X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

চীনের ‘শান্তিপূর্ণ উত্থান’ কি শেষ?

মো. শরীফ হাসান
০৪ জুলাই ২০২০, ১৫:৩৭আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২০, ১৫:৩৯

মো. শরীফ হাসান গালওয়ান উপত্যকা সীমান্তে চীনা ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষের পর পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। উভয়পক্ষের হতাহতের ঘটনায় দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই দুটি এশীয় শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে প্রায়শই অঞ্চলজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছে; সর্বশেষ সংঘর্ষ ব্যতিক্রম নয়।
গালওয়ান উপত্যকায় চীনের আগ্রাসী ভূমিকার সঙ্গে সম্প্রতি অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার নেওয়া ভূমিকার যোগসূত্র খোঁজা যাক। এক. জুন ১৫–১৬; রাতে হিমালয় পর্বতমালার পশ্চিম প্রান্তে প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট ওপরে লাদাখ তথা আকসাই চীনের লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলে (এলএসি) চীন ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
দুই. সেই একই দিন একটি চীনা জে -১০ যুদ্ধবিমান কিছু সময়ের জন্য তাইওয়ানের বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। প্রতিক্রিয়ায় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটি নিজেদের বিমান নিয়ে সেটিকে ধাওয়া করে। এটি এক সপ্তাহের মধ্যে তাইওয়ানের আকাশসীমায় চীনা যুদ্ধবিমানের তৃতীয় অনুপ্রবেশ ছিল।

তিন. দুই মাস আগে চীনা জাহাজ মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের জলসীমায় প্রবেশ করেছিল।

চার. গত মাসে, চীনা কোস্ট গার্ডের জাহাজ একটি জাপানি মাছ ধরা নৌকাকে উভয় দেশের বিতর্কিত জলসীমায় ধাওয়া করেছিল।

পাঁচ. তাইওয়ানের সঙ্গে ‘একত্রীকরণ’ চীনের অন্যতম স্ব-ঘোষিত লক্ষ্য।

গত মাসে, একটি বার্ষিক নীতিমালায়, চীন তাইওয়ানের সঙ্গে ‘একত্রীকরণের’ ইচ্ছাকে উল্লেখ করতে ‘শান্তিপূর্ণ’ শব্দটি বাদ দেয়। যার নজির প্রায় ৩০ বছরের মাঝে প্রথম।

প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোয় উত্তেজনা চীনের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে এই সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের আলোকে এটা স্পষ্ট, চীনের বর্তমান রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর পূর্বসূরির রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও-যে নেওয়া ‘শান্তিপূর্ণ উত্থান’ (বা যাকে চীনারা পরে ‘শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন’ বলছে) পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসেছে। ‘শান্তিপূর্ণ উত্থান’ নীতির মূলকথা ছিল: যা অন্য দেশগুলোকে, বিশেষত আমেরিকা ও চীনের এশিয়ান প্রতিবেশীদের, দেশটির উত্থানের ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়ার জন্য এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। যাতে অন্য কোনও দেশ একে হুমকি হিসেবে না দেখে। চীন, তাইওয়ান, তিব্বত, হংকং, জাতীয় সার্বভৌমত্ব বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যেকোনও সমস্যায় যে অবস্থান নিয়েছে তা নতুন নয়।

কোভিড-১৯ এর পরবর্তী সময়ে এই স্পষ্ট পরিবর্তন চীনের প্রধান নীতিগত সিদ্ধান্তগুলোকে চিহ্নিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এখন খুবই খারাপ, বিশেষত ট্রাম্প প্রশাসন মহামারিটি সামলানোর ব্যাপারে চীনকে প্রকাশ্যেই লক্ষ্য বানাচ্ছে। চীন ইতোমধ্যেই মার্কিন-সোভিয়েত প্রতিযোগিতার সময়কে উল্লেখ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘শীতল যুদ্ধের মানসিকতা’ এর নিন্দা করেছে। অস্ট্রেলিয়া যখন মহামারিটি ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে তদন্তের জন্য জোর দিয়েছিল, বেইজিং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটিকে শাস্তি দিয়েছে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে, অস্ট্রেলিয়ান নাগরিককে চীনে মাদক পাচারের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে, যা সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। হংকংয়ে, যেখানে এক বছরের বেশি সময় ধরে চীনবিরোধী বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে, সেখানে বেইজিং একটি নতুন জাতীয় সুরক্ষা আইন চালু করেছে। যা এই বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলে তাদের নিজেকে আরও বিস্তৃত ক্ষমতা দিয়েছে। শি জিনপিং যদি এই বছরের গোড়ার দিকে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের জন্য তার রাষ্ট্রক্ষমতার সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি হয়ে থাকেন, তবে সীমানা বিস্তৃত করার মতো একটি উচ্চাভিলাষী বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে তিনি এখন বেশ দৃঢভাবেই নিয়ন্ত্রণে আছেন বলে মনে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো চীন এর আচরণে উপাদানগুলো কী, যা আজ এমনভাবে অতীতে যা ঘটেছিল তার থেকে আলাদা করছে।

এটি স্পষ্টভাবেই লক্ষণীয়, কোভিড-১৯ চীনের বৈদেশিক নীতিতে ‘তীব্র মোড়’ এনেছে। কারণ হঠাৎ করেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে চীন ব্যাকফুটে চলে গেছে। এটি চারপাশে খুব বাজেভাবে চাপে ছিল। অন্যান্য দেশ এর মহামারি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার ব্যাপারে কথা বলছিল। এবং আমেরিকাও এখন প্রকাশ্যে চীনের বিরুদ্ধে জোট গঠনের বিষয়ে কথা বলছে। সুতরাং চীনের এই প্রতিক্রিয়া সঙ্কট মোকাবিলায় তাদের প্রচেষ্টারই একটি অংশ। আমরা প্রতিরোধ করতে লড়াই করতে যাচ্ছি এটিই বেইজিংয়ের বার্তা।

তবে চীন সবসময় এ জাতীয় বিশ্লেষণের বিরোধিতা করে আসছে। এর মতে, চীন একটি উদীয়মান, দায়িত্বশীল শক্তি এবং কিছু উত্তেজনা তার উত্থানেরই অংশ। ২০১২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরে রাষ্ট্রপতি শি' ২০৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের শতবর্ষের পূর্বেই দেশকে ধনী, শক্তিশালী এবং আধুনিক বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত করার জন্য ‘চীন স্বপ্ন’ নির্ধারিত করেন।

লক্ষ করা গেছে, একটি পরিষ্কার পরিবর্তন ঘটেছে। এই [আক্রমণাত্মক] বিবরণটি খুব পদ্ধতিগতভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে। ভারত ও চীনের মধ্যে তারা বলতো, ‘পার্থক্যকে বিতর্ক হতে দেবেন না’। আর এখন যা ঘটছে তা হলো কোভিড-১৯ এর পূর্ববর্তী সমস্যাগুলো চারদিক থেকেই একে ঘিরে ধরছে। এমনকি ‘শান্তিপূর্ণ উত্থান’ নীতিও এখন আক্ষরিক অর্থেই বিতর্কিত হয়ে উঠছে।

লেখাটির শেষে এসে প্রসঙ্গে ফেরা যাক। লাদাখে সংঘাতটা হঠাৎ করে হয়েছে—এমনটা বলা যাচ্ছে না। কিছুদিন ধরে ভারত ও চীনের মধ্যে একটা শীতল সম্পর্ক যাচ্ছে। সেটিরই একটি অনিবার্য অবস্থা এটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, একাধিক কারণে চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল, সংক্ষেপে এলএসি) পাশে সেনা জমায়েত করছে। সেই একাধিক কারণের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হলো তিব্বতকে পুরোপুরি কব্জায় আনা এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ঘেঁষে ভারতের স্থাপনা গড়ে তোলা ঠেকিয়ে দেওয়া। ফলস্বরূপ ৪৫ বছর পর এই প্রথম দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধল।

এই মুহূর্তে লাদাখ ইস্যুতে চীনের দ্বন্দ্ব কমানোর একটি সুযোগ রয়েছে। যা ভারতও তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রত্যাশা করছে। ভারত হয়তো উচ্চাভিলাষী, তবে তারা অবশ্যই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। দেশটি ২০০৮ সালের পরে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হচ্ছে। এর ব্যাংকগুলো ধসে পড়ছে এবং রফতানি বন্ধ রয়েছে। এমনকি, দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত-এর মতানৈক্যের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমগুলোতে বেশ কয়েকবার এসেছে, যা ভারতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ ফাটল স্পষ্ট করছে। এমতাবস্থায় কূটনীতিই ভারতের পক্ষে সম্ভাব্য সেরা উপায়।

তবে চীন যদি স্থবিরতা দীর্ঘায়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে পারমাণবিক ভারত হয়তো প্রচলিত ওয়ান-টু ওয়ান/ মুখোমুখি সংঘাতে বিবাদপূর্ণ অঞ্চলগুলো থেকে চীনকে লড়াই করে হটানোর ক্ষমতা রাখে না।

লেখক: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রাণ জুড়াবে কাঁচা আমের শরবত
প্রাণ জুড়াবে কাঁচা আমের শরবত
কামালের ২৯ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না সবুজ!
কামালের ২৯ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না সবুজ!
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ