X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

নারী বিদ্বেষ ও সামাজিক বিকার

চিররঞ্জন সরকার
০৪ জুলাই ২০১৯, ১৫:৪৬আপডেট : ০৪ জুলাই ২০১৯, ১৫:৫৫

চিররঞ্জন সরকার বরগুনায় স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নির সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হয় স্বামী রিফাত শরীফকে। এই নৃশংস খুনে নেতৃত্ব দেয় রিফাত ফরাজী, নয়ন বন্ডসহ কয়েকজন। ঘটনার পর খুনিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সারাদেশের মানুষ সোচ্চার হয়েছে। এরই মধ্যে মূল আসামি নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এরমধ্যেও একশ্রেণির মানুষ আয়েশা আক্তার মিন্নির চরিত্র হননে ব্যস্ত ছিলেন। মিন্নি খারাপ মেয়ে, তার সঙ্গে দুর্বৃত্ত নয়নের প্রেম ছিল, নয়নের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল—এমন কিছু বিষয়কে সামনে টেনে এনে এই খুনের ঘটনায় মিন্নিকেই দোষী সাব্যস্ত করার একটা মরিয়া চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে এই পৈশাচিক খুনের ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে পারে বলে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের দেশে যেকোনও অপরাধমূলক তৎপরতাকে হালকা করে দেখার একটা প্রবণতা চালু হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে যদি কোনও নারীর যোগ থাকে তবে প্রথমেই ওই নারীকে অপবাদ দেওয়া হয়, ঘটনার দায় তার ওপর চাপানো হয়। গণমাধ্যম, প্রশাসন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সাধারণ মানুষ—সবাইকেই কমবেশি এই ভূমিকায় দেখা যায়। এতে প্রথমেই দুর্দশাগ্রস্ত নারীটি ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর অপরাধীদের প্রতি সামাজিক সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। দুর্বৃত্তদের জন্য এটা সীমাহীন আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। এই চরম নেতিবাচক মানসিকতার কারণে আমাদের দেশে অপরাধীদের এত বাড়বাড়ন্ত।

এমনিতেই আমাদের দেশে খুন-হত্যাকাণ্ড, যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতন ইত্যাদি অপরাধের খুব একটা বিচার হয় না। ত্রটিপূর্ণ, তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ, বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি, অপরাধীদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি নানা কারণে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতেই কাঁদতে থাকে। তার ওপর রয়েছে সামাজিক বিকার। এই বিকারের চরম প্রকাশ হলো ‘নারী-বিদ্বেষ’। আমাদের সমাজে ‘নারী-বিদ্বেষ’ খুবই জটিল এক মনস্তত্ব। এ দেশের পুরুষরা মাকে ভালোবাসে। প্রতিনিয়ত মাতৃবন্দনা করে। বোনকে জানের জান, কলিজার টুকরো মনে করে। প্রেমিকার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে। বউয়ের জন্য অনেকে আত্মোৎসর্গ করে। মেয়েসন্তানের জন্য প্রাণপাত করে। কিন্তু এই পুরুষরাই আবার সামগ্রিকভাবে নারী-বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে। নারীকে চরিত্রহীন তো ভাবেই, যেকোনও অপকর্ম এবং যেকোনও ধরনের অঘটনের জন্য মূল ‘কালপ্রিট’ হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে পুরুষরা আপসহীন হয়ে থাকে।

এর কারণ কী? না, এর কোনও সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। নারীবাদীদের মতে, এর কারণ হলো পুরুষরা সব সময়ই নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। ‘পৌরুষের অহংকার’ তাদের মধ্যে সারাক্ষণ টগবগ করে ফোটে। কোনও ঘটনায় যখন কোনও পুরুষ দোষী সাব্যস্ত হয়, আবার এর পেছনে যদি কোনও ‘নারীর বিষয়’ যুক্ত থাকে, তখন তার যাবতীয় ক্ষোভ ওই নারীর বিরুদ্ধে গিয়ে জমা হয়। পুরুষকে নিজ গোত্রের মনে করে বলে তার প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি বোধ কাজ করে। পক্ষান্তরে নারীকেই মনে করে প্রতিদ্বন্দ্বী। জীবনের যাবতীয় ক্ষোভ-বঞ্চনার প্রধান নিশানা হয় নারী।

এর পেছনে ‘সমাজপ্রগতির’ও ভূমিকা আছে। একটা সময় পর্যন্ত আমাদের সমাজে পুরুষরাই ছিল সর্বেসর্বা। সবখানে ছিল পুরুষেরই নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব। এখন যুগ পাল্টেছে। রাষ্ট্রপরিচালনা থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীরা হয়ে উঠেছে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী। তারাও সমাজে পুরুষের পাশাপাশি সমান ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় পুরুষরা পিছিয়ে পড়ছে। এই ক্ষোভ গিয়ে জমা হচ্ছে নারীদের ওপর। নারীর যোগ্যতা, মেধা, সাজ-পোশাক-চলন-বলন, মানুষ হিসেবে সমাজে তার বিকাশ ও দৃঢ় অবস্থানকে পুরুষরা মেনে নিতে পারছে না। ফলে তারা নারী-বিদ্বেষী হয়ে উঠছে।

আমাদের সমাজে নারী-বিদ্বেষের আরও একটা কারণ আছে। এখানে অনেক পুরুষ আছে, যারা নারীদের ‘ভোগের সামগ্রী’ ছাড়া অন্য কোনও কিছু ভাবতে নারাজ। তারা কল্পনায় প্রত্যেক নারীকেই একান্তে কামনার সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। কিন্তু তাদের সেই চাওয়া মেটে না! ফলে ব্যক্তিগত লালসা চরিতার্থ করার ব্যর্থতাজনিত ক্ষোভও গিয়ে জমা হয় নারীর ওপর।

একজন নারী যদি একটু সুশ্রী, পরিপাটি হন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যাবতীয় ঘেরাটোপ ভেঙে মাথা তুলে দাঁড়ান, তার বিরুদ্ধেই পুরুষরা ফুঁসে ওঠে। সবসময় মওকা খোঁজে কীভাবে তার চরিত্রের ওপর কলঙ্ক লেপন করা যায়। তাকে কীভাবে জব্দ করা যায়, ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া যায়। কীভাবে তাকে একজন ‘খেলুড়ে মেয়ে’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। এর মাধ্যমে সে এক ধরনের শান্তি-স্বস্তি খুঁজে পেতে চায়। নিজেকে, পুরুষকে ভালো সাজিয়ে নারীকে ‘খারাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্যে ‘পুরুষতান্ত্রিক পলিটিক্স’ আজও আমাদের সমাজে প্রবলভাবে বিরাজমান। ফলে নারীরা ভীষণভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে। আক্রান্ত, নির্যাতিত এমন নিহত হয়েও সে শান্তি-সান্ত্বনা-সহানুভূতি, মর্যাদা পায় না, পায় ‘চরিত্রহীন’তার অপবাদ!

তার মানে এই নয় যে, আমাদের সমাজে সব মেয়েই অতি ভালো, তাদের কোনও দোষ-ত্রুটি নেই। আর সমাজের সব পুরুষই লম্পট-চরিত্রহীন, নারীবিদ্বেষী- এও সঠিক নয়। হ্যাঁ, ভালো-খারাপ পুরুষ-নারী উভয়ের মধ্যেই আছে। কিন্তু আমাদের সমাজের শক্তিশালী প্রবণতা হলো নারী বিদ্বেষ। সে কারণেই নারী-সংক্রান্ত অপরাধমূলক ঘটনাগুলো সমাজে বাড়ছে।

আমাদের সমাজে ‘নারী-বিদ্বেষ’ এখন একটা বড় বিকারে পরিণত হয়েছে। সমাজকে এই বিকার থেকে বের করে আনতে হলে দরকার সামাজিক জাগরণ। এর জন্য আইনি পদক্ষেপ যেমন দরকার, ঠিক তেমন দরকার সুশিক্ষা। সচেতনতা। জেন্ডার সংবেদনশীলতা। আমাদের থানা-পুলিশ-বিচার-আইনকে জেন্ডার সংবেদনশীল করতে হবে। এর জন্য দরকার নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা। নারীকে ভোগের বস্তু নয়, মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা আজ সবচেয়ে বেশি দরকার। মানুষ হিসেবে একটা মেয়ে প্রেম করতে পারে, বনিবনা হলে সে প্রেম ভেঙে দিতে পারে, কাউকে পছন্দ হলে বিয়ে করতে পারে, স্বামী যদি অপছন্দনীয় কিছু করে তবে সেই বিয়ে ভেঙে দিয়ে নতুন করে সংসার বাঁধতে পারে। একজন পুরুষ যদি একাধিক প্রেম ও বিয়ে করতে পারে, নারীরা করলে তা দোষের হবে কেন? কেন সে ক্ষেত্রে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে? কেন তাকে ‘বেশ্যা’ হিসেবে পরিচিত করানোর জন্য সবাই উঠেপড়ে লাগবে?

একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে যে কারোরই পছন্দের অধিকার রয়েছে। পছন্দের কারও সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার যেমন অধিকার রয়েছে, প্রয়োজনে সম্পর্ক ছিন্ন করারও অধিকার রয়েছে। এটা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

বরগুনার রিফাত শরীফের খুনকে জায়েজ করতে ফেসবুকসহ যেকোনও মাধ্যমে যারা নানারকম গল্প এবং সাফাই-মন্তব্য ছড়াচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করে খুনের মদতদাতা হিসেবে আইনের আওতায় আনা উচিত। খুনির চেয়ে খুনের মদতদাতার অপরাধ কোনও অংশে কম নয়।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ