X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

লাগামহীন কর্মঘণ্টা বিপন্ন জীবন

আনিস পারভেজ
১৭ জুলাই ২০১৯, ১৭:১৭আপডেট : ১৭ জুলাই ২০১৯, ২০:৩৬

আনিস পারভেজ আপনি সকালে বেরিয়েছিলেন, এখন সন্ধ্যা পার করে রাত হয়েছে অনেক, ঘরে ফিরে এলেন যখন, তখন আপনার সন্তান ঘুমুচ্ছে। আপনার সঙ্গী—স্ত্রী বা স্বামী ক্লান্তিতে নুয়ে আছেন। সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফেরার পর আপনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় উদ্দীপ্ত করার কেউ নেই। আজকেই যে অফিসে কাজ বেশি ছিল তা নয় কিন্তু, আপনি প্রায় প্রতিদিনই অনেক রাত করে বাড়ি ফেরেন—কাজের অনেক চাপ। আপনার নিয়োগপত্রে ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কাজ করার সুনির্দিষ্ট চুক্তি থাকলেও কোনোদিনই রাত নয়টার আগে অফিস থেকে বের হতে পারেন না। পরিবার ও স্বজনদের কাছে ফিরতে ফিরতে নিশুতি। মাঝে মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও বলে দেয় শুক্রবারেও অফিসে আসতে হবে।
বাড়তি কর্মঘণ্টার জন্য কোনও উপরি নেই, নেই ছুটি। আপনার নিয়োগকর্তা বলবেন, আপনি তো অফিসার, পিয়ন নন, আপনার জন্য ওভারটাইম নেই। আপনার অতিরিক্ত শ্রমে প্রতিষ্ঠানের রুজি ও পুঁজি বাড়ছে। আপনার সবটুকু শুষে নেওয়ায় ধীরে ধীরে ক্লান্তিতে আপনার নার্ভ শিথিল হয়ে অচল হয়ে যাচ্ছে, বন্ধুবান্ধব নাই হচ্ছে। পরিবারে থেকেও আপনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। 

মানসম্মত জীবন অনেক আগেই হাওয়া। আপনি কেবলই একটি মেশিন, অন্য কেউ আপনাকে নিঙ্‌ড়ে তার বিত্ত গড়ছে। 

এরকম অবস্থায় রোগ ব্যাধি আপনাকে গ্রাস করে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। সংসারে শান্তি নেই, ভালোবাসার জন্য যেটুকু শারীরিক শক্তি দরকার, তা নিয়ে তো আপনি ঘরে ফেরেন না। রক্তে শর্করা বাড়ে, হঠাৎ একদিন স্ট্রোক অর্থাৎ মস্তিষ্কে রক্তপাত। সঞ্চয়ের সবটা দিয়ে চিকিৎসা, ভাগ্যক্রমে জীবন ফিরে পেয়ে বাড়ি এলেও আপনি পঙ্গু। হয়ে যান সংসারের বোঝা, যে আপনি সেদিনও সংসারে জ্বালানি দিয়ে আসতেন। আপনার পরিবার বিপন্ন।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপে বাংলাদেশে সবচে বেশি মৃত্যু হচ্ছে স্ট্রোকে। স্ট্রোকে আক্রান্তদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৪৫ যারা কর্মজীবী। 

উন্নয়ন যাত্রায় বাংলাদেশে অসংখ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে—বাণিজ্যিক সংস্থা, কারখানা, উন্নয়ন সংস্থা ইত্যাদি। বলা হয়, এদেশে করপোরেট সংস্কৃতি সূচিত হয়ে পূর্ণতা পাচ্ছে এসব সংস্থার মাধ্যমে। আসলেই কি তাই?

করপোরেট সংস্কৃতি শুধু স্যুট আর টাই পরে হয় না, মানবিক নীতিমালার ভিত্তিতে একটি যৌক্তিক (rational) অনুশাসনে এ সংস্কৃতি দুটো জিনিসকে প্রাধান্য দেয়, শ্রমিক বা কর্মীদের জন্য সুস্থ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সবার জীবনমান বিঘ্নিত না করে সংস্থার লক্ষ্য পূরণ করা।   

আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে সুস্থ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে আইন ও বিধিমালা, বাংলাদেশেও তাই আছে। বাংলাদেশ লেবার ল’ ২০০৬-এর ১০০ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে, কোনও শ্রমিক (আসলে সব কর্মচারী) প্রতিদিন আট ঘণ্টার বেশি কাজ করবে না। সপ্তাহে অন্তত একদিন ছুটি থাকতে হবে। আট ঘণ্টা কাজ করার জন্য অন্যূন আধ ঘণ্টার বিরতি দিতে হবে। ১০৩ ধারা অনুযায়ী বিশেষ প্রয়োজনে কর্মচারীর মত নিয়ে বাড়তি সময়ের জন্য কাজ করানো যেতে পারে, তবে তার জন্য বাড়তি মজুরি দিতে হবে। বাড়তি কাজ রাতে করলে পরবর্তী দিন ছুটি দিতে হবে (ধারা ১০৩ক)। বাড়তি মজুরি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ১০৮ ধারায়, যেখানে লেখা আছে–‘যে ক্ষেত্রে কোনও শ্রমিক কোনও প্রতিষ্ঠানে কোনও দিন বা সপ্তাহে এই আইনের অধীনে নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করেন, সে ক্ষেত্রে তিনি অধিককাল কাজের জন্য তাহার মূল মজুরি ও মহার্ঘ ভাতা  এবং এডহক বা অন্তর্বর্তী মজুরি, যদি থাকে, এর সাধারণ হারের দ্বিগুণ হাড়ে ভাতা পাইবেন।’  

কারখানার শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ লেবার ল’ অনেকাংশে মানা হলেও, অগনিত বাণিজ্যিক ও বিশেষ করে উন্নয়ন সংস্থায় কর্মচারীদের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা নিয়ে কোনও চিন্তাই নেই। মালিক, নিয়োগকর্তা বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করে রাত অবধি কাজ না করলে চাকরিই থাকবে না। 

অধিক সময় কাজ করানোর উদ্দেশ্য একটিই—বাড়তি মুনাফা অর্জন। দু’ধরনের মুনাফা আছে, ভৌত এবং অভৌত। বাণিজ্যিক সংস্থা ভৌত মুনাফা বাড়ায় কর্মচারীর অতিরিক্ত শ্রমে। উন্নয়ন সংস্থায় লাগামহীন কর্ম ঘণ্টার চর্চা সে সংস্থাগুলোর অধিকারকদের অভৌত মুনাফা বাড়ানোর জন্য। তাই এটা কোনও বিস্ময় নয় যে, এখানেও শ্রম শোষিত হয়। অনেক সংস্থাই আছে যারা Decent Job নিয়ে গবেষণা করে, এবং করে অ্যাডভোকেসি। অথচ তাদের নিজেদের ভেতরই নগ্নভাবে অনুপস্থিত সুস্থ কর্মপরিবেশ। 

সামন্ত মানসিকতা নিয়ে করপোরেট সংস্কৃতি গড়া সম্ভব নয়। সামন্ত অহঙ্কারে কর্মচারীদের প্রজা জ্ঞান করা হয়। তাদের চাকরি যেন কর্তার দয়া। বেতন দেওয়া হচ্ছে এটাই বেশি, কর্মঘণ্টা এখানে কোনও বিষয়ই নয়। দেশে রয়েছে কর্মের অভাব, তাই কর্ম হারানোর ঝুঁকি নেওয়া পায়ে কুড়াল মারা। এ সুযোগটিই নিচ্ছে তারা, যারা  প্রবঞ্চক। 

ক্রীতদাসের মতো কাঁধে জোয়াল দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে নিশুতি পর্যন্ত। নিজের জন্য সময় নেই, পরিবারে থেকেও অনুপস্থিত এবং সবসময়ই আতঙ্ক চাকরি হারানোর। এ অবস্থায় বাইরে থেকে আমাদের যত ভালোই দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে আমরা ততই ক্ষয়ে যাচ্ছি। বিপন্ন থেকে বিপন্নতর আমাদের জীবন।

লেখক: যোগাযোগ ও সিনেমা গবেষক   

 

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ