X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
স্মরণে আলাউদ্দীন আলী

হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেছো তুমি!

আহসান কবির
১৮ আগস্ট ২০২০, ১৬:২৭আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২০, ১৭:২১

আহসান কবির সুরের সাম্পানে ভেসে কে কখন এই পৃথিবীতে আসে কেউ জানে না। সুরের সাম্পানটা কোন ঘাটে বাঁধা থাকে সেটাও কেউ জানেস্বর্ণানি না। শুধু যিনি এই সাম্পান বাইতে জানেন তিনিই সব ঠিকানা জানেন। সুরের সাম্পানে উঠেও সুরের খেলা সবাই খেলতে পারেন না। ‘সবাই কবি না কেউ কেউ কবি’র মতো—কেউ কেউ এই খেলাটা পারেন। উপমহাদেশের নামজাদা সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলীও পারতেন। সুরের নাগরদোলায় মানুষের হৃদয়টাকে তুমুলভাবে বাজাতে পারতেন!
পাখি, আকাশ, বাতাস, নদী, হাটের কোলাহল, সমুদ্রের ঝড়, গর্জন, পশুর ডাক, পাখির ডানা ঝাপটানো, মানুষের হাসি বা কান্নার রঙ, আকাশের রূপ থেকে সুর সংগ্রহ করে মানুষকে দিতে পারতেন। এই ধরনের মানুষেরা প্রকৃতির মতো খেয়ালি আর মেঘের মতো অভিমানী হন। সুরের রঙ মেখে হোলিখেলা শেষ করে সেই অজানা অচেনা সাম্পানে চড়ে কোথায় যে চলে যান তারা! আলাউদ্দীন আলীও চলে গেছেন, কোথায় গেছেন আমরা কেউ জানি না। শুধু সুর ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন, যা আর থামছে না।
স্রোত থেমে গেলে নদীর মতো মানুষও মরে যায়। আলাউদ্দীন আলীর মতো সুরের নদী এই উপমহাদেশে আর কখনও ফিরে আসবে কিনা সন্দেহ আছে। যিনি ছিলেন ‘দৃষ্টির সীমানায়’, যিনি জানতেন ‘ভালোবাসা যতো বড় জীবন ততো বড় নয়’, তিনি চলে যাবার পরেও মনে করিয়ে দিচ্ছেন—‘তুমি আরেকবার আসিয়া, যাও মোরে কান্দাইয়া, আমি মনের সুখে একবার কানতে চাই!’ সমস্যা হচ্ছে সুরের সাম্পান নিয়ে একবার চলে গেলে কোনও কান্নাতেই ফিরে আসে না কেউ। আলাউদ্দীন আলীও আসবেন না! মিতালী মুখার্জি হয়তো সেই গানটা গাইবার সময় কান্না লুকোবেন, আলাউদ্দীন আলী তবু ফিরবেন না।
হারানোর বেদনা, সহজাত বিরহ, কখনও-সখনও দুঃখ আশ্রিত ভালোবাসা, ভালোবাসানির্ভর রোমান্টিক গান, এমনকি দেশের গানেও আলাউদ্দীন আলী ছিলেন যেন ভিন্ন ঘরানার এক সুরকার! যেন অচেনা এক সুরের জগৎ থেকে সুরের সাম্পানে ভেসে এসেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেই সুর মনে হতো হৃদয়ের সুর। একেবারে মাটির গন্ধমাখা মানুষের আনন্দ বেদনার রঙ মাখানো সুর। নিজের জীবনযাপন, চলাফেরা আর সংসারের আনন্দ বেদনার কাব্য থেকেই যেন নিয়েছিলেন সুর। দেড় বছর বয়সে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে আসলেও মাটির গন্ধমাখা সুরের শেকড়টা কখনো ভোলেননি। বাবা জাদব আলী আর চাচা সাদেক আলীর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন সুর। খুব সুন্দর বেহালা বাজাতে পারতেন। ছোটকালেই তার এই বেহালার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। ছোটকালে বেহালা বাজিয়ে পুরস্কার জিতেছিলেন। পরবর্তীকালে আটবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন গীতিকার হিসেবেও।
বেতার ও টেলিভিশনেও বেহালা বাজাতেন। প্রখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদ এবং আনোয়ার পারভেজের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনাই তার জীবনটাকে বদলে দিয়েছিল। ধ্রুপদী বা ক্লাসিক্যাল সুরের সহজিয়া অংশটার সাথে লোকজ সুরের সংমিশ্রণ করতে পারতেন সার্থকভাবে। অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান তিনি উপহার দিয়েছেন। বাংলা ছবি, রেডিও, টেলিভিশন, বেতার, ক্যাসেট বা অ্যালবামে তার সুর করা গানের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। বাংলা ছবি নিয়ে যতই সমালোচনা থাকুক, কথিত স্বর্ণযুগের ছবির কাহিনি নিয়ে যতই ভেজাল থাকুক, চুরি বা নকল করা সুরের গানগুলো বাদ দিলে বাংলা চলচ্চিত্রের গান সবসময় আপনার হৃদয়ে আনন্দের পরশ ছড়িয়ে দেবে। এই আনন্দ আর গর্বের সময়ের গানগুলোর অনেকটাতেই সুর দিয়েছিলেন আলাউদ্দীন আলী। এসব সুর ভোলা সম্ভব নয়। ঠিক তার গানের মতোই—পারি না ভুলে যেতে স্মৃতিরা মালা গেঁথে হারানো সে পৃথিবীতে ডেকে নিয়ে যায়...। সুরের সাম্পানে চড়ে যে জগতে চলে গেছেন আলাউদ্দীন আলী সেই জগতে চলে যাওয়া মানুষের জন্য শুধু কান্না আর দীর্ঘশ্বাসই থাকে। এই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সুর জড়ানো হলে সেগুলোর কোনোটা হয়তো গান হয়ে ওঠে। এই দীর্ঘশ্বাসের সুর হয়তো আছে ‘দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়’– এই গানে। হয়তো আছে—‘হয় যদি বদনাম হোক আরও আমি তো এখন আর নই কারো’, এই গানে।
বেদনা, দীর্ঘশ্বাস, কান্না, মায়া আর বিচ্ছেদের সুর বেশি দেখা গেছে আলাউদ্দীন আলীর সাম্পানে। বিশেষ করে চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের  সঙ্গে যুগলবন্দি হয়ে সৃষ্ট গানগুলো ছিল অন্যরকম। একবার যদি কেউ ভালোবাসতো, জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো, আমি আছি থাকবো ভালোবেসে মরবো, এমনও তো প্রেম হয় চোখের জ্বলে কথা কয়, হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ, কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিলো না, বাবা বলে গেল আর কোনোদিন গান করো না কিংবা এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই। যেকোনও বিচারে এই গানগুলো ভিন্নমাত্রার, বাংলা গানের ইতিহাসে এই গানগুলো কালজয়ী আর স্বর্ণালি দিনের গান হিসেবেই বেঁচে থাকবে।
প্রযুক্তির আধুনিকতা আর হাল আমলের করোনার জন্য অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। বদলে গেছে চলচ্চিত্রও। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সিনেমা হল। সিনেমার নির্মাণ হারও কমে গেছে অনেক। চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই বেছে নিচ্ছেন ভিন্ন কোনও পেশা। বদলায়নি শুধু মানুষের গান শোনার প্রবণতা। প্রযুক্তি গানকে নিয়ে যাচ্ছে অন্য মোড়কে। গান বদলায়নি বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভালোবেসে একই গান শুনছে, ভবিষ্যতেও শুনবে। সুরের সাম্পান নিয়ে যত দূরেই যান না কেন আলাউদ্দীন আলীরা, তাই বেঁচে থাকবেন অনাদিকাল মানুষের হৃদয়ে।
আলাউদ্দীন আলী (২৪ ডিসেম্বর ১৯৫২ - ৯ আগস্ট ২০২০) ‘মেলায় যাইরে’ খ্যাত শিল্পী মাকসুদুল হক একবার জানতে চেয়েছিলেন কী ভালো লাগে আমার? আমি বলেছিলাম, আপনার পাগলামি! উত্তরে মাকসুদুল হক বলেছিলেন, পাগলামি কখনও-সখনও খুব ভালো ফল বয়ে আনে। আমার একবার পাগলামি চেপেছিল। যে করে হোক আলাউদ্দীন আলীর সুরে একবার, অন্তত একটা গান গাইতে হবে। সেই সুযোগটা পেয়েছিলাম। ‘অঞ্জলী’ ছবিতে আমার গাওয়া সেই গানটা সুপার ডুপার হিট হয়েছিল। গানটার কথা ছিল এমন-  ‘তোমাকে দেখলেই একবার, মরিতে পারি শতবার। তুমি নও তো কভু হারাবার, জীবনে মরণে...।
সুর আর গানের জগত থেকে আলাউদ্দীন আলী কখনও হারাবেন না। তার রেখে যাওয়া সুরের সাম্পানের খোঁজ পেলে কী যে ভালো হতো আমাদের! নতুন প্রজন্মের কেউ সেই সাম্পান থেকে আরও কিছু কালজয়ী সুর এনে আমাদের সমৃদ্ধ করতে পারতেন। মানুষটা অদ্ভুত সুন্দর বেহালা বাজাতেন। বেহালা অনেকেই বাজায়, বেহালা কী কারও জন্য বাজে?
আলাউদ্দীন আলীর বেহালাটা শুধু তার জন্য বাজতো। চোখ বন্ধ করে হৃদয় মেলে দেখুন। দেখবেন তার বেহালাটা থামছে না। কালজয়ী সুর থামলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে!
কেউ কি আছেন? আলাউদ্দীন আলীর বেহালাটা থেকে একটা সুর এনে দিতে পারবেন?
লেখক: গীতিকবি, অভিনেতা

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!