুলো। এখন তার জায়গা দখল করে নিয়েছে ঘটিবাটি, মেলামাইন সামগ্রীসহ নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। এটা নিয়ে যে ক্ষোভ ছিল না তা নয়, কিন্তু শিক্ষকরাই পুরস্কার নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজেদের দীনতার পরিচয় দিয়ে আসছিলেন।
প্রথমত তারা মনে করতেন এসব সামগ্রী হয়তো বাড়ির কাজে লাগে বলে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও খুশি হবেন আবার নিম্নমানের সামগ্রীও গছিয়ে দেওয়া যাবে। কারণ এখানেও টাকা কিছুটা নয়ছয় করার বিষয় থাকে। কিন্তু সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) জারি করা এক নির্দেশনা আমাদের আশাবাদী করেছে। মনে হচ্ছে ফিরে আসছে সেই বই উপহারের দিন, পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়ার সেই দিন। সম্প্রতি মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো. আবদুল মান্নান স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনা পাঠানো হয় সব উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকদের কাছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিক্ষার্থীদের পুরস্কার হিসেবে ক্রোকারিজ সামগ্রী না দিয়ে বই অথবা শিক্ষা সহায়ক উপকরণ দিতে। ‘প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই অথবা শিক্ষা উপকরণ প্রদান’ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘লক্ষ করা যাচ্ছে যে, বিদ্যালয়গুলোর সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে ক্রোকারিজ সামগ্রী দেওয়া হয়। এ ধরনের পুরস্কার শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো কার্যক্রমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে সকল অনুষ্ঠানে প্রতিযোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে বয়স উপযোগী মানসম্মত বই অথবা শিক্ষা সহায়ক উপকরণ দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হল।’ এই নির্দেশনা পত্রে ‘বয়স উপযোগী’ ও ‘মানসম্মত’ কথা দুটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সব ব্যবস্থার মধ্যে যেমন ঘুণে ধরার বিষয়টি রয়েছে তেমনি শিক্ষক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য।

দেখা যায়, অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক অথবা ম্যানেজিং কমিটির প্রভাবশালী কোনও সদস্য বই লিখেছেন একখানা, সেটিই পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। বইটি আদৌ পড়ার উপযোগী কিনা বা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপযোগী কিনা সেটি দেখা হচ্ছে না। এছাড়া ‘গাইড বই’ বিক্রির ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষকদের নির্দিষ্ট প্রকাশনা বা লাইব্রেরির সঙ্গে যোগসাজশ থাকে তেমনি এক্ষেত্রে থাকাটাও বিচিত্র নয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, হয়তো বিখ্যাত কোনও ক্লাসিক বই দেওয়া হলো কিন্তু সেটি ওই বয়সের শিক্ষার্থীর জন্য মোটেই উপযোগী নয়, সেটিও কোনও কাজে এলো না। এক্ষেত্রে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনও অর্বাচীন লেখকের বই যেন পুরস্কারের তালিকায় ঠাঁই না পায় যা জ্ঞানদানের পরিবর্তে জ্ঞানকে সংকুচিত করে ফেলে বা কূপমণ্ডূকতার দিকে ঠেলে দেয়। এই যেমন, শিশুদের কথা যদি বলি, ১০ মাস বয়সেই শিশুর হাতে ছবির বই দিতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে বয়স অনুযায়ী অন্যান্য রূপকথা বা পশুপাখি বা শিশুর উপযোগী যে কোনও বই দিতে হবে। দুই দশক আগেও বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে নানা জায়গায় বই উপহারের একটা প্রচলন ছিল। কিন্তু এখন কেউ বই উপহার দিলে এসব অনুষ্ঠানে তার দিকে সরু চোখে চেয়ে থাকেন অন্যরা। শাড়ি, গয়না, ক্রোকারিজসামগ্রী না দিলে যেন প্রেস্টিজই থাকে না। তবে আশার কথা এখনও অনেকে উপহার হিসেবে বই দিয়ে থাকেন। আমরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলছি। পরীক্ষা নিচ্ছি। কিন্তু শিক্ষক থেকে শুরু করে এই সংশ্লিষ্ট সবাইকে আগে সৃজনশীল হতে হবে। তাদের বোধকে জাগ্রত করতে হবে। আর সেটি সম্ভব ক্লাসের বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার মাধ্যমে। যেটিকে আমরা প্রচলিত কথায় ‘আউট বই’ বা ‘গল্পের বই’ বলে থাকি। আগে দেখা যেতো শিক্ষককেও কোনও উপহারসামগ্রী দেওয়ার ক্ষেত্রে বা বিদায়কালে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে বই রাখা হতো। নিদেনপক্ষে কোনও ধর্মীয় বই। কিন্তু এখন সেটি উঠেই গেছে।

এই যে পুরস্কার হিসেবে বা উপহার হিসেবে কেন বইয়ের প্রতি আমাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে তার কারণ সময় দখল করে নিয়েছে ফেসবুক। সে কারণে মানুষের মনন গড়তে গিয়ে যে বই প্রয়োজন সেটি যদি না পায় তবে জিপিএ-ফাইভের সংখ্যাই হয়তো বাড়বে। দশ মণ ওজনের ব্যাগ বহন করে স্কুলে গিয়ে কাঁধই হয়তো ব্যথা হবে। কিন্তু আখেরে তোতাপাখি হওয়া ছাড়া কিছুই হবে না। আগে এলাকায় এলাকায় লাইব্রেরি ছিল, এখন সেগুলো নেই বললেই চলে। পাঠাভ্যাস গড়ে উঠছে না। আমরা বইমেলা করি, বইয়ের প্রচারে নানা কায়দা করি, কিন্তু শিশুকাল থেকে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য যা প্রয়োজন সেটি করেন না অভিভাবকরা। কথায় আছে, ‘আদৌ কথার সময় হতে করে করিয়ে যাই শেখাবি, সেটিই হবে মোক্ষম ছেলের, হিসেবে চল নয় পস্তাবি।’ রিডিং ডে’তে বিভিন্ন দেশে বিখ্যাত লোকজন শিশুদের বই পড়ে শোনান, আনন্দ দেন। যাতে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে। আমাদের দেশে একসময় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে লাইব্রেরি গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল, সেটি অন্য অনেক প্রকল্পের মতো হয়তো ফাইল চাপা পড়ে আছে। আবার যেসব সরকারি লাইব্রেরি রয়েছে সেগুলোতে দেখা যায়, প্রকাশক ‘ধরাধরি’ করে এমন সব বই কিনিয়েছেন যেগুলো মানহীন এবং সৃজনশীলতা বিকাশে কোনোই ভূমিকা রাখে না। একজন পলান সরকার হয়তো নেই, কিন্তু তার কাছাকাছি অনেকে আছেন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বই পড়াকে একটা আন্দোলন হিসেবে নিয়েছে। বইয়ের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে তারা তৎপর, বিশেষ করে কিশোর তরুণদের মাঝে। বই পড়ে বই পুরস্কার থেকে শুরু করে বইমুখী করার কত না প্রচেষ্টা। তেমনি মাউশির এই নির্দেশনা কার্যকর হলে সেটিকেও যুগান্তকারী বলতে পারি। কারণ এতে করে শিশু বয়সেই গড়ে উঠবে বইয়ের প্রতি ঝোঁক। আর যার মধ্যে ভালো বই পড়ার নেশা ঢুকে যায় তাকে আর কোনও নেশাই কাবু করতে পারে না। জগতের কোনও হতাশা, ব্যর্থতা তাকে ধরাশায়ী করতে পারে না। শত বন্ধুর উপহাসেও তার কিছু যায় আসে না। কারণ বই-ই তার প্রকৃত বন্ধু।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক   

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ