X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘কোভিডিয়টস’ কিংবা ‘করোনাগাধা’দের কথা!

মাহমুদ মেনন
১২ এপ্রিল ২০২০, ১৭:১৯আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২০, ১৭:২২

মাহমুদ মেনন ‘কোভিডিয়টস’ শব্দটা খুব মনে ধরেছে। কোভিড-১৯ এর সময়কালের ইডিয়টদের বোঝানো হয়েছে এই শব্দে। কারা এই ইডিয়টস। যারা লকডাউন উপেক্ষা করে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এখানে সেখানে যায়। বাংলাদেশের কথায় পরে আসি। শুনতে পেলাম অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের এক মন্ত্রী কোভিড-১৯ এর মধ্যে নিজের বাগানবাড়ি গিয়েছিলেন গাড়ি চেপে। তো পুলিশ সে খবর পেয়ে ছুটে যায় সে বাড়িতে। মন্ত্রীকে ১ হাজার ডলার জরিমানা করে, সরকারের আদেশ অমান্য করার জন্য। মন্ত্রী মহোদয় তো লজ্জায় একশেষ। শেষমেশ কী করবেন, মুখ বাঁচাতে পদত্যাগই করে বসলেন। রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ান সে পদত্যাগ গ্রহণ করে নিতে একদণ্ডও দেরি করেননি। পূর্ব সিডনির বাসভবন থেকে মোটে ঘণ্টাখানেকের গাড়িপথ পাড়ি দিয়ে শিল্পকলামন্ত্রী ডন হারবিন গিয়েছিলেন সেন্ট্রাল কোস্টে নিজের মিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল অবকাশযাপন কেন্দ্রে। আহা বেচারা!
ব্রিটেনের খবর দিয়েছে ডেইলি মেইল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে—একদল ‘কোভিডিয়টস’ সমুদ্রতীরে উদোমগায়ে সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি খাচ্ছে! ইস্টারসানডের ছুটিতে আমুদে দিনগুলোর কথা এরা ভুলতেই যেন পারছে না। আর যায় কোথায়? পুলিশ গিয়ে একেকটাকে গিয়ে ধরে এনে জেলে পুরেছে। আর সমুদ্রতীরে পুলিশ টহল ও কোস্টগার্ডদের টহল বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই যে পইপই করে বলা হচ্ছে—ঘরে থাকাটাই এখন প্রধান দায়িত্ব। নিজেকে যত স্বেচ্ছাবন্দি করে রাখা যাবে, ততই নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে ঘাতক ভাইরাস কোভিড-১৯ থেকে। তা কে শোনে কার কথা! ‘কোভিডিয়টস’রা নিজের বুদ্ধিহীনতায় নিজেদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অন্যকেও ঝুঁকিতে ফেলছে।

হুজুগে বাঙালিরা বোধ করি এই কাজে সবচেয়ে পটু। উৎসুক জনতা শব্দটি বাংলায় রয়েছে। অন্য ভাষায় এর প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া ভার। ইংরেজিতে অনলুকার বলে একটা শব্দ আছে বটে। তা যারা ওই পথ দিয়ে যায়, তারা থমকে গিয়ে তাকায়। কিছুক্ষণে যে যার পথে লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটতে থাকে। কিন্তু বাঙালি তো ষোলোআনা উৎসুক। তাদের উৎসাহের তেজ এত বেশি যে ঘটা করে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিড় জমায়। সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে মূলধারায়ও কিছু ঘটনা-ছবি এসব আসছে এ নিয়ে। তার একটি ছবিতে দেখতে পেলাম বাসাবোতে একটি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। সে খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার পর উৎসুক জনতা বাড়িটি দেখতে ভিড় জমিয়েছে। কী ব্যাখ্যা আছে এর। কী-ই-বা বলা যাবে একে। বাড়িটি থেকে কেউ বের হতে পারবে না এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তো মানুষ দেখতে এসেছে সে বাড়ি। এখন তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। কারা থাকে এই বাড়িতে? বাড়িটি কয় তলা? কোন তলায় কে থাকে? কে হয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত? প্রত্যক্ষ করতেই যেন হবে। না জানলে ঘুম হবে না। আর প্রত্যক্ষ করেই তো শেষ নয়, সে তথ্য আবার জনে জনে বিলোতেও হবে।

বাঙালির চরিত্রেই রয়েছে এমন আচরণের বীজ। গল্প সিনেমা উপন্যাসে এমন চরিত্রের অনেক বিবরণও আমরা পেয়েছি। মুজতবা আলীর পন্ডিত মশাইয়ের পদ্মলোচন যেন একেকজন। পাকা খবর তার চাই-ই চাই। তো কী হয়েছে? সে না হয় থাকুক একটু উৎসাহ-ঘটনা দুর্ঘটনায়। কিন্তু বিষয়টি যখন মহামারির! বিষয়টি যখন ছোঁয়াচে তখন তো আর এসব চরিত্রের দোহাই দিলে চলবে না। এখন আমাদের সতর্কই হতে হবে। আমাদের সামাজিকভাবে, শারীরিকভাবে দূরেই থাকতে হবে।

নারায়ণগঞ্জের একটি ভিডিওচিত্র এসেছে সংবাদমাধ্যমে। ছইঅলা নৌকায় গাদাগাদি করে মানুষ পার হচ্ছে নদী। এপার ওপার করছে। কেন যাচ্ছে তারা ওপার, কিংবা আসছে এপারে? সে প্রশ্নের উত্তর নেই অধিকাংশের কাছেই। এইসব ‘কোভিডিয়টস’র মধ্যে একজন মিললো—‘গাধা’দেরও সেরা ‘গাধা’। বীরপ্পনের মতো ইয়া গোঁফ। তো সেই সাহসী বীর বললেন, ‘ওই পাড়ে যাইতে হইবো না! মানুষগুলার লগে দেহা করন লাগবো না! মইরা থাহে না বাইচা থাহে! মইরা গেলে কী আর দেখতে পারুম!’

সত্যিই তো! মরে গেলে তো আর দেখা যাবে না। করোনাভাইরাস আক্রান্ত কারও মৃত্যু এখন এক চরম অভিশাপ। যে মানুষটি মারা যায়, তার কাছেও কেউ ঘেঁষতে চায় না। পরিবারের মানুষও নয়। সেটাই স্বাভাবিক। যদিও খবর বেরিয়েছে করোনাভাইরাসে মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়িয়েছে এমন তথ্য এখনও মেলেনি। তবে এমনটা মোটেই প্রমাণিত নয় যে, মৃতদেহ থেকে ভাইরাসটি ছড়ায় না, সুতরাং দূরত্ব বজায় রাখাই সঠিক।

কিন্তু আমরা যে সামাজিক দূরত্বের কথা বলছি, তা কতটুকুই আর নিশ্চিত করতে পারছি। আমাদের বীরাপ্পনেরা ছুটছেন, মরার আগে একটু দেইখা আসতে!

আর ত্রাণের নামে যা হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। ত্রাণ দেওয়া ও নেওয়ার মধ্য দিয়ে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে সামাজিক কিংবা শারীরিক দূরত্বের সকল তত্ত্ব। ছয় ফুট দূরত্ব তো দূরের কথা, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মানুষগুলো জড়ো হচ্ছে ত্রাণের প্রত্যাশায়। একটি ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে দেশের কোনও একটি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন থেকে দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ সহায়তা। তো যারা ত্রাণ নিতে আসছেন, তারা যেন ত্রাণদাতার সঙ্গে ছবি তুলে যান, সেটা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সে ছবি তোলার নামে ছয় ফুট দূরত্ব আধাফুটে নেমে আসছে। আর ত্রাণদাতা ঠিকঠাক ছবির জন্য নারীর গায়ের ওড়না টানাটানিও করছেন। পুরুষদের একে ধমকাচ্ছেন, ওকে টানছেন তাকে ঠেলছেন।

যিনি ত্রাণ দিচ্ছেন তিনি নিজেই তো হতে পারেন এরইমধ্যে ভাইরাসটি বহনকারী। কেউ জানে না। অতএব যদি হয়েই থাকেন তার ছোঁয়ায় অন্তত ২৫-৩০ জন নরনারী ত্রাণ নিতে এসে, এবং তার অব্যবস্থাপনার কারণে হয়ে যেতে পারেন এই ভাইরাসের শিকার। অথবা এদের মধ্যে কেউ যদি হয়ে থাকেন এরই মধ্যে করোনাভাইরাস এক্সপোজড, তাহলে এই ত্রাণদাতা স্রেফ নিজের অসচেতনতায় নিজেকেই ফেলে দিলেন ঝুঁকিতে। তার হাতে ছিল না গ্লাভস, মুখে ছিল না মাস্ক। সে অর্থে বেজায় সাহসী। আর মাস্ক থাকলে ছবিই বা হবে কী করে? তো—এই ত্রাণদাতাকে আপনি কী বলবেন? ‘কোভিডিয়ট’।

ইশ! একটা যুৎসই বাংলা শব্দ মাথাতেই আসছে না। ইংরেজি ব্যাকরণে এ ধরনের শব্দকে বলে পটম্যানটো। বাংলা ব্যাকরণে কী বলে জানি না। তবে সুকুমার রায় হলে হাঁসজারু কিংবা বকচ্ছপ গোছের কিছু একটা নাম ঠিকই দিতে পারতেন। আমি বলবো এরা করোনাকালের ‘গাধা’। কিংবা ‘করনোগাধা’। নাম তো দিলাম। ভাবছি পাছে গাধারাই আবার মাইন্ড করে না বসে!

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউআইইউতে ‘বাংলাদেশের সংবিধান এবং এর শাসন কাঠামো’ শীর্ষক লেকচার অনুষ্ঠিত
ইউআইইউতে ‘বাংলাদেশের সংবিধান এবং এর শাসন কাঠামো’ শীর্ষক লেকচার অনুষ্ঠিত
পাট শিল্পের উন্নয়নে জুট কাউন্সিল গঠন করা হবে
পাট শিল্পের উন্নয়নে জুট কাউন্সিল গঠন করা হবে
ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টা মামলায় মাদ্রাসাশিক্ষকের ১০ বছরের কারাদণ্ড
ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টা মামলায় মাদ্রাসাশিক্ষকের ১০ বছরের কারাদণ্ড
রেসিপি: মসুরের ডাল দিয়ে হাতে মাখা পুঁই শাক
রেসিপি: মসুরের ডাল দিয়ে হাতে মাখা পুঁই শাক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ