X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
ইভান’স চাইল্ডহুড

স্বপ্নময় প্রাণ আর মৃত্যুঘেরা বাস্তবতা

মাসুদ পারভেজ
৩১ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০

স্বপ্নময় প্রাণ আর মৃত্যুঘেরা বাস্তবতা My discovery of Tarkovsky’s first film was like a miracle. Suddenly, I found myself standing at the door of a room the keys of which had, until then, never been given to me. It was a room I had always wanted to enter and where he was moving freely and fully at ease.[১] —Ingmar Bergman

চলচ্চিত্র নির্মাতা ইঙ্গমার বার্গম্যান এই কথা বলেছিলেন রুশ চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কির প্রথম চলচ্চিত্র “ইভান’স চাইল্ডহুড” প্রসঙ্গে। তখন প্রশ্ন জাগে, কেন বিস্মিত হয়েছিলেন বার্গম্যানের মতো চলচ্চিত্রকার একজন নবীন নির্মাতা তারকোভস্কির প্রথম চলচ্চিত্র দেখে? এই প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করার আগে আন্দ্রেই তারকোভস্কি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক।

বিশ্বচলচ্চিত্র জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা আন্দ্রেই তারকোভস্কি (১৯৩২-১৯৮৬) রাশিয়ার ভোলগার তীরবর্তী ইয়োরিয়েভেটস শহরের জাভ্রোজন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আন্দ্রেই আর্সেনিয়েভিচ তারকোভস্কি। তার বাবা আর্সেনেই তারকোভস্কি ছিলেন ইউক্রেন বংশোদ্ভূত একজন রুশ কবি। আর মা মারিয়া ইভানোভনা ভিশনিয়াকোভা ছিলেন থিয়েটার ও চলচ্চিত্রাভিনেত্রী। ফলে পিতামাতার কর্মপরিধি অনুযায়ী তারকোভস্কি পারিবারিকভাবেই শিল্প সাহিত্যের ছোঁয়া পান। যদিও শৈশবেই তার পিতা পরিবার ছেড়ে চলে যান। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়াও লেখালেখি, থিয়েটার, অপেরা এসবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারকোভস্কি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মস্কোর এক স্কুলে ভর্তি হন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন স্কুলের পড়াশোনায় ছেদ ঘটে। তারপর আবার ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে স্কুল শুরু করেন। পাশাপাশি সংগীত আর ড্রইংয়ও শিখতে থাকেন। ১৯৪৭-এর শেষের দিকে টিবি আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয় তাকে। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে মস্কো ইন্সটিটিউট ফর ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ-এ ‘আরবি’তে ভর্তি হন। কিন্তু পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে একাডেমি অব সায়েন্স ইন্সটিটিউট ফর নন-ফেরাস মেটাল্স অ্যান্ড গোল্ড-এ খনি-সন্ধানীর চাকরি নেন। এরপর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মস্কোর স্টেট স্কুল অব সিনেমাটোগ্রাফিতে (ভিজিআইকে) ভর্তি হন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত রাশিয়ায় রাজনৈতিক যে-পরিবর্তন শুরু হয় তার ঢেউ চলচ্চিত্রাঙ্গনেও পড়ে। ফলে কুরোসাওয়া, বুনুয়েল, বার্গম্যান, ব্রেঁস, মিজোগুচির মতো বিশ্বখ্যাত নির্মাতাদের চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পান তারকোভস্কি। তারপর ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রাবস্থায় কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছোটোগল্প অবলম্বনে ‘কিলার’ নামে শর্টফিল্ম নির্মাণ করেন। এরপর ১৯৫৮-তে শর্টফিল্ম ‘দেয়ার উইল বি নো লিভ টুডে’ বানান। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তারকোভস্কি এবং কঞ্চালোভস্কি মিলে এন্টার্কটিকা-ডিসেন্ট কান্ট্রি নামে একটি চিত্রনাট্য লিখেন এবং তা লেনিনফিল্ম-এ জমা দেন। কিন্তু তা বাতিল হয়। তারপর আবার তারা যৌথভাবে ‘দ্য স্টিমরোলার অ্যান্ড দ্য ভায়োলিন’-এর চিত্রনাট্য রচনা করেন এবং তা মসফিল্ম স্টুডিওতে নির্বাচিত হয়। তারকোভস্কি তার ডিপ্লোমা ফিল্ম হিসেবে এই চিত্রনাট্য থেকে শর্টফিল্ম নির্মাণ করেন। যা দিয়ে তারকোভস্কি ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ডিপ্লোমার পাশাপাশি নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার অর্জন করেন।[২] এরপর তিনি নির্মাণ করেন তার প্রথম চলচ্চিত্র “ইভান’স চাইল্ডহুড” (১৯৬২)। যদিও এটা তার করার কথা ছিল না। মসফিল্ম এই চলচ্চিত্র নির্মাণের দায়িত্ব দেয় আরেক তরুণ নির্মাতা এডুয়ার্ড এবালভকে। কিন্তু ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে সমালোচনার মুখে তাকে এই প্রজেক্ট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে এই প্রজেক্টটি আন্দ্রেই তারকোভস্কিকে দেওয়া হয়। যদিও চলচ্চিত্রটির নির্মাণের বাজেটের সংকট ছিল তারপরও তারকোভস্কি এটা করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে “ইভান’স চাইল্ডহুড” মুক্তি পায় এবং ওই বছরই ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কার অর্জন করে। একই সঙ্গে সমালোচক ও বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণেও সমর্থ হয়। তারপর একে একে তিনি নির্মাণ করেন আন্দ্রেই রুবলেভ (১৯৬৬), সোলারিস (১৯৭২), মিরর (১৯৭৫), স্টকার (১৯৭৯), নস্টালজিয়া (১৯৮৩), দ্য স্যাক্রিফাইস (১৯৮৬)। ‘দ্য স্যাক্রিফাইস’-এর শুটিং চলাকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর প্যারিসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই চলচ্চিত্র নির্মাতা। এবার তারকোভস্কির প্রথম চলচ্চিত্র “ইভান’স চাইল্ডহুড” নিয়ে আলোচনা করা যাক।

“ইভান’স চাইল্ডহুড” চলচ্চিত্রের কাহিনি রুশ লেখক ভ্লাদিমির বোগোমোলভের ‘ইভান’ (১৯৫৭) নামক গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। এই গল্পটি বিশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়। চিত্রনাট্যকার মিখাইল পাপাভা-এর চিত্রনাট্য তৈরি করেন। যদিও তিনি চিত্রনাট্যের শেষে ইভানের মৃত্যু রাখেননি। এতে লেখক বোগোমোলভ অসন্তুষ্ট হন। পরবর্তীকালে তা চলচ্চিত্রে যুক্ত হয়।

মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত সৈন্য এবং জার্মান হেৃম্যাখট সৈন্যদের মধ্যে যে-যুদ্ধ তা উপজীব্য করে চলচ্চিত্রের পটভূমি নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে তারকোভস্কির শৈশবও এসে উপস্থিত হয়েছে। ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ বছরগুলিতে অঁদ্রে ও তার বোনের শৈশব কাটে ও স্কুলশিক্ষা ঘটে রাজধানী থেকে অনেক দূরে গ্রামাঞ্চলে। পরে এই পটভূমিকেই অঁদ্রে বেছে নেন তাঁর ইভান’স চাইল্ডহুড ছবির প্রেক্ষাপট হিসেবে।’[৩] কিন্তু এখানে সম্মুখ যুদ্ধের কোনো দৃশ্য নেই। ‘ছবিতে যুদ্ধকে দেখানো হয়েছিল উন্মত্ততা ও মনুষ্যত্বের বিনাশকারী হিসেবে।’[৪]

পুরো চলচ্চিত্রে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি দৃশ্যে জার্মান সৈন্য হাজির করা হয়। চলচ্চিত্রটির কাহিনি নির্মিত হয়েছে ইভান বন্দারেভ নামে বারো বছর বয়েসি এক রুশ বালককে কেন্দ্র করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে যার বাবা-মা এবং ছোটোবোন মারা গেছে। সে একাই বেঁচে থাকে। এই নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকা ও যুদ্ধের ভয়াবহতা তার শিশুমনে যে-প্রভাব ফেলে সেটা তাকে আর শিশু রাখে না। ফলে জার্মান সৈন্যদের প্রতি ঘৃণা নিয়ে সেও যুদ্ধে লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে জার্মান সৈন্যদের হাতে সে আটক হয় এবং ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। ইভান সম্পর্কে জ্য পল সার্ত্রে বলেন, ‘এই যুদ্ধচিত্রের শিশু-নায়ক ইভান যুদ্ধের মতোই উন্মত্ত।’[৫]

ইঙ্গমার বার্গম্যানের কথার সূত্র ধরে “ইভান’স চাইল্ডহুড”-এ ফিরে আসা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে উপজীব্য করে বিশ্বচলচ্চিত্র জগতে বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও “ইভান’স চাইল্ডহুড” ভিন্ন একটা আবহ নিয়ে হাজির হয়। অনেক চলচ্চিত্রে যুদ্ধকে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে যখন তুলে ধরা হয়েছে তখন “ইভান’স চাইল্ডহুড”-এ বেদনাক্লিষ্ট এক বালকের মধ্য দিয়ে প্রিয়জন হারানোর ভয়বাহ অন্তর্দহনকে প্রাধান্য দিলেন তারকোভস্কি। যেখানে প্রধান চরিত্রের অন্তর্জগতের স্বপ্ন আর বাস্তবতার নির্মমতা মিলেমিশে সমান্তরালে কাহিনি চলতে থাকলো। অর্থাৎ নির্মাতা তারকোভস্কি একটা নন-লিনিয়ার প্রক্রিয়ায় ফ্ল্যাশ ব্যাকের মধ্য দিয়ে কাহিনি সাজাচ্ছেন যা চলতি বাস্তবতাকে অতিক্রান্ত করে অন্য আরেক জগতের ইমেজ হাজির করেছে। আর এই জগৎটাই মনে হয়ে উঠেছে মিরাকেল। এই ‘মিরাকেল’ দেখানোর জন্য তারকোভস্কি চলচ্চিত্রে চারবার স্বপ্নের আশ্রয় নিয়েছেন। সেই স্বপ্নগুলো বিশ্লেষণ করা যাক।

প্রথম স্বপ্ন

চলচ্চিত্রটি শুরু হয় অদম্য বালকবেলার স্বপ্নের দৃশ্য দিয়ে। কোকিলের ডাক গাছের আড়াল থেকে শুনছে একটি বালক। তার মুখের সামনে গাছে-বোনা মাকড়সার জাল। বালক সেখান থেকে সরে যায়। একটি ছাগলের মুখ আসে। তারপর খালি গা ও খালি পায়ে সোনালি চুলের বালকের দৌড়ানোর দৃশ্য, প্রজাপতির ওড়াউড়ি। বালকের উচ্চৈঃস্বরে হাসির সঙ্গে ধীরে ধীরে উপরে উড়তে থাকা। তারপর আবার কোকিলের ডাক, গাছের পাতার ফোঁকর দিয়ে সূর্যরশ্মি বালকের মুখে পড়ে। তখন সে পানি ভরতি বালতি হাতে চলতে থাকা তার মায়ের কাছে যায়। বালতির পানিতে মুখ দিয়ে পানি চুমুক দেয়। তখনও কোকিল ডাকতে থাকে। বালতি থেকে মুখ তুলে সে বলে, মা, বনে একটি কোকিল ডাকছে। তার মা নিঃশব্দে হাসে। হাসি মিলিয়ে যায়, গুলির শব্দে স্বপ্নদৃশ্য ভাঙে।

প্রথমে এই স্বপ্নদৃশ্যটির অনুষঙ্গগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। ‘অদৃশ্য কোকিলের ডাক’, ‘মাকড়সার জাল’, ‘ছাগলের মুখ’, ‘প্রজাপতি’, ‘সূর্যরশ্মি’, ‘গাছপালা’, ‘মাটি’, ‘বালক’ আর ‘মা’। এইসব অনুষঙ্গ নিয়ে পুরো ক্যানভাসটা একটা স্বর্গোদ্যানের আভাস দেয়। যেখানে একটা বালক মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়। এখানে একই সঙ্গে প্রাণ আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। এমনকি চলচ্চিত্রের শুরুতে ক্লোজশটে যে-গাছটির আড়ালে ইভানকে দেখানো হয় সেই গাছটি আর ইভানের ক্ষীণ তনু পরস্পরের সাদৃশ্য হিসেবে হাজির করা হয়েছে। ফলে ক্যামেরা যখন ক্রেনশটে গাছটির শীর্ষে পৌঁছে তখন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইভানও দৃশ্যমান হয়। আবার প্রজাপতির ওড়াউড়ির সঙ্গে সাদৃশ্য হিসেবে ইভানও উড়তে থাকে। এগুলো একেবারেই চলচ্চিত্র শুরুর দৃশ্য এবং এর দ্বারা দু’টি বিষয়কে নির্মাতা হাজির করেছেন—প্রথমত, বালক মনের ফ্যান্টাসি, আর দ্বিতীয়ত, ইভানের পূর্বের জগৎ। দুটোই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। কারণ বালক মনের যে-ফ্যান্টাসি কিংবা সারল্য তা আর বাস্তবে থাকেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্রূর পৃথিবীর কাছে তা হারিয়ে গেছে। ফলে কোকিলের ডাক মুহূর্তেই গুলি আর বোমার শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে।

ইভানের পূর্বের জগৎটাকে প্রথমেই নির্মাতা হাজির করলেন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে। যে-জগৎটা ‘সাবকনশাসলি’ তার ভেতর ক্রিয়াশীল। ফলে যখনই তার স্বপ্নটা ভেঙে গেছে তখনই একটা ক্রুর বাস্তবতা তার সামনে এসে হাজির হয়েছে। ফলে তার অন্তর্জগতের স্বপ্নময় পৃথিবী আর বহির্জগতের নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত চলতে থাকে।

দ্বিতীয় স্বপ্ন

ইভান ঘুমিয়ে থাকে। মেঝেতে শুকনো কাঠে আগুন জ্বলছে। একটি বড়ো গামলায় ফোঁটা ফোঁটা পানি পতনের শব্দ। পানি, ইভানের ঝুলে থাকা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল থেকে গামলায় পড়ছে। তখন পানির উৎস ধরার জন্য ক্যামেরা বামদিকে মুভ করতে থাকে। আর তখন একটা চারকোণাকৃতির আলোর উৎস চোখে পড়ে। যেটা একটা কুয়োর মুখ আর সেখানে ইভান ও তার মা ঝুঁকে কুয়োর তলদেশের দিকে তাকিয়ে একটা পালকের পতন দেখতে থাকে। কুয়োর তলদেশে একটা তারা দেখা যায়। আচানক, ইভান কুয়োর তলদেশে তারাটি ধরতে চেষ্টা করে। পানি ভরতি বালতির দড়ি প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে উপরে উঠতে থাকে। হঠাৎ বালতিটি দ্রুতবেগে নিচে নামতে থাকে, ইভানের মায়ের স্কার্ফ কুয়োয় পড়তে থাকে, গুলির শব্দ, কুয়োর তলদেশে মা বলে—ইভানের ভয়ার্ত চিৎকার। তারপর ইভানের মায়ের নিথর দেহ উপুড় হয়ে পড়ে থাকে আর বালতি থেকে পানি ছলকে তার মায়ের শরীরে পড়ে। দ্বিতীয় স্বপ্ন এখানে শেষ।

দ্বিতীয় স্বপ্ন যুদ্ধের ভয়াবহতার চিহ্ন নিয়ে হাজির হয়েছে এবং ইভানের মায়ের মৃত্যু সেটার পরিচায়ক। স্বপ্নের এই মৃত্যু দৃশ্যটার আগের দৃশ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে একটা পরাবাস্তব পরিস্থিতি লক্ষ করা যায়। কুয়োর মধ্যে দিনের বেলা তারা দেখার দৃশ্য এবং ইভানের কুয়োর পানিতে তারা ধরার দৃশ্যে এটার আবহ উপস্থিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যে-ভয়াবহতা ও বীভৎসতা তা থেকেই পরবর্তী পর্যায়ে পরাবাস্তবাদী শিল্পের উদ্ভব ঘটে। আর এই চলচ্চিত্রটার পরিপ্রেক্ষিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফলে নির্মাতা তারকোভস্কি বাস্তবের বীভৎসতা থেকে বালক ইভানকে বারবার স্বপ্নের সৌন্দর্যের মধ্যে নিয়ে যান। অর্থাৎ বীভৎসতার ভেতর সৌন্দর্য ধরার যে-প্রেক্ষাপট তাতে ইভানের জন্য স্বপ্ন ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। ফলে স্বপ্নে সে কুয়োর পানির তলদেশে দিনের বেলা তারা দেখে মুগ্ধ হয় এবং সেই তারা হাত দিয়ে ধরতে চায়। কিন্তু স্বপ্নটা ভেঙে যাচ্ছে গোলাগুলির আওয়াজে, যা তাকে আবার বাস্তবের নির্মম পরিস্থিতির মুখোমুখি করছে।

তৃতীয় স্বপ্ন

তৃতীয় স্বপ্নের শুরুতে বৃষ্টি আসে। বৃষ্টির মধ্যে আপেল ভরতি একটি লরি চলতে থাকে। লরিতে ইভান ও তার বোন। বিদ্যুৎ চমকায় আর গাছগুলো সব সাদাটে হয়ে যায়। বৃষ্টির মধ্যে লরিতে বসে ইভান একটি আপেল হাতে নিয়ে ছোটোবোনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। সে মুখ নিচু করে লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়াতে থাকে। পরের দৃশ্যে মেয়েটি নিঃশব্দে দাঁত বের করে হাসতে থাকে। তারপরের দৃশ্যে মেয়েটির মুখ বন্ধ থাকে, ঠোঁটে কিছুটা রহস্য—সেটা হাসি কি না, ঠিক ধরা যায় না। পরের দৃশ্যে বৃষ্টি থেমেছে, মেয়েটির দৃষ্টি প্রসারিত ও মুখ গম্ভীর থাকে। লরিটি নদীর তীর ধরে চলতে থাকে আর লরি থেকে আপেল নিচে গড়াতে থাকে। নিচে-পড়া আপেল ঘোড়াগুলো কামড়িয়ে খেতে থাকে। স্বপ্নদৃশ্য এখানে শেষ হয়।

স্বপ্নের আপেল প্রসঙ্গে বলা যাক। তারকোভস্কির ‘দ্য স্ট্রিমরোলার অ্যান্ড দ্য ভায়োলিন’ (১৯৬০) স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটির একটি দৃশ্যে ভায়োলিনবাদক ছোটো ছেলেটি তার বয়েসি ছোটো মেয়েটিকে আপেল দেয়। এই আপেল দেওয়ার দৃশ্যটা খেয়াল করলে দেখা যায় যে, ছেলেটি মেয়েটির হাতে আপেল না দিয়ে মেয়েটি যে-চেয়ারে বসে থাকে তার পাশে আপেলটি রাখে। মেয়েটি আপেলটির দিকে তাকায় তারপর আপেলটি আলতো করে ধরে চেয়ারের সামনের দিকে রাখে। তারপর ভায়োলিনের সুরে ক্লোজশটে আপেলটিকে দেখানো হয়। ফলে এখানে আপেল শুধু একটা ফল হিসেবে আর থাকে না। এটা ভালোবাসার একটা প্রতীক হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।

“ইভান’স চাইল্ডহুড”-এ স্বপ্নে ইভান যখন আপেল ভরতি লরিতে বসে তার ছোটোবোনকে আপেল বাড়িয়ে দেয় তখনও বোঝা যায় যে, আপেল নিছকভাবে এখানে নির্মাতা দেখাননি। আপেল এখানে স্নেহ, ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। আর ধারবাহিকভাবে মেয়েটির মুখোভঙ্গির যে-পরিবর্তন দেখানো হয়েছে তা দিয়ে নির্মাতা আসন্ন সংকটকে ইঙ্গিত করেছেন। ইভান একটি করে আপেল বাছাই করছে আর মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে। এখানে ইভানের আপেল বাছাই করা, মেয়েটির আপেলের দিকে চাহনি, বৃষ্টিপাত, সাদাগাছ সবকিছু মিলে একটা জাদুকরী দৃশ্য তৈরি হয়েছে। এটা রঙিন চলচ্চিত্র হলে স্পষ্ট হতো যে, আপেলের রং অনুযায়ী মেয়েটির ‘ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন, পরিবর্তিত হয়েছে কি না? কিংবা মেয়েটি যে-আপেলের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল সেটার রংয়ে স্নেহ-ভালোবাসার কোনো অনুভূতি প্রকাশ পায় কি না? আবার একই সঙ্গে ইভান যে আপেল হাতে নিচ্ছে সেই আপেলের রং কি? তখন বলা যায়, ইভানের আপেল পরিবর্তনের সঙ্গে মেয়েটির মুখোভঙ্গির পরিবর্তনের সম্পর্ক এবং একই সঙ্গে তাদের জীবনের পরবর্তী অবস্থারও পরিবর্তন নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে দৃশ্যটা মেটাফরিক্যাল হয়ে উঠেছে।

চতুর্থ স্বপ্ন

ইভানের মা বালতি ভরতি পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইভান দৌড়ে যায়। বালতির পানিতে চুমুক দেয়। তার মা হাত নেড়ে চলে যায়। নদীর তীরে একদল ছেলেমেয়ে লুকোচুরি খেলে। ইভান তাদের খুঁজতে থাকে। তার ছোটোবোন সশব্দে হাসতে হাসতে নদীর তীর ধরে দৌড়াতে থাকে। ইভানও সশব্দে হাসি দিয়ে বোনের পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে। একসময় ইভান বোনকে অতিক্রম করে দৌড়াতে থাকে তখন একটি মরা গাছ দেখা যায় এবং চলচ্চিত্র শেষ হয়ে যায়।

এই স্বপ্নটি ইভানের মৃত্যুর পর ঘটে। তখন প্রশ্ন জাগে, স্বপ্নটি কে দেখলো? বলা যায় যে, স্বপ্নটি দর্শক দেখলো। তখন প্রথম স্বপ্নটির স্থান আর এই স্বপ্নটির স্থান খেয়াল করা দরকার। প্রথম স্বপ্নের স্থান অরণ্য আর শেষ স্বপ্নের স্থান নদী। আবার চলচ্চিত্রটির শুরু হয় একটি স্বপ্নদৃশ্য দিয়ে আর শেষও হচ্ছে একটি স্বপ্নদৃশ্য দিয়ে। শেষ স্বপ্নে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নদীর তীরবর্তী একটি মরা গাছ। ইভানকে এই মরা গাছের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে নির্মাতা ইভানের মৃত্যুর ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফলে এখানে নিঃসঙ্গ মরা গাছের চিত্রকল্প দিয়ে মূলত ইভানের নির্মম পরিণতিই তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ‘...ইভান’স চাইল্ডহুড-এর শেষ দৃশ্যে যে মৃত, দগ্ধ, শাখাহীন শুষ্ক গাছটিকে দেখানো হয়েছে এটা যেন ওয়েটিং ফর গডোর সেই বৃক্ষের মতো, যা মনুষ্যসৃষ্ট যুদ্ধের কারণে সজীব প্রকৃতি ধ্বংসের একটি প্রতীকী চিত্র।’[৬]

ইভান’স চাইল্ডহুড চলচ্চিত্রের স্বপ্নদৃশ্য “ইভান’স চাইল্ডহুড”-এর নির্মাতা তারকোভস্কি বারো বছরের শিশু ইভানের চোখ দিয়ে যুদ্ধকে দেখাচ্ছেন। যুদ্ধের কবলে তার শিশুসত্তা যুবকসত্তার ক্রূরতায় পরিবর্তিত হয়েছে, তার স্বপ্ন বারবার ভেঙে গেছে বাস্তবতার করুণ দৃশ্যপটে, চেতন মন আর অচেতন মনের দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত তাকে তাড়িত করেছে। ইভানের এই পরিবর্তন আসলে তার মধ্যে যে-প্রাণোচ্ছ্বাস সেটাকে হত্যা করেছে। ফলে এই প্রাণোচ্ছ্বাস দেখানোর জন্য নির্মাতা বারবার ফ্ল্যাশ ব্যাক করে স্বপ্নের আশ্রয় নেন। তারকোভস্কি মনে করতেন যে, ‘বর্তমানের চেয়ে অতীত বেশি বাস্তব।’ আর তাই তিনি ফ্ল্যাশ ব্যাক করেন। এটা ইভানের অচেতন মনকে যেমন রেপ্রিজেন্টেশন করেছে তেমনি একটা প্রশ্নও তৈরি করেছে। প্রশ্নটা হলো, যুদ্ধ শেষে ইভান যদি বেঁচেও থাকতো তাহলে তার অবস্থা আসলে কি হতো? তখন এই সময়ের যুদ্ধ ও বিভীষিকাময় পৃথিবীর দিকে তাকালে ফিলিস্তিন আর সিরিয়ার দৃশ্য চোখে ভাসে। আর সেখানকার অসংখ্য বাস্তুচ্যুত, অর্ধমৃত, পিতৃমাতৃহীন শিশুকে বেঁচে থাকতে হয় শরণার্থী, বিকলাঙ্গ ও অনাথ হয়ে। ইভানের বয়েসি ফিলিস্তিনি শিশুরা যখন তাদের ওপর ইসরায়েলি দখলদার বাহিনিকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ আর হত্যা করতে দেখে তখন তারাও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে—ইসরায়েলি বাহিনির প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে। তো এখানে যদি ফিলিস্তিনি ওই শিশুদের সঙ্গে চলচ্চিত্রের ইভানকে তুলনা করা যায় তাহলে বাস্তবতা উপলব্ধি করা যাবে। ফলে ইভানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে দৃশ্যটা চলচ্চিত্রে শেষ হয়ে গেছে, সেই একই দৃশ্য আবার পৃথিবীর মঞ্চে চলছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিন কিংবা সিরিয়ায়। তখনই তারকোভস্কির “ইভান’স চাইল্ডহুড” দেশ-কাল-সীমানা অতিক্রম করে ইতিহাসকে প্রশ্ন করা শুরু করলো। তখন তারকোভস্কির এমন কালসচেতনতা সম্পর্কে জানা যায় যে, ‘তিনি সবসময়ে মনে করতেন আধুনিক মানুষের পক্ষে সিনেমা সেইরকম গুরুত্বপূর্ণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল ট্র্যাজেডি পুরাকালের মানুষের ও উপন্যাস উনিশ শতকের শিক্ষিত মানুষের কাছে। চলচ্চিত্র তাঁর কাছে ছিল যতটা না পেশাদার কর্ম তার চাইতে বেশি নৈতিক কর্ম।’[৭]

ইভানের মৃত্যু তাকে যেন একটা গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। কারণ তার হারিয়ে যাওয়া প্রাণোচ্ছ্বাস তো সে আর ফিরে পেতো না। তখন দেখা যায়, অসংখ্য ফিলিস্তিনি শিশু প্রাণোচ্ছ্বাসহীন জীবন নিয়ে পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত চলতেই থাকে। যুদ্ধে পরিবারের সবাইকে হারানো ইভান তো জানতো না যুদ্ধের কারণ। তখন প্রশ্ন জাগে, কেন এই যুদ্ধ কিংবা ধ্বংসলীলা?
পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ মানে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াই। আর এই জাতীয়তাবাদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কখনো ভাষা, কখনো ধর্ম, কখনো জাতি এইসব উপাদান বিবেচ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু এইসব উপাদান দিয়ে প্রকৃত অর্থে জাতীয়তার ধারণা নির্মাণ করা যায় না। ফলে এরা ছদ্ম-জাতীয়তাবাদের একটা রূপ নিয়ে হাজির হয়। আর শাসকেরা এটাকে ব্যবহার করে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে একটা যুদ্ধ লাগায়। আর জাতীয়তাবাদী ভাবনা যখন আন্তর্জাতিক হিংস্র রূপ নিয়ে হাজির হয় তখন সাম্রাজ্যবাদের চিত্র উঠে আসে।

এই জাতীয়তাবাদী ভাবনার পরিণাম হিসেবে আন্দ্রেই তারকোভস্কি ইভানের মৃত্যু হাজির করলেন। ইভানের রুশ বাহিনীর কাছে জার্মান বাহিনীর পরাজয় ঘটেছে ঠিকই কিন্তু ইভানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নির্মাতা একটা হাহাকার তৈরি করলেন। আর এটা ইভানের মধ্যে জীবিতাবস্থায় তার স্বজন হারানোর ভেতর দিয়ে যেমন উঠে এসেছে তেমনি বিজয়ী হওয়ার পরেও ইভানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তরুণ লেফন্যান্টের চেহারায় দুঃখ আর হাহাকারের চিত্র ফুটে উঠেছে। ফলে তার চোখে ইভানের ফাঁসির দৃশ্য পর্যন্ত ভেসে ওঠে। এখানেই নির্মাতা তারকোভস্কি যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতাকে হাজির করলেন। অর্থাৎ যুদ্ধে নিকটজন হারানোর যে-ক্ষত তাতে কখনওই যুদ্ধ জয়ের আনন্দ দিয়ে প্রলেপ দেওয়া যায় না। ফলে প্রশ্ন জাগে, দর্শক কি ইভানের মৃত্যু মেনে নিতে পেরেছে?

“ইভান’স চাইল্ডহুড”-এ নদী, নারী, বৃক্ষ, বৃষ্টি এইসব অনুষঙ্গ দিয়ে তারকোভস্কি দৃশ্যের পর দৃশ্য কাব্যময় করে তুলেছেন। এ-প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রের মাশা নামের নার্সের চরিত্রটির কথা আলোচনা করা যাক। “ইভান’স চাইল্ডহুড” চলচ্চিত্রের যে-কাহিনি সেখানে যদি মাশা চরিত্রটি অনুপস্থিত থাকতো তাহলে কি কাহিনির কোনো হেরফের হতো? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মাশার সঙ্গে চলচ্চিত্রের মূল কাহিনির সম্পৃক্ততা নাই কিন্তু তারকোভস্কি এই চরিত্রটিকে নিয়ে একটি চুম্বন দৃশ্য নির্মাণ করলেন—যা চলচ্চিত্রটির যুদ্ধের কাহিনিতে বিসদৃশ মনে হতে পারে। কিন্তু তারকোভস্কির কাব্যিক মন উদ্দেশ্য নিয়েই সেটা করেছে। আর এটার মূলে আছে সেই বার্চ বন। প্রথমত, মাশার যে সারল্যমাখা চেহারা সেটার সঙ্গে বার্চ বনের একটা সাদৃশ্য আছে। ফলে সারি সারি সাদা বার্চ গাছের মধ্যে দাঁড়িয়ে যখন আর্টিস্ট সুরিকভ আর লেখক টলস্টয়ের নাম আসে তখনই পরিবেশটাকে কাব্যিক করে তোলার ইঙ্গিত দিয়ে দেন নির্মাতা। যদিও বার্চ বন যুদ্ধক্ষেত্রের একটা অংশ কিন্তু ওই মুহূর্তে এটাকে কোনোভাবেই যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বোঝার উপায় থাকে না, একটা ফ্যান্টাসির জগৎ মনে হয়। যেখানে অফ ভয়েসে একটা কাঠঠোকরার আওয়াজ চলতে থাকে। কাঠঠোকরার আওয়াজের সঙ্গে তুলনা করে মাশার বুকের ভেতর যে ডিবডিব স্পন্দন চলছে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারপর মাশা যখন একটা হেলানো গাছের ওপর হেঁটে বেড়ায় তখন তাকে প্রজাপতির মতো লাগে। নির্মাতা দৃশ্যটাকে চলচ্চিত্রের নান্দনিকতার দৃষ্টি থেকে যেমন উপস্থাপন করেছেন একই সঙ্গে সেটা কাব্যিকও হয়ে উঠেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে মাশাকে ক্যাপ্টেনের চুম্বন করার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে নির্মাতা প্রেমের একটা আবহ তৈরি করলেন। দৃশ্যটা খুব ভালোভাবে খেয়াল করা দরকার : দৃশ্যটির শুটিং শুরু হচ্ছে লো পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। আর মাশা যখন লাফ দিয়ে নালাটা পার হতে যায় তখন ক্যাপ্টেন তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে শূন্যে তুলে ধরে চুম্বন শুরু করে। ক্যামেরা তখন নিচে নামতে থাকে ও ভূমির সমতলে চলে আসে এবং নালাসহ দৃশ্যটি ধারণ করে। তারপর সুক্ষ্নভাবে ক্যামেরা চরিত্রের চোখ বরাবর উঠে আসে। একেবারে সুনসান একটা পরিবেশে এই দৃশ্যটা দিয়ে যেন একটা কাব্য রচিত হয়ে গেল। বার্চ বনে মাশা ও ক্যাপ্টেন

যদিও “ইভান’স চাইল্ডহুড” চলচ্চিত্রের বিষয় যুদ্ধ কিন্তু তার মধ্যেও সারি সারি বার্চ গাছ, নদীর তীরে বাচ্চাদের খেলার দৃশ্য, রাতের নদীতে হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানি, নদীর তীরে লরি থেকে আপেল পড়তে থাকার দৃশ্যগুলো কাব্যিক ইমেজ নিয়ে হাজির হয়েছে।

‘My purpose is to make films that will help people to live, even if they sometimes cause unhappiness.’ তারকোভস্কির এই কথার মধ্যেই তার আধ্যাত্মিক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। এই যে, চলচ্চিত্রের মধ্যে জীবনের খোঁজ করা—এটা তারকোভস্কির চলচ্চিত্রে সরাসরি বাস্তবতা না-তুলে ধরে কিছুটা আধ্যাত্মিকচেতনা, কিছুটা ইতিহাসচেতনা, কিছুটা সমকালকে ধরে উঠে আসে। ফলে জীবনকে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি তাকে শুধু বহির্র্দৃষ্টিতে আবদ্ধ না করে অন্তর্দৃষ্টির মধ্য দিয়েও দেখানোর চেষ্টা করেছেন তার চলচ্চিত্রে। এ-প্রসঙ্গে “ইভান’স চাইল্ডহুড”-এর প্রথম স্বপ্নটির দুইটি দৃশ্য নিয়ে বলা যাক। প্রথম দৃশ্যে একটি গাছকে নিচ থেকে একেবারে মাথা পর্যন্ত সূক্ষ্মভাবে দেখানো হচ্ছে। এই গাছ দেখানোকে যদি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে পাওয়া যাবে—গাছটি একই সঙ্গে মাটি ও আকাশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে। ফলে তার নিচের অংশটা মাটিতে আর উপরের অংশটা আকাশমুখী। আর এই আকাশটা হচ্ছে উন্মুক্ত। আবার এই স্বপ্নের আরেক দৃশ্যে গাছের পাতা ভেদ করে তির্যকভাবে রশ্মি যখন ইভানের মুখে এসে পড়ে তখন ওই গাছের আকাশমুখী হওয়ার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। অর্থাৎ গাছটি যে আকাশের দিকে যেতে চায় সেই আকাশ থেকে আসা রশ্মি চায় নিচের দিকে আসতে। এই যে পারস্পরিক একটা সম্পর্ক এটাকেই তারকোভস্কি জীবনের আনন্দ বলেছেন। তখন বলা যায়, ‘বাস্তব ও বাস্তবাতীতের, লিরিকাল ও এপিকের, বিশ্বজগৎ ও মনোজগতের মিলন ও সমন্বয়ে তারকোভ্স্কির চিত্রলোক এক অপূর্ব ও অসামান্য জগৎ...।’[৯]

আন্দ্রেই তারকোভস্কি “ইভান চাইল্ডহুড”-এ স্বপ্নের জগৎকে যেমন দেখিয়েছেন তেমনি দেখিয়েছেন নৃশংস বাস্তবতা। বারো বছর বয়েসি এক বালকের সারল্য আর ফ্যান্টাসি দেখার যে-চোখ তা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেছে। পৃথিবী তার কাছে এক বীভৎস রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে। ফলে পৃথিবীর রূপ থেকে নিজেকে সরিয়ে সে যতই স্বপ্নের মায়াময় জগতে নিজেকে আবদ্ধ করতে চায় ততবারই তার স্বপ্নের জগতে হানা দেয় বন্দুক আর বোমার আওয়াজ।

 

তথ্যসূত্র

১. www.nostalghia.com. Retrieved 24 May 2018

২. আরিফ, রুদ্র (অনূদিত) (২০১২ : ৭-৯); ‘যে কবি পেয়েছিলেন দেবদূতের দেখা’; তারকোভস্কির ডায়েরি; ঐতিহ্য, ঢাকা;

৩. জোরকায়া, এন (২০০৬ : ২৩০); ‘অঁদ্রে তারকোভ্স্কি’; চলচ্চিত্র অভিধান; সম্পাদনা : ধীমান দাশগুপ্ত; বাণীশিল্প, কলকাতা;

৪. প্রাগুক্ত; জোরকায়া (২০০৬ : ২৩০);

৫. প্রাগুক্ত; জোরকায়া (২০০৬ : ২৩০);

৬. https://offscreen.com/view/ivans childhood the tree of life;

৭. প্রাগুক্ত; জোরকায়া (২০০৬ : ২৩১);

৮. প্রাগুক্ত; জোরকায়া (২০০৬ : ২৩১);

৯. প্রাগুক্ত; জোরকায়া (২০০৬ : ২৩১)।

 

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা