X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ে উন্নয়ন, বাড়ে লাশ

বিনয় দত্ত
০৬ জানুয়ারি ২০২০, ২০:১৪আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২০, ২০:১৬

বিনয় দত্ত ১.
‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ শব্দটি শুনলে প্রথমে বিশাল স্বর্ণের ডিম চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই স্বর্ণের ডিম নিয়ে অনেক মজার গল্প প্রচলিত থাকলেও আমি কোনও মজার গল্প বলবো না। আমি যে গল্প বলবো তা একটু বেদনাদায়ক। ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ এ কথাটি আমাদের দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের বলা হয়। কারণ, তারা দেশে যে পরিমাণ টাকা পাঠান তার মুনাফা দিয়ে আমাদের দেশের অনেক বড় বড় উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ যখনই কমতে থাকে তখন সবারই মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের।
‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ এ মানুষগুলো মূলত শ্রমিক। দেশে শ্রম দিলে তাদের দেশি শ্রমিক বলা হতো, যেহেতু তারা বিদেশে শ্রম দেন, সেই শ্রমের বিনিময় অর্থ পান এবং সেই অর্থ বাংলাদেশে পাঠান, তাই তাদের প্রবাসী শ্রমিক বলা হয়। কি, শুনতে খারাপ লাগছে? ভাবছেন, আমি তাদের অপমান করছি? মোটেও না। তাদের কষ্টটা আমি খুব ভালোভাবে বুঝি। আর বুঝি বলেই লিখতে বসেছি।
প্রবাসী শ্রমিক। এই লোকগুলো নিতান্তই অভাবে পড়ে বিদেশে যান, বেশিরভাগই দেশে ধার করে বিদেশে পা রাখেন। আর পা রেখেই অমানুষিক শ্রম দেওয়া শুরু করেন। কখনও খেয়ে, কখনও উপবাস থেকে, কখনও ঘুমিয়ে, কখনো নির্ঘুম রাত কাটিয়ে তারা যে অমানবিক পরিশ্রম করেন তা বর্ণনাতীত।

সৌদি আরবে কারও আত্মীয়স্বজন থাকলে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন, ৪৫-৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় দিনের বেলায় যখন কোনও লোক বাসা থেকে বের হয় না, সেই তাপমাত্রায় দিনের বেলায় কিছু লোক কাজ করছেন। এরা কারা? এরাই বাংলাদেশি শ্রমিক। যারা কাড়ি কাড়ি অর্থ বাংলাদেশে পাঠান আর সেই অর্থেই এই দেশে উন্নয়নের ডামাডোল পেটানো হয়।

প্রশ্ন আসতেই পারে, তাদের বিদেশে কে যেতে বলেছে? বা এত কষ্ট তাদের কে করতে বলেছে? কেউই বলেনি। জীবিকার তাগিদে তারা দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে দাসত্ব গ্রহণ করেছে, আনন্দে নয়। বর্তমানে দেশে শিক্ষিত বেকার কতজন জানেন? আমি বলে দিচ্ছি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ২৬ লাখ।

প্রায় সাতাশ লক্ষ বেকার দেশে কোনও চাকরি পাচ্ছে না। এই বাস্তবতা আজকের নয়। প্রবাসী শ্রমিকরা চাকরি না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কিছু হয়তো আছেন যারা নিজেকে আলাদা অবস্থানে নিতে চেয়েছেন, তাদের সংখ্যা খুব কম, কিন্তু বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যসহ সব দেশে অবস্থান করছেন।

একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, বর্তমানে দেশের প্রায় সব মন্ত্রীই সাবলম্বী বা উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলছেন। কেন? কারণ, এখন দেশে আসলেই চাকরি দেওয়ার মতো খাত কমে গিয়েছে। নতুন খাত তৈরি হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তা অন্য আলোচনা। দেশে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে, প্রচুর বৈদেশিক অর্থ দেশে আসছে বিনিয়োগের জন্য। সেই অর্থ যে দুর্নীতির জিন-ভূতেরা লুটে নিচ্ছে তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই।

দেশে শিক্ষিত বেকার বাড়ছে। এই সংকট আজকের নয়। অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে। এখন মন্ত্রীরা বুঝতে পারছেন। কারণ, আমাদের দেশে সবকিছুই আমরা বুঝি, যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন। এই কারণে শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তিত হচ্ছে, উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

২.

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০০৫-২০১৯ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে প্রবাসী কর্মীর লাশ এসেছে ৪০ হাজার ৮০৬টি। এর বাইরে বিদেশে অনেক প্রবাসীর লাশ দাফন হয়েছে। সেই সংখ্যা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জানা নেই। প্রবাসীদের এমন মৃত্যুর কারণ নিয়েও কখনও অনুসন্ধান করেনি এই মন্ত্রণালয়।

তাহলে এই বিশেষ মন্ত্রণালয়ের কাজ কি? শুধু বিদেশি অর্থ সঠিকভাবে আসছে কিনা তার খোঁজ নেওয়া? মজার ব্যাপার হলো, বিদেশে কর্মরত অবস্থায় গত সাত বছরে যেসব শ্রমিক মারা গেছেন, তাদের ৭৫ শতাংশের পরিবারই কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি। বিদেশে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তির দুর্বলতা, জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নজরদারির অভাব এবং দূতাবাসগুলোর নিষ্ক্রিয়তাসহ অনেক কারণ রয়েছে এর পিছনে।

আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়ায় একজন শ্রমিক মারা গেছেন। সেই শ্রমিকের লাশ তারা দেশে পাঠাতে পারছেন না। কারণ, মালয়েশিয়ায় যে বিল্ডিং ভাড়া নিয়ে যিনি দূতাবাস চালাতেন তার কয়েক মাসের ভাড়া বাকি পড়ায় বাড়িওয়ালা অফিসে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। এই রিপোর্টটি দেশের প্রথম সারির একটি বেসরকারি চ্যানেল সারা দিন ধরে দেখিয়েছে। এই হচ্ছে আমাদের ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’-এর ভয়ানক বিপর্যয়ের গল্প। গল্প কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি, বরং শুরু হয়েছে।

‘নারীশ্রমিক কণ্ঠ’ তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের তথ্যানুযায়ী, বিদেশ থেকে গত ১০ বছরে ২৬ হাজার ৭৫২ জন নারীকর্মীর লাশ দেশে ফিরেছে। এর কারণ হিসেবে সরকারের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন যথাযথভাবে না মানাকেই দায়ী করছে সংস্থাটি।

এই যখন বাস্তবতা, তখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘সৌদি আরবে কর্মরত ২ লাখ ২০ হাজার নারীর মধ্যে মাত্র ৫৩ জনের মৃতদেহ ফিরে এসেছে; যা খুবই নগণ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার কর্মরত আছেন সৌদিতে। এরমধ্যে মাত্র ৮ হাজারের ফিরে আসা এবং তাদের মধ্যে ৫৩ জন সে দেশে মারা যাওয়ার ঘটনা সংখ্যার হিসাবে বড় কিছু নয়।’

এরকম অসাধারণ একটি বক্তব্যের পর আর কারও কিছু বলার থাকে না!

৩.

আগস্ট ১৯৯০ সাল। ইরাক হঠাৎ করে কুয়েত আক্রমণ করলো। আক্রমণে ১ লক্ষ ৭০ হাজার ভারতীয় কুয়েতে আটকা পড়েন। তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য রণজিৎ কাটিয়াল নামের ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী ও ধনী অসাধারণ কিছু উদ্যোগ নেন। ভারতে যোগাযোগ, ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ, ১ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের খাবারে ব্যবস্থা, তাদের জন্য আলাদা শরণার্থী ক্যাম্প তৈরি করা, ইরাকি সৈন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলাসহ সবকিছুই করেন এই রণজিৎ কাটিয়াল। অবশেষে ভারত সরকারের সহযোগিতায় এই ১ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষকে ফিরিয়ে আনার জন্য ৪৮৮টি এয়ার ইন্ডিয়ার বাণিজ্যিক বিমান আকাশে উড়েছিল। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সরিয়ে নেওয়ার গল্প।

এই ঘটনাটি সত্য। এই ঘটনাকে অবলম্বন করে রাজা কৃষ্ণ মেনন ২০১৬ সালে এয়ারলিফট নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। অসাধারণ একটি চলচ্চিত্র। সেই সময়ের সত্য ঘটনাকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।

প্রশ্ন হলো, এই গল্পটি কেন বললাম? কারণ, প্রবাসীরা যখন লাশ হয়ে আসেন তখন আমাদের মন্ত্রী কি মন্তব্য করেন আর ১৯৯০ সালে ১ লক্ষ ৭০ হাজার ভারতীয় আটকা পড়ায় তাদের দেশের সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছিল। এই হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের সঙ্গে তাদের তফাৎ।

আমরা ভাবি, এ তো লাশ। আর ওরা ভাবে এ হচ্ছে আমাদের দেশের জনগণ। যদি তা-ই না ভাবতাম তাহলে ‘…সে দেশে মারা যাওয়ার ঘটনা সংখ্যার হিসেবে বড় কিছু নয়’ এই ধরনের মন্তব্যই করতে পারতাম না।

৪.

একটি পরিবারের অর্থ উপার্জনকারী মানুষ যখন মারা যান তখন সেই পরিবারের কী অবস্থা হয়? সেই পরিবারটি, সেই মানুষটির বাবা, মা, সন্তান, স্ত্রী তাদের কী অবস্থা হয়? তারা কীভাবে দিন পার করেন? এরকম শোকাবহ পরিবেশে যখন সেই দেশের মন্ত্রী তাদের অবজ্ঞাসূচক বক্তব্য দেন তখন কেমন লাগে সেই পরিবারের?

মানুষ বেঁচে থাকলে মানুষ, আর মারা গেলে লাশ, এটা চরম সত্য। কিন্তু, সেই লাশের একটা অধিকার আছে, তার সম্মান আছে, তার আত্মমর্যাদা আছে। আমাদের কোনও অধিকার নেই লাশের অধিকার, সম্মান বা আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার। এই বোধ যদি তৈরি না হয় তবে আর কিছুই বলার নেই। ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ এই মানুষগুলো যখন সেই দেশে ছিল তখন সে বাংলাদেশের সম্মান নিয়েই ছিল, আমরা কেন তার সম্মান হানি করবো?

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

[email protected]

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রিমিয়ার ব্যাংকের নতুন এমডি মোহাম্মদ আবু জাফর
প্রিমিয়ার ব্যাংকের নতুন এমডি মোহাম্মদ আবু জাফর
দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী
দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী
উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে কাজ করার আহ্বান
উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে কাজ করার আহ্বান
কোড সামুরাই হ্যাকাথনের দ্বিতীয় পর্বের ফল প্রকাশ, ৪৬ দল নির্বাচিত
কোড সামুরাই হ্যাকাথনের দ্বিতীয় পর্বের ফল প্রকাশ, ৪৬ দল নির্বাচিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ