X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অবাধ তথ্য প্রবাহ গুজব ঠেকাবে

ডা. জাহেদ উর রহমান
৩০ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৩২আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৩৪

 



ডা. জাহেদ উর রহমান ‘লি ওয়েনলিয়াং’ নামটি কি মনে পড়ছে আমাদের? আজ থেকে বহুকাল পরেও যখন নতুন করোনাভাইরাস, কোভিড-১৯ মহামারির কথা আলোচিত হবে, তখনও এই ভদ্রলোকের নাম আলোচনা করা হবে।
নামটা মনে না থাকলেও তার গল্পটা বললে আমরা সবাই মনে করতে পারবো নিশ্চয়ই। এই ভদ্রলোক হচ্ছেন সেই চাইনিজ চিকিৎসক, যিনি উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের একটা চ্যাট গ্রুপে প্রথম ঘোষণা করেছিলেন একটা নতুন ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন, যাতে আক্রান্ত রোগীর লক্ষণ আগের সার্স ভাইরাসের মতো।
এর পরের ঘটনাগুলোও আমাদের মনে থাকার কথা—সামাজিক মাধ্যমে এমন কথা বলার অপরাধে চীন সরকার তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে চরমভাবে তিরস্কার করে এবং এমন কথা বলা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে। কিন্তু আমাদের মনে চিরকালের জন্য ‘ট্র্যাজিক হিরো’র আসনে থেকে যাওয়ার জন্যই বোধ হয় এই ভদ্রলোক করোনায় আক্রান্ত হন এবং মারা যান। তার মৃত্যুতে চীনের মানুষ অবিশ্বাস্যরকম প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল সরকারের বিরুদ্ধে। 

এই ভদ্রলোক প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসার আগে আমাদের দেশে করোনাকে নিয়ে ঘটা কয়েকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করা যাক দ্রুত, যেগুলো নিয়ে কথা বলাই এই কলামের মূল উদ্দেশ্য।

১. এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই না পেয়ে ফেসবুকে স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দেওয়ায় নোয়াখালীর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে। ওই চিকিৎসকের নাম আবু তাহের। তিনি ওই হাসপাতালের সহকারী সার্জন (অ্যানেসথেটিস্ট) হিসেবে কর্মরত।

২. গণমাধ্যমে নার্সদের কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা। বিবৃতিতে বলা হয়েছে—নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের আওতাধীন সব সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীকে চাকরি বিধি অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জনসম্মুখে, সংবাদপত্রে বা অন্য কোনও গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনও প্রকার আলোচনা, বিবৃতি বা মতামত প্রদান না করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।

এর প্রেক্ষাপট এখানে মনে করিয়ে দেওয়া যাক, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে নার্সরা বাজেটের অভাবে খাবার পাচ্ছে না নার্সদের এমন মন্তব্য দেশের মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশে করোনা মোকাবিলার এই ‘ফ্ল্যাগশিপ’ হাসপাতালে এই করুণ অবস্থা প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল মানুষের সামনে।

৩. চাল চুরির খবর প্রকাশের জের ধরে অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী ও জাগো নিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকারসহ চার জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। 

মামলার বাদী মোমিনুল ইসলাম ভাসানীর অভিযোগ, জাগো নিউজ ও বিডিনিউজে তাকে এবং তার ভাই ৪ নম্বর বড় পলাশবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম আমিনকে চাল চুরির সঙ্গে জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এতে তার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

এই ধরনের পদক্ষেপ দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে সেটার জন্য আবার লি ওয়েনলিয়াং-এর ‌ঘটনার প্রভাব নিয়ে আরও কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।

লি ওয়েনলিয়াং উইচ্যাট গ্রুপে কথাগুলো বলেছিলেন ৩০ ডিসেম্বর। ৩১ ডিসেম্বর চীন স্বীকার করে মানুষ ‘এটিপিক্যাল নিউমোনিয়ায়’ আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু নতুন ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়‌ এমন তথ্য চীন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিশ্চিত করে ২০ জানুয়ারি। শুরুর দিকের বেশকিছু কেস স্টাডি করে বিশ্বখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট মোটামুটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে, এই ভাইরাস চীনে উহান শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল নভেম্বরের শেষে অথবা ডিসেম্বরের শুরুতে। এই পুরোটা সময় চীনা সরকার এটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। 

লি ওয়েনলিয়াং এই কথাগুলো সামনে নিয়ে না এলে হয়তো চীন আরও দেরি করতো করোনার কথা স্বীকার করতে। কিন্তু যখন তারা স্বীকার করেছে, ততদিনে চীন থেকে এই রোগ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, কারণ উহান চীনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বাণিজ্যিক শহর, যেখানে সারা পৃথিবীর মানুষের আসা-যাওয়া আছে। 

করোনাভাইরাস চীনের গবেষণাগার থেকে দুর্ঘটনাবশত ছড়িয়ে পড়েছে কিনা, কিংবা চীন এই ভাইরাস ইচ্ছাকৃতভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে কিনা এমন নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখনও আছে। কিন্তু এসব সরিয়ে একটা কথা খুব নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এক মাসের অধিক সময় চীন করোনাভাইরাসের তথ্য গোপন করে রাখার কারণে এই ভাইরাস পৃথিবীতে ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে গেছে, যার মাশুল জীবন দিয়ে দিতে হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো পৃথিবী মুখোমুখি হয়েছে আরেক মহামন্দার, যার ব্যাপ্তি এবং তীব্রতা ১৯২৯ সালের মহামন্দার সমপর্যায়ের হবে, কিংবা হবে বেশি। এর প্রভাবে মারা যাবে অসংখ্য মানুষ, নানাভাবে ভুগবে শত শত কোটি মানুষ।

আমরা একটু ভেবে দেখি তো, চীন যদি ডিসেম্বরের প্রথমেই করোনার অস্তিত্ব স্বীকার করতো এবং উহান লকডাউন ঘোষণা করতো তাহলে পৃথিবীর কি এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয় হতো? কিংবা লি ওয়েনলিয়াং যদি ডিসেম্বরের শেষে এসে উইচ্যাটে এই কথাগুলো না বলতেন, তাহলে কি চীন তখন স্বীকার করতো ভাইরাসের অস্তিত্বের কথা? তাহলে বৈশ্বিক পরিস্থিতি কি হতে পারত না আরও অনেক বেশি ভয়াবহ? 

একের পর এক দেশে যখন করোনা ধরা পড়ছিল, তখন আমরা অগ্রিম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারতাম, রাখিনি; বরং আমরা সরকারের মন্ত্রী এবং সরকারদলীয় নেতাদের কাছ থেকে নানা ‘বালখিল্য’ মন্তব্য শুনেছি। এমনকি ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী আনুষ্ঠানিকভাবে শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেও করোনার ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে চরমতম অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এবং বিশৃঙ্খলা চলছে। 

এই সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদে অতি জরুরি পদক্ষেপের মূল দুটো জায়গায় প্রচণ্ড রকম সমস্যার মুখোমুখি। রোগ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ঘোষিত লকডাউনের কারণে কর্মহীন কোটি কোটি মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া। আলোচিত তিনটি ঘটনা এই দুটো ক্ষেত্রেই সরকারের অদক্ষতা এবং অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। সে কারণেই তাদের ওপরে এই ধরনের চাপ তৈরি করা হচ্ছে। ব্যর্থতা স্বীকার করে সেটা নিয়ে কাজ করে সমাধান না করে ব্যর্থতার কথা প্রকাশ বন্ধ করা কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর খুবই টিপিক্যাল চরিত্র।

দুর্ভিক্ষ নিয়ে বিখ্যাত গবেষণায় অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন পৃথিবীর কোনও দুর্ভিক্ষ খাদ্যের ঘাটতির কারণে হয়নি, বরং হয়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না থাকার কারণে। তিনি এটাও বলেছেন, গণতন্ত্র এবং মুক্ত সংবাদমাধ্যম আছে এমন কোনও দেশে কখনও দুর্ভিক্ষ হয় না। তার ব্যাখ্যা হচ্ছে, যখন দুর্ভিক্ষ লেগে যায়, তখন মানুষের অভুক্ত থাকার কথা এবং দুর্দশার কথা সংবাদপত্রে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকলে সরকার চাপে পড়ে। সেই চাপে পড়ে হলেও সরকার সেটাকে নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে বাধ্য হয়। আমি বিশ্বাস করি করোনায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিয়ে তো বটেই, উদ্ভূত চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ক্ষেত্রেও এই তত্ত্ব কাজে লাগবে।

হালের আলোচিত দার্শনিক স্লাভো জিজেক লি ওয়েনলিয়াংকে ব্র্যাডলি ম্যানিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একজন হুইসেল ব্লোয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তার এই বিবেচনার সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ আসলে নেই। এই চাইনিজ ডাক্তার তথ্য প্রকাশ না করলে পৃথিবীতে করোনার কারণে সংঘটিত বিপর্যয় আরও অনেক বেশি প্রকট হতে পারতো।

আমাদের যেসব ডাক্তার-নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী মূলধারার মিডিয়ায় অথবা সামাজিক মিডিয়ায় তাদের মুখোমুখি হওয়া সংকটের কথা বলছেন, কিংবা যেসব সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যম করোনা মোকাবিলায় নানা রকম অনিয়মের কথা তুলে ধরছেন, তারা এই করোনা মোকাবিলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এদের এবং আপামর মানুষের এসব সমালোচনাই সরকারকে চাপে রাখছে এবং এখন পর্যন্ত যে সামান্য অগ্রগতি করোনা মোকাবিলায় হয়েছে, সেটাও হয়েছে এই চাপের কারণেই।  

আরেকটা কথা, জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশকারীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সারা পৃথিবীতে যে হুইসেল ব্লোয়ার্স প্রটেকশন অ্যাক্ট করা হয়েছে আমাদের দেশেও এরকম একটা আইন করা হয়েছিল। সেটার নাম ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’। সরকার বহু আইন মানুষকে দেখায়, কিন্তু এই আইনটা নিয়ে সরকার তো বটেই সরকারের বাইরে থেকেও খুব কমই কথা বলা হয়। আমি বিশ্বাস করি, এসব তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় এই আইনটি রক্ষাকবচ হিসেবে আছে। 

এটাও সত্য, কোনও আইন কখন, কার ওপরে কীভাবে প্রযুক্ত হবে, সেটা আইনের শাসনের দারুণ অভাবের এই দেশে একেবারেই সরকারের সিদ্ধান্ত। হয়তো এদের ক্ষেত্রে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট‌ই প্রযুক্ত হবে; জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ হবে না তাদের রক্ষাকবচ। 

তবু জাতির এই ভয়ঙ্কর ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সম্মিলিত চাওয়া হওয়া উচিত এই মানুষগুলো কথা বলে যাক, জনস্বার্থে সত্য প্রকাশ করুক। তারা যদি চুপ হয়ে যায় এর মধ্যেই বিপর্যয়ে পতিত এই জাতি যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে যাবে, সেটা কল্পনাও করা যায় না। তাদের আইনের সুরক্ষা যদি নাও দেওয়া যায়, তবুও আসুন যে যেভাবে পারি তাদের পাশে দাঁড়াই, তাদের শক্তি-সাহস জুগিয়ে রুখে দেই করোনা নিয়ে তথ্য প্রকাশ বন্ধ করার সব প্রচেষ্টাকে। এটা শুধু তাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন না, আমাদের নিজেদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ