X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও অতঃপর

আবদুল মান্নান
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৮:১১আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৮:১২

আবদুল মান্নান বহুল-প্রত্যাশিত ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গলো গত  ১ ফেব্রুয়ারি। আগামী পাঁচ বছর ঢাকাবাসীর সেবার জন্য দুই জন মেয়র, ১২৭ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৪১ জন নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচনে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। এই দুই দল থেকে যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাদের মধ্যে উত্তরের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম সাবেক মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দশ মাস মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী, নির্বাচনের আগে তার তেমন একটা রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তাবিথ আউয়াল গতবারও একই প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেলা এগারোটায় কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন হতে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ তিনি ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিলেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ২০১৫ সালে বিএনপি একই কাণ্ড করেছিল। বিএনপির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যে একেবারেই শূন্যের কোটায়, তা তাদের নানামুখী কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে।  অনেকে রসিকতা করে বলে থাকেন বিএনপি এখন কিছু সংখ্যক ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ নেতার হাতে জিম্মি হয়ে আছে। এই নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং যারা বিজয়ী হয়েছেন, তাদের সবাইকে অভিনন্দন।

বিএনপিকে বিশেষ অভিনন্দন, তারা নির্বাচনের ফল কী হতে পারে, তা জানার পরও এই নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রার্থী দিয়েছে। কাউন্সিলর পদে আনুষ্ঠানিকভাবে  তাদের কোনও প্রার্থী ছিল কিনা, জানা যায়নি। তবে, অনেক ভোটকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কেউ কেউ নিজেদের বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবে, এমন ঘটনাও ঘটেছে, যেখানে একই ওয়ার্ডে একই পরিবার থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীও ছিলেন।

এই দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছু বিষয় নিয়ে নানা দিকে আলোচনা হচ্ছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে ইভিএম মেশিনে ভোটগ্রহণ ও দ্বিতীয়টি নির্বাচনে ভোটারের কম উপস্থিতি নিয়ে। এই দু’টি বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, দেশের ও দেশের বাইরের মিডিয়া সবাই নানামুখী বিশ্লেষণ, আলোচনা, সমালোচনা করেই চলেছেন। এটি আরও কিছুদিন চলবে কারণ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিপ্রিয় মানুষের সামনে আলোচনার অন্য কোনও ইস্যু নেই।  দেশে ইভিএমের সাহায্যে জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি ও এর বিশ্বাস যোগ্যতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অনেক দিন ধরে চলে আসছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে ব্যালট কাগজে ছাপ দিয়ে মানুষ ভোট দিতে অভ্যস্ত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার রেওয়াজ আছে। বাংলাদেশে এই পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে কয়েক বছর আগে। শুরু থেকেই এই যন্ত্র নিয়ে বিএনপি ও তাদের সমমনা দল ও ব্যক্তিদের মধ্যে যারা বিরোধিতা করে এসেছেন, তাদের ধারণা এতে ভোট কারচুরি যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। তারা এ-ও বলেছেন, এই যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট দিলে একজনের ভোট অন্যজনের ঘরে গিয়ে পড়তে পারে। যারা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, তারা নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যে, এটি সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রত্যেকটি যন্ত্র একক এবং তার সার্ভারও তার ভেতরে। বিএনপি শুরু থেকেই সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, এই যন্ত্র দিয়ে ভোট দিলে তাদের বিজয় ছিনতাই হয়ে যাবে। শুরু থেকেই তারা নিজেদের একটি পরাজয়ের বলয়ে ফেলে দিয়েছে। এতে তাদের নিজ দলের সমর্থকরাও হতাশ হয়ে ভোট দিতে যাননি। বিএনপির একজন দায়িত্বশীল প্রেসিডিয়াম সদস্য দায়িত্বহীনভাবে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ঢাকার বাইরে থেকে ত্রিশ লাখ সন্ত্রাসীসহ মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র ঢাকায় নিয়ে এসেছে। এতে তারা মানুষের মাঝে ভীতি সৃষ্টি করে দিয়েছে।

নির্বাচনের পরদিন আমি নিজে প্রায় বিশজন ভোটারের কাছে জানতে চেয়েছি, তারা ভোট দিতে গিয়েছেন কিনা। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষিত ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ‘আই হেইট পলিটিক্স ব্যাক প্যাক জেনারেশন’ এবং  দুই-একজন গৃহবধূ ও বাড়ির কাজের লোকের কাছে জানতে চেয়েছি তারা ভোট দিতে গিয়েছেন কিনা। একজন ছাড়া সবাই বলেছেন, তারা কেউ যাননি। কেন যাননি? নানা রকমের উত্তর। ‘আই হেইট পলিটিক্স’ জেনারেশন বলেছে, সরকার যখন আওয়ামী লীগের, তখন এই ভোটের কোনও অর্থ নেই। কারণ মানুষ এমনিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভোট দেবে। একজন কট্টর বিএনপি সমর্থক। উত্তরের ভোটার। তিনি জানালেন, সাদেক হোসেন খোকা হলে তিনি তাকে ভোট দিতে যেতেন। তার ছেলে যার রাজনীতিতে  কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। নিজে ভোটার হয়েছেন সেই দিন মাত্র, তাকে ভোট দিয়ে কী হবে? দু’জন মহিলা জানালেন, তারা শুনেছেন, ভোট দিতে গেলে জান নিয়ে ফেরা মুশকিল হবে। কারণ, সেখানে তুমুল মারামারি হবে। কী দরকার ভোট দিতে যাওয়ার? আর এটা তো কোনও জাতীয় নির্বাচন নয়। দক্ষিণের একজন বিএনপি সমর্থক বললেন, তাবিথ আউয়াল ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ আছে। অন্য কোনও প্রার্থী হলে ভোটকেন্দ্রে যেতাম। একজন জানালেন, তিনি উত্তরার ভোটার। তিনি এখন থাকেন ধামনন্ডিতে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ। তার প্রশ্ন—‘কী করে উত্তরা যাবো?’ তার বাসায় পাঁচ জন ভোটার। একেক জন একেক কারণ বললেন। ড. কামাল হোসেন চেষ্টা করছেন বিএনপিকে নতুন জীবন দিতে। তিনি কষ্ট করে ভোট দিতে গিয়েছেন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ। তার পোলিং বুথ দ্বিতীয় তলায়। তার পক্ষে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ভোট দেওয়া কঠিন। অন্যদের সহায়তায় তিনি ওপরে উঠে ভোট দিয়ে একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় দিয়েছেন, যা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র অনেক নেতা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

২০১৫ সালের কথা। চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বেলা বারোটা নাগাদ বিএনপি ঘোষণা করলো, তাদের প্রার্থী মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। কারণ, তাদের ভাষায় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হচ্ছে। কোনও ইভিএমএ নয়, ব্যালট পেপারে ভোট হচ্ছে। একজন আওয়ামী লীগের বড় মাপের নেতা, যিনি আবার দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, তার কাছে জানতে চাই—তিনি ভোট দিয়েছেন কিনা? বললেন, না। দেননি। কারণ, বিএনপি তো এই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। তখন বেলা একটা। বলি, তা তো আপনার কাছে নিজের ভোটটা দেওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। পরে আমার জোরাজুরিতে তিনি ভোট দিতে গিয়েছিলেন। ড. কামাল হোসেন ও আরও অনেকেরই ইভিএমে ভোট দিতে গেলে আঙুলের ছাপ দিতে পারেন না। আমি নিজেও তার একজন। মানুষের বয়স হলে তা হওয়াটা স্বাভাবিক। যে মানুষ ইটের ভাটায় কাজ করে অথবা রাজমিস্ত্রি তাদের আঙুলের ছাপ ইভিএমে সাধারণত কাজ করবে না। কারণ, কাজ ও বয়সের কারণে আঙুলের ছাপ মুছে যাবে। তার জন্য বিকল্প হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ড। ড. কামাল হোসেন তা ব্যবহার করেছেন। বিএনপি ও নাগরিক ঐক্য এটিকে ইস্যু করার চেষ্টা করেছে। তারা দেশের সব মানুষকে বোকা ভাবেন। ড. কামাল হোসেন ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন ভোটাররা এই নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি বলে উপস্থিতি  এত কম। তিনি গ্রহণ করেছেন বলে তিনি ভোট দিতে এসেছেন। তাকে আবারও ধন্যবাদ।

এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১১১ জন কাউন্সিলর বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। এতে প্রমাণ করে দলের ভেতর শৃঙ্খলার প্রচণ্ড অভাব। এটি দলের জন্য একটি অশনিসংকেত। মনে রাখতে হবে, তারেক রহমান যতদিন বিএনপি’র প্রধান, ততদিন বিএনপি সব নির্বাচনে অংশ নেবে। কারণ, লন্ডনে বিলাসী জীবনযাপন করতে হলে তার অনেক টাকা প্রয়োজন। সামনের মার্চ মাসে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সেই নির্বাচনেও বিএনপি অংশ না-নেওয়ার কোনও কারণ নেই। আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন থেকে সতর্ক না হলে আগামীতে বড় ধরনের বিপর্যয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেশ কিছু কেন্দ্রে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এই সবই হয়েছে আওয়ামী লীগের মূল প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে। তারা একে অন্যের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়েছে। বিএনপি প্রচার করেছে, তাদের ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির হাতে কোনও ইস্যু না থাকলেও আওয়ামী লীগের কিছু অপরিণামদর্শী নেতাকর্মী কোনও একটি কথা বলে বা অপকর্ম করে তাদের হাতে একটা ইস্যু তুলে দিতে কার্পণ্য করেন না। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই কমিশনের যারা সদস্য হন, তাদের কথা বলার সময় অনেক বেশি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন। কমিশনের সচিবের আগ বাড়িয়ে কথা বলা একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এটি তাকে বুঝতে হবে।

ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে দুই বড় দলেরই শেখার আছে অনেক কিছু। বিএনপিকে বুঝতে হবে, যতদিন তারেক রহমান লন্ডনে বসে রিমোট কন্ট্রোলে দল পরিচালনা করবেন আর তাদের দলের বড় বড় নেতারা ঢাকায় বসে ‘জি হুজুর’, ‘জি হুজুর’ করবেন ততদিন বিএনপির কোনও ভবিষ্যৎ নেই। বিএনপি  এখন একটি অস্তগামী সূর্য। আর আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা বর্তমানে খুবই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। তাকে ঠিক করাটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করতে পারেন, তাদের এখন সুখের সময়। কিন্তু সাবধান না হলে সুখের সময় দীর্ঘস্থায়ী হবে  না।

লেখক: বিশ্লষক ও গবেষক

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ