X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা ও অন্তহীন বিতর্ক

মো. সামসুল ইসলাম
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:১২আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:৩৯

মো. সামসুল ইসলাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিতর্ক যেন থামছেই না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) আহ্বানে দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় রাজি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে না বলে জানিয়েছে। যার প্রভাব অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এটা নিয়ে শিক্ষাবিদসহ শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ দৃশ্যত দুই ভাগ হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে গণমাধ্যমে যেসব লেখা পড়ছি বা আলোচনা শুনছি তা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষেই বলা যায়।
আমার কাছে এখন সবার বিরোধিতার ব্যাপারটি সবচেয়ে অবাক লাগছে। বেশ কয়েক বছর থেকে আমরা দেখছি শিক্ষক, সুশীল সমাজ এবং অভিভাবকদের একাংশ এবং কোনও কোনও ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সপক্ষে উচ্চকণ্ঠে কথা বলছে। তাদের উদ্দেশ্যকে কেউ খারাপ চোখে দেখেননি, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির অবসান চাইছিলেন তারা। তখন এর বিরুদ্ধে কিন্তু খুব বেশি বক্তব্য শোনা যায়নি। অন্তত এখনকার মতো এত সরব বিরোধিতা ছিল না। যদিও আমার মনে পড়ে গুটিকয়েকজনের মতো আমি আমার এক লেখায় ক্ষীণস্বরে বলেছিলাম, বিকেন্দ্রীকরণের যুগে শিক্ষাঙ্গনের সবকিছুকে কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা ভালো ফল নাও দিতে পারে। 

কিন্তু নীতিনির্ধারকরা যখন সত্যিই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন আমরা দেখছি এর বিপক্ষে অনেকেই অবস্থান নিচ্ছেন। ইউজিসিকে বারবার এর পক্ষে যুক্তিগুলো তুলে ধরতে হচ্ছে। মেডিক্যাল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে মোটামুটি সাফল্য তাদের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে যে উৎসাহিত করেছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

যতদূর জেনেছি ইউজিসি এই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারটি সুপারভাইজ করবে। পুরোপুরি পরিষ্কার না হলেও পত্রপত্রিকা পড়ে এটুকু বুঝতে পারছি, শিক্ষার্থীদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার স্কোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের স্ব-স্ব চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবহার করতে পারবে বলে ইউজিসি জানাচ্ছে।   

আমি আমার একটা লেখায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টের কথা বলেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে ভর্তির জন্য রেজাল্ট ইত্যাদির সঙ্গে ACT, SAT, TOEFL ইত্যাদি স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টের স্কোর দেখা হয়। আর গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে রেজাল্টের সঙ্গে দেখা হয় GRE, GMAT ইত্যাদির স্কোর।

ইউজিসির ভর্তি পরীক্ষার স্কোর ব্যবহারের পরামর্শকে আসলে এক ধরনের স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টেরই ছায়া বলা যেতে পারে। তবে এটা পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগের জন্য সময় প্রয়োজন। আমার মনে হয় সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যে এই পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। যেমন এটাকে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টগুলোর মতো করে ফেলা যায়। কমন কিছু প্রশ্নপত্রের পাশাপাশি সাবজেক্ট টেস্টও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বছরে একবারের জায়গায় একাধিকবার এ পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এবং এই স্কোর ব্যবহারের কার্যকাল দুই বছর বা তিন বছর করে দেওয়া যায়। শুধু পাবলিক নয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির ক্ষেত্রে এই স্কোর ব্যবহার করতে পারবে।   

এটি আমার একেবারেই ব্যক্তিগত মতামত। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা আছেন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। 

বলাবাহুল্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এতো আলোচনা হচ্ছে যে এর পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিগুলো মোটা দাগে আমরা জানি। একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন মানের বিভিন্ন বিষয়ের ভর্তি পরীক্ষায় একই প্রশ্নপত্র ব্যবহার, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকলের ঝুঁকি ইত্যাদি ব্যাপারে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট দিনে কোনও শিক্ষার্থী যদি কোনও অসুবিধায় পড়ে, যেমন অসুস্থ থাকে, তাহলে তার সেই বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে। অন্য কোনও সুযোগ আর হাতে থাকবে না। 

তবে এটা অস্বীকার করা যায় না, এই সমস্যাগুলো কাটিয়া ওঠা সম্ভব। একটি শক্তিশালী সংস্থার অধীনে স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টের মতো বছরে একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার বিধান থাকলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্ত স্কোর যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেমিস্টার পদ্ধতিতে বছরে দুই বা তিনবার শিক্ষার্থী ভর্তি করে। তারাও ইচ্ছা করলে ভর্তির ক্ষেত্রে এই স্কোর ব্যবহার করতে পারবে। এখন অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সেমিস্টার পদ্ধতি অনুসরণ করছে। তারা বিদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বছরে একাধিকবার এই স্কোর ব্যবহার করে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে। এতে অন্তত দীর্ঘমেয়াদে কোনও আসন শূন্য থাকবে না।  

আমি যেটা বলছি সেটা একটি ধারণা মাত্র। আসলে আমরা শিক্ষাব্যবস্থার আন্তর্জাতিকীকরণের কথা বললে আমাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ও পরীক্ষিত পদ্ধতিগুলোই অনুসরণ করতে হবে। 

বলাবাহুল্য, শিক্ষা বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। এটা ঠিক, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে-বিপক্ষে গণমাধ্যমে যেসব যুক্তি আসছে তা গবেষণালব্ধ কোনও ধারণা নয়। এই ভর্তি পরীক্ষার দোষগুণ বা আর্থসামাজিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা হলে অনেক নতুন তথ্য বের হয়ে আসবে।

একটি উদাহরণ দেই। বছর দুই-তিনেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর বলে পরিচিত বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন একটি শহর রাজশাহীতে আমি বেড়াতে যাই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেখানে কোনও ভালো হোটেলে আমি সিট পেলাম না। জানলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুরা সেখানে এসেছে ভর্তি পরীক্ষা দিতে, তাই হোটেলের সব সিট মোটামুটি বুকড। আমি জানলাম, রাজশাহীতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণে হোটেলগুলো ভালো ব্যবসা করে, শিক্ষার্থীরা অনেক কেনাকাটা করে। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেখানে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কারণে তাদের ব্যবসা কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ বাইরের শিক্ষার্থীরা আর সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসবে না। এরকম অনেক শহরেই ঘটবে। ব্যবসার এই ব্যাপারটি ভালো বা খারাপ তা আমি বলছি না। কিন্তু এটি ব্যাপক আর্থসামাজিক প্রভাবের একটি উদাহরণ মাত্র। 

আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক আমাকে জানালেন তিনি গত কয়েক বছর থেকে তার বিভাগের শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক অবস্থানেরও একটি পরিবর্তন লক্ষ করছেন। আগে দেখা যেতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা তার বিভাগে ভর্তি হতো। এখন সে জায়গায় শহুরে শিক্ষার্থীরা বেশি আসছে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ফলে যেটা হবে শহরের শিক্ষার্থীরা ঢাকার বাইরের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ ছাড়বে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আগে ঢাকার অনেক শিক্ষার্থী হয়তো রংপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেতো না। এর ফলে সেই এলাকার শিক্ষার্থীরা সেখানে একটু সহজে ভর্তির সুযোগ নিতে পারতো।

কিন্তু এখন দেখা যাবে যে বড় শহরের শিক্ষার্থীরা তার এলাকায় বসেই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো সহজে ভর্তির সুযোগ পাবে এবং সেই সুযোগ তারা গ্রহণ করবে। এর ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। খারাপ দিকটি হলো এলাকাভিত্তিক শিক্ষার্থীরা তাদের পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হারাবে। আমি নিজেই দেখেছি ঢাকার অনেক শিক্ষার্থী ঢাকার কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেলে দূরে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়াকে ঝামেলা মনে করে এবং ঢাকার এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ব্রিটেনে অবস্থানরত এক সাংবাদিক বন্ধু জানালেন এ সমস্যার জন্য সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থানীয়দের জন্য নাকি কিছু আসন বরাদ্দ থাকে। মোটকথা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ফলে প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভর্তির চলমান প্রবণতার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হবে। এসব বিষয় চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। 

যেহেতু বুয়েট তাদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগদানও অনিশ্চিত, তাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে এই মুহূর্তে মন্তব্য করা বেশ কঠিন। এটা ঠিক যে সমাজের একশ্রেণির শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের আগ্রহে নীতিনির্ধারকরা এই পদ্ধতিতে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। এখন আবার অনেকেই রাজি হচ্ছেন না। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন এটি নিয়ে বিতর্কের অবসান। সেই সঙ্গে দরকার কীভাবে ভর্তি পদ্ধতিকে সহজ, নিখুঁত ও আন্তর্জাতিক মানের করা যায় সে বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণা। 

লেখক:কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]                      

        

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ