X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

৩৯তম বিসিএস এবং রুচিবোধ পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ

কাবিল সাদি
১১ মে ২০২০, ২১:০৫আপডেট : ১১ মে ২০২০, ২১:০৭

কাবিল সাদি কথায় বলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি ও চাহিদার পরিবর্তন হয়, ভালো লাগার বিষয়কেও এড়িয়ে চলে। একটা সময় ছিল মা বাবার সবচেয়ে মেধাবী সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এক কথায় বলতে গেলে চিরন্তন পছন্দ থাকতে হতো ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার (প্রকৌশলী) হওয়া। আমাদের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদেরও মানসিক সিদ্ধান্ত হয়ে উঠেছিল এটাই, দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া। সময় বদলেছে, চাহিদাও বদলেছে আর তাই ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেলে বা মেয়েটারও স্বপ্ন বিসিএস দিয়ে প্রথম পছন্দের তালিকায় ফরেন (পররাষ্ট্র) বা প্রশাসন নতুবা পুলিশ ক্যাডার। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা এমনই। এমনও উদাহরণ রয়েছে যে বিসিএসে যিনি মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে পররাষ্ট্র ক্যাডারে আছেন তিনিও ডাক্তারি পড়া। এমন বহুবার বহু ক্যাডারে যুক্ত হচ্ছেন অতীতের প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসা আমাদের ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা মেধাবীরা এবং ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই বর্তমান সর্বোচ্চ চাকরির ক্ষেত্র বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রকৃত অবস্থা।

সম্প্রতি ৩৯তম বিসিএস একেবারেই ব্যতিক্রম। এটি অল্প সময়ে একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা এক ঐতিহাসিক বিসিএস পরীক্ষা। এছাড়াও এই বিসিএস কিছু কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তা হলো, বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে এসে শুধু প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিয়েই মৌখিক পরীক্ষায় সুযোগ পেয়ে সর্বোচ্চ টেকনিক্যাল ক্যাডার সার্ভিসে ঢোকা। এছাড়াও আরেকটা বিষয় ৩৯তম বিসিএসকে আলোচনায় এনেছে। তা হলো, এই বিসিএসের সব নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করে আবার নতুনভাবে আরও দুই হাজার ক্যাডারের প্যানেল নেওয়া। যারা মূলত নন-ক্যাডার ফলাফল দেওয়ার পরও চাকরি পাননি বা নন-ক্যাডারও আর পাবেন না বলে ধরে নিয়েছিলেন; তারাই আবার ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হলেন। আসলে বিষয়টা চমকপ্রদ হলেও এর পেছনের গল্পটা মর্মান্তিক। করোনা মহামারিতে ডাক্তার সংকট ও অধিক সেবা দেওয়ার চিন্তা থেকেই সরকারের এই যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এ জন্যই আগে প্রক্রিয়া শুরু হওয়া এবং দেশের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়া ৩৮তম বিসিএসের ফলাফল এখনও দেওয়া না হলেও তড়িঘড়ি ও বিশেষ সভা করে এই ৩৯তম বিসিএস থেকে এত অধিক সংখ্যক ক্যাডার নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এটা নিয়ে ৩৮তম বিসিএস দেওয়া প্রার্থীদের সামান্য ক্ষোভ বা হতাশা দেখা দিলেও অধিকাংশ চাকরি প্রার্থীই সরকার ও কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। সাধারণ জনগণও এই তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করছে। তাই মহামারির কারণ হলেও অন্তত কিছু বেকারের কর্মসংস্থানও ঘটেছে। পাশাপাশি এই টেকনিক্যাল ক্যাডারের বিশেষ বিসিএসটাও জাতির এই মহামারি সংকটে বড় অবদান রাখতে পেরেছে।

আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন ও চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে। তাই চিকিৎসার মতো এই অতি প্রয়োজনীয় পেশার প্রতিও মেধাবী শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আর তার প্রমাণ ডাক্তারি পড়েও তাদের পছন্দের তালিকায় দেখা যায় পররাষ্ট্র, প্রশাসন, কর বা পুলিশের মতো ক্যাডার। অথচ অনেকে বিসিএসে প্রথম হয়ে পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন, যদি তার এই অভাবনীয় মেধাশক্তি ডাক্তারি পেশায় দিতে পারতেন, আমরা হয়তো অনেক যোগ্য ও দক্ষ একজন ডাক্তার পেতাম। এভাবে যে ছেলে বা মেয়েটা উচ্চশিক্ষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে পুলিশ বা প্রশাসনে যোগ দিয়েছেন, তিনিও যদি তার মেধাটা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দিতেন আমরা কত মেধাবী একজন প্রকৌশলী পেতাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এটাই আজকাল হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে সেই প্রবণতাই বাড়ছে। বিষয়টা এখানেই থেমে গেলেই হয়তো শেষ হতে পারতো, কিন্তু না, এখানেই শেষ নয় বরং আরও ভয়ানক হলো, যে শিক্ষার্থী একজন ভালো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য ভার্সিটির প্রথম সেমিস্টার থেকে যে স্বপ্ন ও আবিষ্কারের নেশায় শ্রম দিতো, আজ তাকেই এসব ব্যতিক্রমী ক্যাডারে আসতে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অথবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে সময় দিতে হচ্ছে বাজার থেকে লাল নীল রঙের বাহারি বই কিনে নাক-মুখ চুবিয়ে ট্রাম্প-পুতিনের খবর নেওয়া অথবা হৈমন্তির বয়স গণনায়।

যতটা রোগীর দেহ ব্যবচ্ছেদের গভীরতা মাপবে তার থেকেও তাকে পরিমাপ করতে হচ্ছে সিরিয়া ইরাকের মানচিত্র ঘেঁটে রাজনৈতিক দেহ ব্যবচ্ছেদ। ফলাফল, ভালো ডাক্তার হওয়ার অনেক শিক্ষা আর ফর্মুলাই সে অনায়াসে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। এই শিক্ষার্থীই যদি কোনোভাবে তার পছন্দের প্রথম সারির পররাষ্ট্র, প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডার না পেয়ে নিজের ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডার পান, তখন আমরা স্বাভাবিকভাবেই একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর মতো ভয়ানক ও স্বপেশার জ্ঞানবুদ্ধিহীন একজন হাতুড়ে পর্যায়ের ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার পেয়ে থাকি, যা আমাদের জাতির জন্য অনিরাপদ। আর সুদূরপ্রসারী ফলাফল হচ্ছে, না পাচ্ছি ভালো কূটনীতিক আর না পাচ্ছি ভালো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। এটা অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ।

তবে বাস্তবতা হলো, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থীরা যতই মেধাবী হোক তাদের অভাব পূরণ করতে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ নেই বা সুযোগ দেওয়ার চিন্তা করাটাই হাস্যকর। ঠিক এ কথাগুলো কৃষি বা অন্যান্য টেকনিক্যাল ক্যাডারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আমাদের এই রুচিবোধ পরিবর্তনের পেছনে বড় কিছু কারণ হলো আন্ত-ক্যাডার বৈষম্য, ক্ষমতার অপব্যবহার, গুণীর কদর না দেওয়া, আমাদের মানবিক উদারতার সংকট, দুর্নীতি নির্মূল করতে না পারা, পেশাভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সুবিধার উচ্চ বিলাসিতাসহ দেশপ্রেমের অভাব।

আমাদের সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার, প্রথা ভেঙে যুগোপযোগী কাঠামো নির্মাণের। সব আন্ত-ক্যাডার বৈষম্য ভেঙে দিয়ে টেকনিক্যাল ক্যাডারদের টেকনিক্যাল ক্যাডারে আবদ্ধ রেখে তাদের বিষয়ভিত্তিক সর্বোচ্চ মেধাকে জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগানো এবং একইভাবে ধীরে ধীরে অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রেও বিষয়ভিত্তিক মেধায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা। তাহলে একদিকে যেমন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা কমে আসবে এবং করোনার মতো মহামারি বা যেকোনও জাতীয় সংকটে ৩৯তম বিসিএসের মতো জনবল নিয়োগ সহজসাধ্য হয়ে উঠবে। আন্ত-ক্যাডার বৈষম্য রোধ, ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ এবং সম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হলে ক্যাডার পরিবর্তনের চিন্তা ও প্রবণতাও কমে আসবে।

আর এতে জনগণ এই সর্বোচ্চ শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা থেকে সর্বোচ্চ নাগরিক সেবারও নিশ্চয়তা পাবে। আর এটা হলেই প্রতিফলন ঘটবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও চেতনার এবং সেই সঙ্গে গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন দেখা সোনার বাংলা।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ