X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সমাধান হলো ‘খাদ্য সার্বভৌমত্ব’

মো. শরীফ হাসান
১৯ জুন ২০২০, ১৮:০৮আপডেট : ১৯ জুন ২০২০, ১৮:০৯

মো. শরীফ হাসান মানব সমাজ একবিংশ শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ মুহূর্তের মুখোমুখি। এই মহামারিটি স্পষ্ট করে দিয়েছে খাবারের জন্য করপোরেশন এবং বড় কৃষি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করা আমাদের থামাতে হবে। করোনাভাইরাস মহামারি মানবজাতিকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে এবং এর অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশ করেছে। কোনও দেশই রেহাই পায়নি।
বিজ্ঞানীরা যখন কোনও ভ্যাকসিনের খোঁজে হিমশিম খাচ্ছে, যা মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, অনেক দেশ তখন লকডাউন জারি করেছে যাতে লোকেরা ঘরে থাকে। তবে অনেক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে এটি একটি চ্যালেঞ্জ।
বস্তিবাসী যারা ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন, সরকারের সামাজিক দূরত্বের উপায়গুলো মেনে চলতে পারে না, বা পরিষ্কার পানি সরবরাহের অভাব থাকায় তারা কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে পারে না। লকডাউন শহরের লক্ষ লক্ষ দিনমজুর শ্রমিককে উপার্জন থেকে বঞ্চিত করে এবং অনেক পরিবারকে অনাহারের পথে ঠেলে দেয়।

গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত লোকেরাও লড়াই করে যাচ্ছে। যদিও আমাদের মধ্যে অনেক কৃষক জমিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের পণ্য বিক্রি করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। সরকার স্থানীয় বাজারগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আমাদের অনেক ফসলই ক্ষেতে নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

ক্ষুদ্র আকারের জেলেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যদিও তারা সমুদ্র, হ্রদ বা নদীতে তাদের মাছ ধরতে পারছেন, তবে তারাও তাদের মাছ বিতরণ করতে অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন। রাখাল এবং পারিবারিক মালিকানাধীন দুগ্ধখামারগুলোর ক্ষেত্রেও এটি একই রকম সত্য।

ক্ষুদ্র আকারের গবাদিপশু লালন-পালনকারী কৃষক এবং গৃহপালিত প্রাণীসহ কৃষক পরিবারগুলোও তাদের পশুর পর্যাপ্ত খাবারের সন্ধানের জন্য চিন্তিত। ক্ষুদ্র পর্যায়ের স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়া যদিও তাৎপর্যপূর্ণ, তবে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে শ্রম সরবরাহ এবং আন্তর্জাতিক বিতরণ প্রভাবিত হওয়ায় বড় আকারের খাদ্যশিল্পগুলো, যা আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর নির্ভর করে কাজ করে তারা আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতগ্রস্ত হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, মহামারিটি বিভিন্ন দেশের বড় বড় আন্তর্জাতিক খাদ্যশিল্পের ওপর নির্ভরশীলতার আরেকটি বাজে দিক তুলে ধরেছে। কয়েক দশক ধরে, সরকার ক্ষুদ্র খামার এবং খাদ্য উৎপাদনকারীদের রক্ষা করতে খুব সামান্যই কাজ করেছে। ফলে, ক্ষুদ্র খামার ও খাদ্য উৎপাদনকারীরা এই ক্রমবর্ধমান অকার্যকর করপোরেট জায়ান্টদের চাপে ব্যবসায়ের বাইরে চলে গেছে। তারা অলস হয়ে পড়েছে, কারণ তাদের দেশগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে কয়েকটি বড় খাদ্য সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বড় খাদ্য সরবরাহকারীরা স্থানীয় উৎপাদকদের তাদের পণ্যকে অন্যায়ভাবে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করে, যাতে করপোরেট কর্মকর্তারা তাদের লাভের সীমা বাড়িয়ে রাখতে পারেন। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্ষেত্রে প্রথাগত অল্প পরিমাণ কৃষিকাজের তুলনায় বড় কৃষি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি অবদান রাখলেও তারা নীরব থাকে।

স্থানীয় কৃষি বাজারগুলো সুপার মার্কেটগুলোকে পথ করে দেয়, এবং বড় ব্যবসাগুলো এবং তাদের পণ্য বাণিজ্যের অংশীদাররা কৃষিবিজ্ঞান ও খাদ্য সার্বভৌমত্বের সমস্ত নীতি উপেক্ষা করে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

শিল্পজাত খাদ্য উৎপাদনের আগ্রাসী প্রসার ক্রমবর্ধমানভাবে মানুষের স্বাস্থ্যকে ক্ষতির মুখে ফেলেছে। রাসায়নিকের অত্যধিক ব্যবহার এবং অতিরিক্ত খাবার প্রক্রিয়াজাতকরণ, যা তাদের কম পুষ্টিকর এবং আরও বেশি ক্ষতিকারক করে তোলে, তা জেনেটিক রোগের পরিমাণও বাড়িয়েছে- যা রোগজীবাণুর দ্বারা সৃষ্ট এবং প্রাণী থেকে মানুষে ঝাঁপ দেয় (ঠিক কোভিড-১৯-এর মতো)।

বর্তমানে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য সুরক্ষা ক্রমবর্ধমান বড় শিল্প খাদ্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুর তার প্রায় ৯০ শতাংশ খাদ্য আমদানি করে; ইরাক, যা মধ্যপ্রাচ্যের রুটির ঝুড়ি ছিল, তারাও বিদেশ থেকে ৮০ শতাংশেরও বেশি খাবার পায়।

বিশ্বব্যাপী সম্প্রদায়গুলো ক্ষুধার আশঙ্কার মুখোমুখি হওয়ায় আন্তর্জাতিক খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খলের ওপর এই নির্ভরতার বিপদগুলো এখনই সামনে চলে আসছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ‘খাদ্য সংকট’ হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারি ‘খাদ্য সার্বভৌমত্ব’ ধারণাটিকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। ১৯৯৬ সালে লা ভায়া ক্যাম্পেসিনার মতো আন্তর্জাতিক কৃষক সংস্থা ‘খাদ্য সার্বভৌমত্ব’ ধারণাটি প্রবর্তন করে। ‘খাদ্য সার্বভৌমত্ব’ দাবি করে যে লোকেরা খাদ্য উৎপাদন করে, বিতরণ করে এবং ভোগ করে তাদের খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণের প্রক্রিয়া এবং নীতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।

কোভিড-১৯ মহামারিটি মানুষকে তাদের নিজেদের খাদ্য নির্ধারণ ও নিজস্ব কৃষি পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং স্বাস্থ্যকর ও সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত খাবার উৎপাদন ও ভোজনে তাদের নির্ধারণের অধিকার সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করছে।

নেপাল, মালি, ভেনিজুয়েলা এবং আরও বেশ কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে খাদ্য সার্বভৌমত্বকে তাদের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যান্য দেশগুলোরও এটি অনুসরণ করা উচিত। জনগণের খাদ্য সার্বভৌমত্ব হলো যেকোনও অর্থনৈতিক ধাক্কার বিরুদ্ধে সেরা প্রতিরক্ষা।

এটি জনগণের অতি জরুরি চাহিদাগুলোকে সম্বোধন করে, যা স্থানীয় বসতি বা আশপাশের অঞ্চলে বেড়ে ওঠা স্বাস্থ্যকর, পুষ্টিকর এবং জলবায়ুগতভাবে উপযুক্ত খাবার, যেখানে সম্ভবত তারা এর উৎপাদনকারী লোকদের চেনে। কৃষি বাস্তুসংস্থান এবং স্থানীয় কৃষককের খাদ্য উৎপাদন আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সহ-অবস্থানকে সুনিশ্চিত করে। এটি ক্ষতিকারক কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার থেকে ফসলকে দূরে রাখে।

একটি মুক্তবাজার অর্থনীতির ধরাবাধা প্রতিযোগিতামূলক যুক্তির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংজ্ঞা দেওয়া বন্ধ করা উচিত। পারস্পরিক সংহতি ও মানবিক নীতির দ্বারা বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক বাণিজ্য নীতিগুলো নির্ধারণ করা উচিত। জলবায়ু বা অন্যান্য অবস্থার কারণে স্থানীয় উৎপাদন যেখানে অসম্ভব বা মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জপূর্ণ সেসব দেশগুলোর ক্ষেত্রে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার নয়, বরং সহযোগিতার ওপর নির্ভর করা উচিত।

এ কারণেই, কয়েক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে লা ভায়া ক্যাম্পেসিনার মতো কৃষক আন্দোলন প্রচারণা চালিয়েছে এবং কৃষিকে মুক্তবাণিজ্য আলোচনার বাইরে রাখার দাবি জানিয়েছে।

লাভের চেয়ে জীবনকে উৎসাহিত করে এমন কোনও আদেশ অবশ্যই মানব সভ্যতার মূলভিত্তি হয়ে ওঠা উচিত। আমরা এখনও এমন পৃথিবীতে বাস করছি না, তবে আমরা অবশ্যই পারি। বিশ্ব যখন মহামারির কবলে পড়েছে, এখনই সময় এসেছে সমতা, ন্যায় ও উদার ভিত্তিতে একটি খাদ্যে সার্বভৌম ও সংহতিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার।

লেখক: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের সভায় সভাপতিত্ব করা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা: স্পিকার
এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের সভায় সভাপতিত্ব করা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা: স্পিকার
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ