X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

জেন্ডার বাজেট মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে

চিররঞ্জন সরকার
১৮ জুন ২০১৯, ১৬:২১আপডেট : ১৮ জুন ২০১৯, ১৬:২১





চিররঞ্জন সরকার বর্তমান বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নকে আর্থসামাজিক উন্নয়নের সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার জন্য অপরিহার্য নিয়ামক হচ্ছে–নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারীরা যেহেতু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিবিধ সুবিধাবঞ্চিত, সেহেতু সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের একীভূত করার জন্য প্রয়োজন আলাদা আর্থিক বরাদ্দ।



জেন্ডার বাজেট মানে হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে যে ফারাক আছে, তা চিহ্নিত করা। কিন্তু নারীরা পিছিয়ে আছে বলে নারীর বিষয়টি বেশি আলোচিত হয়। জেন্ডার বাজেট কিন্তু নারীর জন্য আলাদা কোনও বাজেট নয়, বরং এটি একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশের সাহায্য জাতীয় বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ করা যায়। জেন্ডার বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের জেন্ডার সংবেদনশীলতা চিহ্নিত করে বাজেটে সম্পদের যথাযথ বণ্টনের মাধ্যমে নারী-পুরুষের সমতা বৃদ্ধি বা অসমতা হ্রাস করা।
জেন্ডার বাজেট শুধু টাকার হিসাব নয়। এ বাজেটের মূল উদ্দেশ্য জেন্ডার বা লৈঙ্গিক সমতার বিষয়টিকে রাষ্ট্রের সব ধরনের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা। বাজেটে এমনভাবে বরাদ্দ প্রদান করা, যাতে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা সম্ভব হয়।
আমাদের দেশে জাতীয় বাজেটে আলাদা করে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন উপস্থাপন ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে শুরু হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে সরকার জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে ৪৩টি মন্ত্রণালয়কে অন্তর্ভুক্ত করে এবং ৩টি গুচ্ছে ভাগ করে প্রতিবেদন তৈরি করে। এগুলো হচ্ছে:
এক. নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি কৌশলের অধীনে রয়েছে ৯টি মন্ত্রণালয়;
দুই. উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত কৌশলের অধীনে আছে ৯টি মন্ত্রণালয়; এবং
তিন. সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধি করার কৌশলের অধীনে রয়েছে ২৫টি মন্ত্রণালয়।

জেন্ডার বাজেট

২০১৯-২০ অর্থবছরের জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায়, গতবছরের প্রস্তাবিত ও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেট উভয়ক্ষেত্রে নারীর হিস্যা টাকার অঙ্কে ও তার শতকরা হারেও বেড়েছে।
বিগত বছরগুলোর বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। যেখানে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৬৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকা, সে তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ বেড়েছে অনেক, এক লাখ ৬১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।
বাজেটে বরাদ্দ বাড়লেও যে প্রক্রিয়ায় জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হচ্ছে, তা নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হচ্ছে না। অথচ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি'র) ৫ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারীর ক্ষমতায়ন। এই এসডিজি বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর।
পিছিয়ে পড়া নারীদের উন্নয়নে গত কয়েক অর্থবছর থেকে জাতীয় বাজেটের সঙ্গে আলাদা করে জেন্ডার বাজেট ঘোষণা করা হলেও এর ফলাফল জানা যাচ্ছে না। নারীর প্রতি সহিংসতা-নির্যাতন ও বৈষম্য কি কমছে? সরকারের বিভিন্ন স্তরে যারা কাজ করছে, তারা কি জেন্ডার সংবেদনশীল? যদি না হয়, তাহলে জেন্ডার সংবেদনশীলতা বাড়ানোর জন্য আদৌ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কি? সবচেয়ে বড় ব্যাপারে হলো, সরকার জেন্ডারবান্ধব বাজেট করলেও এর বাস্তব অগ্রগতি নিয়ে কোনও পর্যালোচনা ও সমীক্ষা নেই। পর্যবেক্ষণের অভাবে বাজেট বরাদ্দের কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, নারীর জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো, সে বিষয়েও কোনও তথ্য-উপাত্ত নেই। জেন্ডার বাজেট নিয়ে ধারণাগত অস্পষ্টতাও রয়েছে।
অথচ জেন্ডার বাজেটের মূল উদ্দেশ্য—নারীরা যেসব ক্ষেত্রে বৈষম্য বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তা হ্রাস করে নারীর উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এজন্য বাজেট নারীর ক্ষমতায়নে কতটুকু ভূমিকা রাখছে, বরাদ্দ সঠিক খাতে হচ্ছে কিনা, এসব বিষয়ের মূল্যায়ন প্রয়োজন। যেখানে নারীর বৈষম্য দূর করার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেই বিরাট ঘাটতি। নারী প্রত্যেক জায়গায় প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে জেন্ডার বাজেটের ফলাফল ও কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে দেখা দরকার। প্রতিবছর মন্ত্রণালয়গুলো কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের আশাবাদ ব্যক্ত করে। পরের বছর দেখা যায়, পুরনো সমস্যাগুলোর সমাধান ছাড়াই নতুন সমস্যা যোগ হয়। এতে করে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ফি বছর আলাদা জেন্ডার বাজেট করলেও কাজের কাজ কিছু হয় না।
২০১৯-২০ সালের জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনেও বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় নারীর জন্য কাজের পরিবেশ সৃষ্টি ও সুযোগ বৃদ্ধিতে ডে কেয়ার প্রতিষ্ঠা জরুরি বিবেচনায় নিয়ে সেটি করণীয় তালিকায় রেখেছে। এছাড়া নারীর সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, নারীবান্ধব কাজের সুযোগ, নারীকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কাজের কাজ কী হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়।
সরকারি জনসেবায় দরিদ্র নারীদের প্রবেশগম্যতাকে তাদের উন্নয়নের একটি ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনসেবার পরিকল্পনা এবং বিতরণ পর্যায়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। সবকিছু বিবেচনা করে নারীদের কার্যকরী অংশগ্রহণের মাধ্যমে জেন্ডার বাজেট প্রণয়নের দাবি গত কয়েক বছর ধরেই উচ্চারিত হচ্ছে।
নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতা দূর ও নারীর ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করতে হলে শুধু নামকাওয়াস্তে জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করলেই হবে না, আরও কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে আমার প্রস্তাব:
বাজেট বিশ্লেষণের যে ৩টি স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে, তার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি গুণগত বিশ্লেষণ করার জন্য পরিমাপক নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষত জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে, সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বরাদ্দ দেখানোর পাশাপাশি সেই বরাদ্দকৃত বাজেট আসলে নারীর কোন কৌশলগত জেন্ডার চাহিদা পূরণ করছে এবং তার অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ থাকতে হবে।
কেবল সেফটি নেট প্রকল্প কিংবা ক্ষুদ্রঋণ ভিত্তিক কর্মসূচিতে নারীর উন্নয়ন সীমাবদ্ধ না রেখে বৃহত্তর নারী সমাজের ক্ষমতায়ন ও জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে নারীর সমস্যা চিহ্নিত করে সেসব সমস্যা সমাধানে ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে আলাদা জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করা দরকার। আর নারী লক্ষ্যীভূত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্বাচনে ও প্রণয়নে নারীর মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং নারীর প্রয়োজন সঠিকভাবে নির্ণয় করে এ ধরনের প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নারীকে নিয়োগ দিতে হবে।
জেন্ডার বাজেট বাস্তবায়নে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং এনজিও ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। এই সেলের কাজ হবে জেন্ডার বাজেটের কর্মসূচিগুলো পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে দেখা।
এখন প্রায় সব মন্ত্রণালয়ে নারীদের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। কিন্তু ফল সেভাবে আসছে না। এর কারণ কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। অনেক দেশে মন্ত্রণালয়গুলোতে আলাদা ‘জেন্ডার বাজেট সেল’ রয়েছে। এই সেলগুলোর দায়িত্বই হতো জেন্ডার বাজেটিংয়ে নারীর চাহিদাগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। যার প্রতিফলন বাজেট বরাদ্দতে আসতে পারে—এই পুরো প্রক্রিয়াটির দায়িত্বে এই সেল থাকতে পারে। সর্বোপরি, বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে খরচ হচ্ছে কি-না, বাস্তবায়ন পর্যায়ে তা মনিটর করা এবং অর্থবছর শেষে কতটুকু চাহিদা পূরণ হলো, তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে এবং এর প্রতিফলন পরবর্তী বাজেটে আসতে হবে।
উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা না হলে গতানুগতিক জেন্ডার বাজেট ঘোষণা নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনও সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।
লেখক: কলামিস্ট

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ