X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘তোর কত বড় সাহস যে আমার কথা অমান্য করিস’

রুমিন ফারহানা
৩১ মে ২০২০, ১৬:৪৬আপডেট : ৩১ মে ২০২০, ১৬:৪৯

রুমিন ফারহানা ‘তোর কত বড় সাহস যে আমার কথা অমান্য করিস। গুলি করে জন্মের মতো খোঁড়া করে দিবো।’ এই ধরনের ‘ডায়ালগ’ আমরা নাটক সিনেমায় দেখেছি, গল্প উপন্যাসে পড়েছি, পাড়ার উঠতি মাস্তানরা নাকি বলে, শুনেছি। কিন্তু এমন ডায়ালগের মুখোমুখি হওয়া বাস্তবে সবার ভাগ্যে ঘটে না। ভাগ্যের জোরে এমন ডায়ালগের মুখোমুখি হয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের এমডি; যাকে অস্ত্রের মুখে ধরে এনে এভাবেই হুমকি দিয়েছেন সিকদার গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার আর তার যোগ্য সহোদর দিপু হক সিকদার। ঘটনা এখানেই শেষ না। ব্যাংকটির এমডি ও অতিরিক্ত এমডিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টাও করেন তারা। চালানো হয় নির্যাতন। জোর করে সাদা কাগজে সইও নেওয়া হয়। পাহারায় রাখা হয় দুইজন বিদেশি নিরাপত্তাকর্মীকে। হুমকি দেওয়া হয় এই বলে যে, স্বাক্ষর না করলে বিদেশি নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন চালানো হবে। 
৫০০ কোটি টাকা ঋণ পেতে যে সম্পত্তি বন্ধক রাখার চেষ্টা করেন তারা, তার মূল্য নথিপত্রে দেখানো মূল্যের চেয়ে কম বলে উল্লেখ করলে এই হুমকির মধ্যে পড়তে হয় এক্সিম ব্যাংকের এমডি আর অতিরিক্ত এমডিকে। কথার সঙ্গে কাজের মিল রেখে এক্সিম ব্যাংকের এমডির উদ্দেশ্যে গুলিও ছোড়েন রন। বেরসিক গুলি অবশ্য হালকা হাওয়ার পরশ বুলিয়ে এমডির কানের পাশ দিয়ে উড়ে যায়। তাতে কিন্তু দমে যাননি রন। তিনি আবার গুলি করতে ধরলে বেচারা এমডি গাড়ির পেছনে আশ্রয় নেন। অবিকল সিনেমার দৃশ্য। চিত্রনাট্যকে আরও বাস্তব রূপ দিতে এই সময় মদ্য পানও করছিলেন রন আর দিপু।  

ঘটনা ঘটেছে ৭ তারিখে, ব্যাংক মামলা করেছে ১৯ তারিখে আর গণমাধ্যমে এসেছে ২৭ তারিখে। ঘটনা ঘটার আর প্রকাশিত হওয়ার মাঝের এই ২০ দিন কোন জাদুমন্ত্রের বলে ঝাঁপির তলে এত বড় ঘটনা লুকিয়ে ছিল, তা কেবল বলতে পারেন ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা তারাই। মামলা দায়ের করতেই বা কেন ১২ দিন সময় লাগলো, সেটিও তারাই ভালো জানেন। ন্যূনতম আইনের শাসন আছে এমন যেকোনও দেশে এইটুকুই যথেষ্ট বেশি ছিল ভ্রাতাযুগলকে শ্রীঘরে পাঠানোর জন্য। কিন্তু যোগ্য দেশের যোগ্য সন্তান তারা। যেমনি সরকার তেমনি নাগরিক। তাই শ্রীঘর তো দূরেই থাকুক রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় ব্যক্তিগত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশ ছেড়েছেন দুই ভাই। ২৫ তারিখে নিরাপদে দেশ ছাড়ার পর ২৭ তারিখ তাদের কীর্তি কাহিনি ছাপা হয় পত্রিকায়। আর তারও দুই দিন পর ২৯ তারিখ তাদের দেশ ত্যাগের খবর প্রথম জানতে পারে মানুষ। সব যেন সাজানো ছকের মতো। দাবার চালে কোথাও এতটুকু ভুল নেই।  

করোনাকালে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ভ্রমণ যেখানে দুঃসাধ্য সেখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়াল দিতে কতটা খুঁটির জোর লাগে, সেটি বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সেই খুঁটির জোর তাদের ভালোই আছে এবং সেটি তারা দেখিয়েও দিয়েছেন। সিকদার গ্রুপের ব্যক্তিগত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি যাতে নিরাপদে অবতরণ করতে পারে, সেজন্য গত ২৩ মে থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়েছিল থাইল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস। ওই দিনই তাদের অনুমোদন দেওয়া হলে ঢাকায় অবস্থিত থাই দূতাবাসকে একটি চিঠি দেওয়া হয় যেখানে দুইজনকে মেডিক্যাল ভিসা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়; ভিসা ইস্যু হয় ২৪ তারিখ; তারা দেশ ছাড়েন ২৫ তারিখ। যদিও গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ থাইল্যান্ডের মধ্যে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ।

দেশ ছাড়তে তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তার প্রয়োজন পড়েছে থাইল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষসহ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের। আমার মতো বিরোধী দলের একজন তুচ্ছ কর্মী যখন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দেশের বাইরে যাই তখন হাইকোর্টের অর্ডার থাকার পরও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা এক থেকে দেড় ঘণ্টা আমাকে আটকে রাখেন বিমানবন্দর থানার ওসি সাহেবের ঘরে। লাল পাসপোর্ট কিংবা সবুজ, বাস্তবতা একই। কোনও মামলা যখন ছিল না তখনও যেমন, একগুচ্ছ মামলা ঘাড়ে আসার পর এখনও তেমন। গত ৭-৮ বছর যাবৎ এই যন্ত্রণার মুখোমুখি হই বলেই জানি আমার মতো তুচ্ছ মানুষের দেশ ছাড়ার জন্য চারটি গোয়েন্দা সংস্থাসহ মোট পাঁচটি সংস্থার ছাড়পত্রের দরকার পড়ে। এমনকি বিদেশ থেকে নিজের দেশে ফেরার সময়ও কোর্ট অর্ডার সঙ্গে রাখতে হয় এবং ঠিক একই কায়দায় অপেক্ষা করতে হয় সংস্থাগুলোর অনুমোদনের। ৩-৪ ঘণ্টা দূরত্বের যাত্রা হলে তবু সহ্য হয়, কিন্তু যাত্রা যখন হয় ৩৬ ঘণ্টার তখন পুরো বিষয়টা কেমন লাগে সেটা কেবল ভুক্তভোগী জানেন। অথচ একজন হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি যখন দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন এবং সফল হন বিনা বাধায়, বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে যখন এক বিশেষ পরিস্থিতি তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না যে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গই চায় বিনা বাধায় নিরাপদে দেশ ছাড়ুক তারা।

বারবার বলে এসেছি সরকারের মদতপুষ্ট লোক ছাড়া এই দেশে লক্ষ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হওয়া সম্ভব নয়। অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বে প্রথম হওয়া বাংলাদেশে সরকারি হিসাব মতেই মন্দ ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, আইএমএফ বলছে এই সংখ্যা আড়াই লাখ কোটি আর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক কর্মশালায় বলেন, ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃত খেলাপি ২৩ শতাংশ, যা অঙ্কের বিবেচনায় ৪ লাখ কোটি টাকার ওপরে। আর বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। প্রয়োজন না থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া, ব্যাংকের পরিচালকদের পরস্পরের যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া, রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ঋণ ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি, মামলার দীর্ঘসূত্রতা সবকিছুই এই খেলাপি ঋণ বীভৎস পরিমাণে বাড়ার জন্য দায়ী। এমনকি সংসদে ৩০০ জন শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকা আসার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না।

এখন দেখা গেলো নতুন আর এক কায়দা আছে। এক ব্যাংক পরিচালকের ঋণ চাই, ঝুঁকি বিবেচনায় যা দিতে অস্বীকৃতি জানান অন্য ব্যাংকের পরিচালক। তারপর মাফিয়া কায়দায় হত্যাচেষ্টা, ৭ তারিখের ঘটনায় ১৯ তারিখ মামলা, পুলিশ, প্রশাসন সকলের নাকের ডগায় ২৫ তারিখ দেশ ত্যাগ, নিরাপদ দেশ ত্যাগের ২ দিন পর ২৭ তারিখ সবকিছু গণমাধ্যমে প্রকাশ স্পষ্ট করে না কি পুরো ঘটনাই একসূত্রে গাঁথা। ৩০ মে প্রথম আলোর রিপোর্ট বলছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অনুমোদন নিয়েই দেশ ছেড়েছেন হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি দুই ভাই। পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের যাত্রা স্থগিত করার কোনও নির্দেশনা ছিল না।’ বরং ৭ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের অনুরোধ এসেছে মামলা না নেওয়ার জন্য।

স্বজনতোষী পুঁজিবাদে যা হওয়ার কথা তাই হয়েছে। যারা ভোটে বা ভোট ছাড়া জনপ্রতিনিধি হয়েছেন, তথাকথিত রাজনীতি করছেন, তারাই আবার ব্যাংকের মালিক, ব্যবসায়ী, শীর্ষ ঋণ খেলাপি, কলকারখানা আর গার্মেন্ট মালিক, টাকা পাচারকারী, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির নায়ক, ঠিক যেন ‘শুরির সাক্ষী মাতাল’। পচন ধরে মাথা থেকে। আমি বিশ্বাস করি সবকিছুর নিয়ামক যেহেতু রাজনীতি তাই তার পচনের দুর্গন্ধ সবকিছুকেই কলুষিত করবে, করেছেও।

শেষ করছি ঢাকাই বিজ্ঞাপনের একটি বাক্য দিয়ে যেখানে বলা হয়েছিল—‘যে পথ দেখায় সে থাকে এগিয়ে’। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। দুই সহোদর পথ দেখিয়েছেন। সে পথে উড়ে গেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মরশেদ খান আর বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান। শুনেছি উড়ন্ত মানুষের এই লাইন নাকি বেশ দীর্ঘ। বাংলাদেশের আইন তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে না। ঠিক যে কথাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম। এদের কথা অমান্য করার সাহস আসলে কেউ রাখে না। এরা আইন তৈরি করে, আবার সময় সময় এদের কথাই আইন। কিন্তু করোনা বড় বেয়াড়া রকম সাম্যবাদী। তাই এই নিদানকালে চার্টার্ড প্লেন ছাড়া গতি কী? বেঁচে থাক চার্টার্ড প্লেন, দীর্ঘ হোক উড়ন্ত মানুষের লাইন। 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।  জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দক্ষ বিচার বিভাগ গঠনে বিশ্বমানের জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি প্রয়োজন: আইনমন্ত্রী
দক্ষ বিচার বিভাগ গঠনে বিশ্বমানের জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি প্রয়োজন: আইনমন্ত্রী
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দুই ফুটবলার
ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দুই ফুটবলার
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ