X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

দায়িত্ববানের মুখে এ কেমন কথা!

রেজানুর রহমান
২০ জুন ২০২০, ১৪:৪৯আপডেট : ২০ জুন ২০২০, ১৪:৫১

রেজানুর রহমান সহজ কথা যায় না বলা সহজে। আবার বলার সুযোগ থাকলেও সব কথাই প্রকাশ্যে জনসমক্ষে বলা ঠিক নয়। বিশেষ করে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব পর্যায়ে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তাদের উচিত জনসমক্ষে কিছু বলার আগে একটু ভেবে নেওয়া। কারণ তার বা তাদের কথার ওপর নিমেষেই অনেক পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। দূর অতীতে দেশের একজন মন্ত্রীর বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি বেদনাবিধুর করুণ মৃত্যুর ঘটনার পর তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছে’। কাজেই...। এটাতো সহজ সরল কথা। জন্ম-মৃত্যু মহান সৃষ্টিকর্তার হাতে। সে কারণে কারও মৃত্যু হলে আমরা অনেকেই এ ধরনের কথা বলে থাকি। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু আপনি যখন কোনও বড় দায়িত্বে থাকবেন তখন এ ধরনের  সহজ কথা বলার আগে আপনাকে বারবার ভেবে নিতে হবে। কারণ আপনার কথাতো শুধু ‘কথা’ নয়। দেশের মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস। সেই আপনি যদি কথার কথা বলে ফেলেন, তাহলে তো কথা আর কথা থাকে না। সহজ কথাও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
করোনার এই দুঃসময়ে দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে আছে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর। কথার কথা বলি। স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কোনও প্রতিষ্ঠান যদি এই মুহূর্তে ঘোষণা দেয়, চিন্তার কোনও কারণ নেই আমরা অচিরেই করোনা মুক্ত হবো। তাহলে দেশের মানুষ কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হবে। করোনার আতঙ্ক আর সেভাবে ছড়াবে না। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে দেশের মানুষকে সাহস জোগানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের উচিত এ ধরনের পজিটিভ বক্তব্য প্রদান করা। সেটা না করে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিই যদি হতাশার সুর তোলেন তাহলে বিপদে সাহস খোঁজার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

করোনার আতঙ্কে দেশের মানুষ এমনিতেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। দেশের আতঙ্কগ্রস্ত মানুষকে যে মুহূর্তে সাহস জোগানো জরুরি, সেই মুহূর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক স্বয়ং চরম হতাশার সুর ছড়িয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আরও ২/৩ বছর থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। করোনার আতঙ্কজনক এই সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি কেন এই মন্তব্য করলেন বুঝে উঠতে পারছি না। যদিও ১৯ জুন তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘বক্তব্যের স্ক্রিপ্টটি দ্রুততার সঙ্গে তৈরি করতে বুলেটিনের সময় হয়ে যায় এবং ভালো করে পরীক্ষা করারও সুযোগ হয়নি। সেই স্ক্রিপ্টই বুলেটিনে পাঠ করা হয়। তবে পরে বুঝতে পারি এ বক্তব্যে অস্পষ্টতা তৈরি হতে পারে।’

ধরা যাক, তার আগের কথাই ঠিক। পরিস্থিতি বিবেচনায় করোনাভাইরাস সহসাই হয়তো বাংলাদেশ থেকে যাবে না। কিছু দেশের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে এই ধরনের আতঙ্ক ছড়ানো বক্তব্য প্রদান করা কি আদৌ ঠিক হয়েছে? ধরা যাক, একটি যৌথ পরিবারে ভূতের আছর পড়েছে (যদিও ভূত বলতে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না), ভূতের ভয়ে সকলে অস্থির। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যরা পরিবার প্রধানের পাশাপাশি বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের কাছেই সাহস খুঁজবেন। সেখানে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কোনও সদস্যই যদি আতঙ্ক ছড়াতে থাকেন, বলতে থাকেন, এই পরিবার থেকে ভূত কবে যাবে বলা মুশকিল...তাহলে পরিবারটির মানসিক শক্তি কি বাড়বে? নাকি কমবে?

করোনাকালের এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি জরুরি—মানসিক শক্তি। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ এই শক্তি জোগানোর উৎস হতে পারেন। অথচ ঘটছে তার বিপরীত। এমনিতেই করোনার এই দুর্যোগকে পুঁজি করে দেশের কিছু অসাধু মানুষ নানা রকমের ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। মাস্ক, স্যানিটাইজার, হ্যান্ডস গ্লাভসের ব্যবসা এখন জমজমাট। করোনার এই দুঃসময়ে সাধারণ কিছু ওষুধও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের এই বক্তব্য উল্লিখিত বিষয়গুলোকে আরও দুষ্প্রাপ্য করে তুলতে পারে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল বললেন, করোনার আতঙ্কে দেশের মানুষ অস্থির সময় অতিক্রম করছেন। এই মুহূর্তে প্রয়োজন মানুষের মাঝে পজিটিভ স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়া। যাতে মানুষের মাঝে ভয় কেটে যায়। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের উচিত করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে বলার সময় একটু সচেতন থাকা। যাতে মানুষের মাঝে ভয় না ছড়ায়।

আবারও বিনয়ের সঙ্গে একটা কথা বলি। অনেক নির্মোহ সত্য জনসমক্ষে প্রকাশ করতে নেই। বিশেষ করে যারা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের ক্ষেত্রে তো নয়ই। কারণ সাধারণ মানুষ কোনও কথা বললে সেটার কোনও গুরুত্ব নেই। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশিষ্ট ব্যক্তির কথার অনেক গুরুত্ব আছে। আমরা চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। সেখানে চিকিৎসকই যদি রোগীর সামনে হাল ছেড়ে দেন, তাহলে তো আর করার কিছু থাকে না। একইভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতর হলো দেশের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি আতঙ্ক ছড়ান, তাহলে দেশের মানুষ ভরসা খুঁজবে কোথায়, কার কাছে?

একথা সত্য, মরণঘাতী ভাইরাস করোনা থেকে সহসাই মুক্তি পাবার সম্ভাবনা কম। তাই বলে বিষয়টিকে আতঙ্কের পর্যায়ে ফেলা যাবে না। করোনার সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের চলতে হবে। সেজন্য একটা বদল প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই বদল প্রক্রিয়ায় কীভাবে দেশের সকল মানুষকে সচেতন করে তোলা যায়, সেটাই হোক সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি। এক্ষেত্রে দেশের ব্যবসায়ী সমাজেরও অনেক দায়-দায়িত্ব আছে। করোনাকালেও ভেজাল মুক্ত পণ্য পাচ্ছে না দেশের মানুষ। এখন চলছে আমের মৌসুম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আমেই বেশি ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনে মাছ, মাংস, তরিতরকারি,  মৌসুমি ফলসহ গৃহস্থালির নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ঘরে বসে অর্ডার দিলেই চলে আসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। কিন্তু এক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে প্রতারণা। অনলাইনে অর্ডার করলে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হয়। কারণ নির্ধারিত ওজনের পণ্যটি বাসায় এসেছে কিনা সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের ওপর। এই সুযোগে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান। অনলাইনে ছবিতে পণ্য দেখার পর অর্ডার দিয়ে একই মানের পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। ওজন কম দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে আমসহ মৌসুমি ফলের ক্ষেত্রে ওজন ঠিক থাকছে না বলে অভিযোগই বেশি।

করোনার সঙ্গে হয়তো এসব অনিয়মের কোনও যোগসূত্র নেই। কিন্তু ধারণা করা হয়েছিল করোনার মতো মহামারির এই দুঃসময়ে অসৎ ব্যবসায়ীরা হয়তো একটু সতর্ক হবেন। কিন্তু কার্যত তাদের অনেকের মাঝেই কোনও পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। বরং বেপরোয়া গতিতে তারা অনিয়ম দুর্নীতি করেই চলেছেন। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের বক্তব্য দুর্নীতিবাজদেরই সাহস জোগাবে বলে অনেক ধারণা। করোনা দীর্ঘায়িত হবে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা করোনা প্রতিরোধের নামে প্রতারণার নতুন নতুন পথ খুঁজে বের করবে। কাজেই আশা করি করোনাকালীন এই দুঃসময়ে আমরা এমন কথা বলব না যা সাধারণ মানুষের মনে ভীতি ছড়াবে! সবার জন্য রইল শুভ কামনা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ